You dont have javascript enabled! Please enable it! নবজীবনের প্রান্তে- তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় | দেশ - সংগ্রামের নোটবুক

নবজীবনের প্রান্তে
তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়
(ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেল থেকে প্রেরিত)

১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকা শহরে পৌছুলাম। ততক্ষণে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন। কিন্তু তখনও ঢাকার সব মানুষ সে খবর জানেন না। দীর্ঘ ন মাসের খান সেনাদের অমানুষিক অত্যাচারের যে এতদিনে শেষ হয়েছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন সার্থক হয়ে এশিয়া খন্ডে জন্ম নিতে চলেছে এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র-অনেকের কাছেই তা এখনাে অজানা।
‘নিরপেক্ষ এলাকা’ বলে ঘােষিত ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেল তখন রেড ক্রসের আওতায়। তাদেরই সাহায্যে আমরা সেখানে আশ্রয় পেলাম। সেখানে দেখি প্রচুর বিদেশী নাগরিক এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী, তার সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঐসব পাক কর্মচারী কথায় কথায় এই হােটেলের কর্মচারীদের শাসাতেন- যেহেতু তারা বাঙ্গালি আর আজ তারাই তাদের আশ্রয়ে এবং পরিচর্যার অনুগ্রহে বলতেই বা দোষ কী নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে চাইছেন।
হােটেলের এগারাে তলায় আমাদের জায়গা হলাে। সারা রাত সেখান থেকে শুনলাম একটা নতুন জাতির জন্মলগ্নের উৎসব ধ্বনি। তার সঙ্গে রাইফেল, স্টেনগান ও গােলার অসংখ্য আওয়াজ। পরের দিন ১৭ই ডিসেম্বর সকালেই আমরা কয়েকজন সাংবাদিক দুখানি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঢাকা শহরের আনন্দ উৎসব দেখতে। প্রথমেই গেলাম শেখ মুজিবের বাড়ি ধানমন্ডিতে। মুজিবরের বাড়ির ফটকে দেখলাম শেখ সাহেবের দুখানি ফটো ঝুলছে-তাতে ফুলের মালা পরাননা। অদূরে একজন বাঙালি আকাশের দিকে হাত তুলে শেখ সাহেবের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া মাগছেন। শেখ সাহেবের স্ত্রী বেগম মুজিবর কোথায় আছেন আমরা জানতাম না। ঢাকার একজন লােকের কাছে শুনলাম তাকে অন্য একটি বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এবং সবচেয়ে অবাক লাগলাে শুনে যে, তখনও তিনি পাক সেনাদের হাতে বন্দিনী কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মুক্ত বাংলাদেশের আকাশ বাতাস যখন নবলব্ধ স্বাধীনতার আনন্দে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় স্বাধীনতা পাগল লােকদের ভীড়ে ভীড়ে মুক্তি ফৌজের আকাশমুখী আগ্নেয়াস্ত্রের ফাঁকা আওয়াজে নবজাত রাষ্ট্রের জয়ধ্বনি তখনও, সেই শুভলগ্নেও জাতির জনকের স্ত্রী পুত্র সপরিবার প্রমুখ স্বজনরা এই ঢাকা শহরে বন্দী হয়ে রয়েছেন! রাস্তার পথচলতি লােকদের কাছে জিজ্ঞাসা করে করে অবশেষে বেগম মুজিবুরের কয়েদখানার হদিস পেলাম। ১৮ নম্বর রাস্তার ১১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে হাজির হয়ে দেখি বাড়িটার সামনে কয়েকটি ক্ষতবিক্ষত গাড়ি এলােমেলাে হয়ে পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে একটা রেড় ক্রসের গাড়িও রয়েছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে যাচ্ছি, পাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন মহিলা চিৎকার করে ওদিকে যেতে বারণ করলেন। আমরা একটু হকচকিয়ে গেলেও সাহস করে খানিকটা এগােলাম। দেখি ১১৩ নম্বর বাড়ির ছাদে সুরক্ষিত বাংকার এর মধ্য থেকে জনাকয় সৈন্য মেশিনগান তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম বােধ হয় আমাদের ভারতীয় জওয়ান। ফটো তােলার জন্য ক্যামেরা তুলেছি, তাদের হুঙ্কার ভেসে বলে- ফটো মাত্ উঠাও গােলি মার দুঙ্গা।’ সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা নামিয়ে নিলাম। ওদিকে পিছন থেকে তখন চিৎকার শুনছি- ফিরে আসুন।’ ওরা কালকেও ছজনকে এখানে গুলি করে মেরেছেপিছিয়ে এলাম। এসে পাশের বাড়ির মেয়েদের আহ্বানে তাদের গেটের মধ্যে ঢুকলাম। সেখান থেকে ভালাে করে ১১৩ নম্বর বাড়ির দিকে তাকাতে দেখলাম তখনও একটা নারিকেল গাছের পাশে একটা লাঠির আগায় বাধা পাকিস্তানি পতাকা পত্ পত্ করে উড়ছে।
কিছুক্ষণ পর জীপে করে কয়েকজন ভারতীয় জওয়ানকে দেখলাম ওখানে নামতে। তাদের নির্দেশে আমাদের গাড়িগুলি দূরে সরিয়ে নিতে হলাে। তারপর আমাদের জওয়ানরা চটপট ১১৩ নম্বর বাড়িটিকে ঘিরে চারিদিকে মেশিনগান ও অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে ‘পজিশন’ নিয়ে শুয়ে পড়লেন। আশেপাশের লােকজন ভাবল এখনই বুঝি এক খন্ডযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। তারা পালাতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে । ভারতীয় জওয়ানদের মধ্য থেকে মেজর অশােককুমার তারা ও একজন লে. অপারেটর ১১৩ নম্বর বাড়ির সামনে এগিয়ে গিয়ে পাক সৈন্যদের আত্মসমর্পনের খবর জানিয়ে তাদেরও আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তারা সে খবর বিশ্বাস করতে পারছিল না। সুতরাং আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর ওরা কি ভেবে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করল। অতঃপর আমরা ১১৩ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে পেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমাদের মেজর যতই তাকে আশ্বাস দেন আর কোন ভয় নেই জানান ততই তিনি আরাে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। সাহেবের দুই মেয়ে-বড় মেয়ে হাসিনা,ছােট মেয়ে রেহানা এবং ছােট ছেলে (দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে যার নাম রেখেছিলেন) মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখও শুকনাে নয়। বেগম মুজিব বড় মেয়ের ক’মাসের বাচ্চা জয়কে কোলে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন-এর নাম রেখেছিলাম জয়- আমাদের জয়, বাংলাদেশের জয় কিন্তু গলা তার কান্না ও আবেগে আবার হয়ে এল। বড় মেয়ে হাসিনা ইতিমধ্যে ঘরের ভেতর থেকে শেখ সাহেবের একখানা ছবি মায়ের কোলে রেখে উপুড় হয়ে ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বাইরে তখন জনতার উন্মাদ উৎসব। ঢাকা শহর উত্তাল… জয় বাংলা…জয় বঙ্গবন্ধু…শেখ মুজিবুর জিন্দাবাদ।

সূত্র: দেশ : ৯ পৌষ, ১৩৭৮