বাংলাদেশের মুক্ত রাজধানী ঢাকা
এ জয় সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী জনতারও জয়
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঘােষণা
ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত রাজধানী, প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৬ ই ডিসেম্বর প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে এ কথা ঘােষণা করে বলেন, মানব শক্তি ও মানবাত্মার মূল্য যেসব দেশ দিয়ে থাকে, তারা সকলেই এই গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্নকে স্বীকার করবেন। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়ােজনের বেশী এক মুহূর্তও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে থাকবে না। শান্তির অতন্দ্র প্রহরী বাহিনী একতরফাভাবেই পশ্চিম রণাঙ্গনেও ১৭ ডিসেম্বর রাত ৮টা থেকে যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা করে। বাংলাদেশ সরকারের সূত্র থেকে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, শীঘই রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় দপ্তর স্থানান্তর করা হবে। মুক্তির আনে ঢাকা। ফুলের মালা, লাল মেহেন্দী ছুঁড়ে মিত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক জওয়ানদের প্রতি উচ্চ অভিনন্দন ছিটিয়ে দেন সদ্যমুক্ত নর নারী, কিশাের কিশােরী। আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। ইয়াহিয়ার দোসর নিয়াজিকে চোখের জল চাপতে চাপতে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর প্রধান লে. জে. আরােরাকে মুক্ত বাংলার নরনারীরা কাঁধে নিয়ে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাসকে মুখরিত করেছিল। আমাদের দেশপ্রেমিক জওয়ানদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন ঢাকার সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণী মানুষেরা। আনন্দে উল্লসিত কলকাতা, দিল্লী প্রভৃতি। সংসদ সভার সকল সদস্য রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আত্নসমর্পণের খবর শােনার জন অপেক্ষা করতে থাকেন এবং শেষে সাড়ে ৫টার সময় প্রধানমন্ত্রী যখন আত্মসমর্পণের খবর ঘােষণা করেন তখন তারা আনন্দে ফেটে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী সভাকক্ষে প্রবেশ করলে অনেকক্ষণ ধরে হাততালি চলতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি একটা ঘােষণা করছি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন মুক্ত দেশের মুক্ত রাজধানী। সঙ্গে সঙ্গে কর্ণবিদারী হর্ষধ্বনি আর ডেস্ক চাপড়ানাের শব্দ শুরু হয়ে যায়। এবং প্রধানমন্ত্রীকে এরপরের কথাগুলি বলার জন্য প্রায় দু মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তিনি ঘােষণা করেন ভারতীয় সময় বেলা ৪টে ৩১ মিনিটের সময় ঢাকায় পাকিস্তানের ইস্ট কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন। পূর্ব খণ্ডে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরােরা ঐ আত্মসমর্পণ স্বীকার করে নেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনায় সভা ও সারা দেশ আনন্দিত। বাংলাদেশের জনগণের এই বিজয় মুহূর্তে আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই। আমরা অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর সাহসী ও তরুণ বালকদের (হর্ষধ্বনি)। আমরা আমাদের স্থলবাহিনী নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য গর্বিত (হর্ষধ্বনি) যাঁরা চমৎকারভাবে তাদের উৎকর্ষ ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাদের নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তব্য নিষ্ঠা সুবিদিত। যারা জীবন বলি দিয়েছেন, ভারত তাদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। পাকিস্তানী যুদ্ধ বন্দীদের সঙ্গে জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী আচরণ করার জন্য ও বাংলাদেশের সকল শ্রেণির জনগণের মানবিক ব্যবহার করার জন্য আমাদের সৈন্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কও তাঁদের সৈন্যদের প্রতি অনুরূপ আদেশ জারি করেছেন। যদিও বাংলাদেশ সরকারকে এখনও পর্যন্ত জেনিভা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সুযােগ দেওয়া হয়নি। তবু তারা এই ঘােষণা চুক্তি পুরােপুরি মেনে চলবেন বলে ঘােষণা করেছেন। বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রতিশােধ রােধ করা।
আত্মসমর্পণের শর্তাবলী
বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানীবাহিনী আত্মসমর্পণের শর্তাবলী নিম্নরূপ: (১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় লে. জে. জগজিৎ সিং অরােরা এবং লে. জে. এ কে নিয়াজির মধ্যে আলােচনায় স্থির হলো) :
“ভারতীয় ও বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর কমান্ডার লে. জে, জগজিৎ সিং অরােরা সমীপে পূর্ব রণাঙ্গনের বাংলাদেশে অবস্থানকারী সমস্ত পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে বলে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ড মেনে নিচ্ছেন।
“এই আত্মসমর্পণের মধ্যে পদাতিক, নৌ ও বিমানসহ আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ সমস্ত পাকিস্তানীকে ধরা হচ্ছে।
“ঐ বাহিনীসমূহ অস্ত্র ত্যাগ করবে এবং বর্তমানে যে যেমন অবস্থানে রয়েছে, তার কাছাকাছি লে. জে. আবােরার অধীনস্থ বাহিনীর কাছে ধরা দেবে।
“চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ড লে. জে. আরােরার অধীনস্থ হবে।
“আদেশ অমান্য করলে তা আত্মসমর্পণ শর্ত লঙ্ঘন বলে ধরা হবে এবং যুদ্ধের রীতিনীতি অনুযায়ী আইন অমান্যকারীর সঙ্গে ব্যবহার করা হবে। আত্মসমর্পণের শর্তের অর্থ ব্যাখ্যায় এবং বিশ্লেষণে কোননা সন্দেহ দেখা দিলে লে. জে. আরােরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে।
বিদেশী নাগরিক সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানজাত সরকারী কর্মচারীদের রক্ষার দায়িত্ব লে. জে. আরােরার বাহিনী।
সবশেষে লে. জে. আরােরা দৃঢ় আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের সূত্র অনুযায়ী সম্মানজনক আচরণ করা হবে। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার সুরক্ষার যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকবে বলেও ভারতীয় অধিনায়ক আশ্বাস দিয়েছেন।
সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১