You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.17 | বাংলাদেশে প্রয়ােজনের বেশি এক মুহূর্ত ভারতীয় মিত্র বাহিনী থাকবে না- ইন্দিরা গান্ধী | পশ্চিমবঙ্গ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে প্রয়ােজনের বেশি এক মুহূর্ত ভারতীয় মিত্র বাহিনী থাকবে না
ইন্দিরা গান্ধী
নয়াদিল্লী, ১৬ ডিসেম্বর (ইউ এন আই)

বাংলাদেশে দখলদার পাক বাহিনীর সেনাপতি লে. জেনারেল নিয়াজির নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে বলেন, প্রয়ােজনের বেশি এক মুহূর্ত ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে থাকবে না। তিনি আশা করেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের মধ্যে তাঁর নিজের যােগ্যস্থানে এসে অধিষ্ঠিত হবেন। ঢাকা স্বাধীন বাংলার মুক্ত রাজধানী ঘােষণা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার জেনেভা চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ না হয়েও তার সৈন্য বাহিনীকে পাক সৈন্যদের সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশানের আইন মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি নিপীড়িত জাতির মুক্তির জন্য যে জওয়ানরা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে বলেন সমগ্র জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের জনগণের বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, এ জয় একা তাদের নয়, বিশ্বের সমগ্র মুক্তিকামী জনতার জয়।

এবার ঘরে ফেরার পালা
নদী নালা পেরিয়ে, খালে বিলে বনে জঙ্গলে বনে লুকিয়ে নৌকায়, পায়ে হেঁটে ওরা এসেছিলেন। এসেছিলেন বললে ঠিক বলা হল না। ওরা আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রাণের বড় কিছু নেই। জীবন একবারই পাওয়া যায়। তাই প্রাণের দায়ে, জীবনের মায়ায়, প্রাণে বেঁচে থাকার আশায় ওরা একে একে, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে, লক্ষে লক্ষে এসে জড়াে হয়েছিলেন। ঘর ছেড়ে, বাড়ি ফেলে, মাঠ পেরিয়ে শঙ্কিত মনে ওরা যখন এদিকে পা ফেলেছিলেন তখন ভেবেছিলেন আর কিছু না হােক, পাক সেনাদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। ইজ্জত রক্ষা হবে। মৃত্যুর অব্যক্ত বীভৎসতা, নির্যাতনের করুণ কাহিনী, পীড়নের সীমাহীন যন্ত্রণা বঞ্চনার পর্বতসম বেদনার শত সহস্র স্মৃতি নিয়ে ওরা জড়াে হয়েছিলেন যে যেখানে পেরিয়ে-মাঠে মাঠে, রাস্তায় রাস্তায়, গাছতলায়, স্কুলে স্কুলে, আমাদের সীমান্তের আটটি জেলা জুড়ে, আসামে, মেঘালয়ে, ত্রিপুরায়, বিহারে। আমরা ওদের ডেকে আনিনি, কিন্তু যারা এসেছিলেন তাদের সকলকেই স্থান করে দিয়েছি। ভাগাভাগি করে নিয়েছি। ওরা যে সুখে ছিলেন তা নয়। কিন্তু নিরাপদে ছিলেন, নিশ্চিন্তে ছিলেন, নির্ভয়ে ছিলেন। একটি মাত্র পরিচয় ওদের ওরা জয় বাংলার লােক, কেউ ওদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ওরা বলতেন, আমরা জয় বাংলার লােক। “জয় বাংলা,ওদের প্রিয় নাম, আমাদেরও প্রিয়।” জয় বাংলা জাতির মুক্তির সংগ্রামে এক নতুন সংযােজন। অহিংস থেকে সহিংস, দল থেকে জাতীয়, প্রতিরােধ থেকে প্রত্যাঘাতের অভিনব সংগ্রাম।
জয় বাংলা পরিচয়ে কোন ধর্মান্ধতা নেই, নেই সাম্প্রদায়িকতা, নেই প্রাদেশিকতার কোন চিহ্ন। জয় বাংলা যেমন সামরিক চক্রের নিপীড়ন, অত্যাচার ও লুণ্ঠনের ক্লেদাত্মক একটি বিশ্ব স্বাক্ষর তেমনি জনগণের রক্তে অর্জিত একতা সংগ্রাম ও মুক্তি এবং মৈত্রীর সুস্পষ্ট পরিচায়ক। তাই ওরা আমরা কষ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জয় বাংলা বলেছি। জয় বাংলা ওদের একত্রিত করেছে, জয় বাংলা আমাদেরও সংহতিকে মজবুত করেছে। জয় বাংলা সামরিকতন্ত্রকে নিস্পেষিত অন্য জাতিকেও অনুপ্রাণিত করেছে। জয় বাংলা আজ বিশ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় সংহতি, ভারতের জোট নিরপেক্ষ, শান্তি, মৈত্রীর বৈদেশিক নীতি-প্রতিবেশীকে উদ্দীপ্ত করে জয় বাংলা তারই স্বাক্ষর। এই জয় বাংলার মানুষ বুড়াে বুড়ি, ছেলে মেয়ে, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, অধ্যাপক, তরুণ-তরুণী,এবার স্বাধীন বাংলায় ফিরে চলেছেন। তাঁরা দলে দলে ফিরতে আরম্ভ করেছেন। ভয় ভীতি নিয়ে, পরাধীনতার জ্বালা নিয়ে তারা এসেছিলেন, ফিরছেন তারা স্বাধীন নাগরিক হয়ে, উন্নত শিরে, গঠনের শপথ নিয়ে। শূন্য হাতে এসে ভরা মন নিয়ে ওরা ফিরছেন। ওরা ফিরছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নিয়ে। ফিরছেন ভারতের মৈত্রী আর সহযােগিতা আর সম্প্রীতি নিয়ে। সহযােদ্ধার মৈত্রী আর সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি সামনে রেখেই ওরা ফিরছেন। ওরা সােনার বাংলাদেশকে গড়বেন আমরা সাহায্য দেব। আমরা নতুন মহাঐক্যের ভারত গড়ব ওরা সহযােগিতা করবেন। সৎ প্রতিবেশীর নতুন দিগন্ত, নতুন সড়ক, ওরা আমরা খুলে দিয়েছি। সেই সড়ক ধরে ওরা আসরা চলছি। তাই শুধু ফিরে যাওয়া নয়, নতুন ভ্রাতৃত্বের সংগ্রামী রক্তের বন্ধন রেখে যাওয়া।
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি শ্রীমৃণাল চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছিলেন, বাড়ি ফিরছেন কবে ? প্রশ্ন শুনে তুপ্তির হাসি মুখে ভরিয়ে ফেলল জহর পাল। স্ত্রীর সঙ্গে দড়ির খাটিয়া তৈরি করেছিল লবণ হ্রদের ৫নং সেক্টর কাম্পে, তাড়াতাড়ি হাত মুছতে মুছতে উঠে বসে বলল, হ্যা স্বাধীন হয়ে গেছি। ফিরবাে তাে নিশ্চয়ই। সরকার নিশ্চয়ই সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আর দু চার কথা বলতে বলতেই দেখলাম আবাল বৃদ্ধ বনিতার আগ্ৰয্যেসুক দল আমার চারপাশে। দেশে ফেরার কথা হচ্ছে। আমার মনে হলাে এরা যেন শ্রবণ, ঘ্রাণ আর অনুভব দিয়ে গ্রহণ করতে চাইছে সেই পরম প্রার্থিত সংবাদ তারা আবার দেশে ফিরবে। সেই দেশ, নদী সরােবর, ধানক্ষেত, নারিকেল বীথি, সবুজ বনানী ঘেরা, ধান পাট ফসলে ভরা। তাদের কত পুরুষের আকাঙ্খিত বাউল ভাটিয়ালির সুরে ভরা দেশ। অকস্মাৎ এক জঙ্গী হানাদারের পৈশাচিক আক্রমণে যে দেশ থেকে তাদের উৎখাত হতে হয়েছে নয় মাস আগে। ঘর গেছে, জমি গেছে, গােলায় ভরা ধা গেছে। কত বাড়ীর মেয়েদের ইজ্জত, কত মায়ের বুক গেছে খালি হয়ে। তারপর সংগ্রাম। শশাষণ মুক্তির সংগ্রামে আগ্রাসন দূর করার সংগ্রাম। যে মুক্তির সংগ্রামে আজ ভারতের মানুষও বাংলাদেশের মানুষের পাশে। একে একে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হচ্ছে আর বাঙলার এক কোটি মানুষ যারা শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে তাদের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হচ্ছে নতুন মুক্তির আস্বাদে। সম্প্রতি সীমান্ত অঞ্চলে ও লবণ হ্রদের বিভিন্ন শিবিরে ঘুরে এটুকু বুঝেছি যে, এরা একটা ব্যবস্থা হলেই দেশে ফিরতে চায়। বনগাঁ ও বসিরহাট অঞ্চলে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সংখ্যক শরণার্থী নিজেরাই ফিরে গেছেন। বেসরকারি সূত্রের খবর যে তাদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার হবে। যারা ঘরে ফিরছেন তাদের নাম, গন্তব্যস্থল ইত্যাদি নথিভুক্ত করার জন্য বসিরহাট অঞ্চলে পাঁচটি চেক পােস্ট খােলা হয়েছে হকিমপুর, টাকি ঘাট, হাসনাবাদ রেলওয়ে স্টেশন, আমুদিয়া ও যােজাডাঙ্গায়। বিভিন্ন শিবিরে শরণার্থীরা খুবই ব্যগ্র মুক্তিযুদ্ধের খবর জানতে। সাড়া ব্রিজ কোথায় ভাঙল, কুষ্টিয়ায় কিভাবে পতন হল ইত্যাদি। ফরিদপুরের নগেন সাহা সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন, শেখ সাহেবের ছেড়ে দেবে না? ইন্দিরা গান্ধী ওকে ছাড়িয়ে আনবেন ত? ইন্দিরা গান্ধি ওকে ছাড়িয়ে আনবেন ত? আমি বৃদ্ধ ভদ্র লােককে আশ্বাস দিলাম। অধিকাংশ শিবিরেই প্রত্যাবর্তনেচ্ছুক শরণার্থীদের একটা প্রশ্ন বার বার করতে শুনেছি-ফেরবার ববস্থা হবে কি ভাবে? বরিশালের হরেণ মন্ডল বনগাঁ হেলেঞ্চা ক্যাম্পে আছেন। জানতে চাইলেন তার ঘর বাড়ি কি হবে? সব ত পােড়ায়ে দিছে। ঘর জ্বালাইয়া দিছে। জমি বেদখল হইয়া গেছে। খামু কী? এ প্রশ্ন আরাে অনেকেই করলেন। আমি সকলকে আশ্বস্ত করলাম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এর ঘােষণার কথা জানিয়ে। ১১ই ডিসেম্বর যশাের বিজয় উৎসবে তিনি বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ঘােষণা করেছেন যে, ২৫ শে মার্চের আগে জমি ও বাড়ী ফিরিয়ে দেওয়া হবে। দোকানের সম্পর্কেও ওই সিদ্ধান্ত প্রযােজ্য। এখন ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রস্তুত করছেন যাতে যথাসম্ভব শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়। যশাের জেলার গুরুদাসী এ সংবাদে খুব সন্তুষ্ট। এবার তাে নিশ্চয়ই দেশে ফিরব। এখন তাে আমার নিজের দেশ। গুরুদাসীর তিনটি ছেলে। ছােট ছেলে সঙ্গেই ছিল। মার কথার প্রতিধ্বনি করে বলল, দেশে যাব। নতুন রস খাব। হ্যা এবার তােমাদের ঘরে ফেরার পালা। গুরুদাসীর বড় ছেলে এখন মুক্তি বাহিনীতে যােগ দিয়েছেন। এখানে অনেকের ছেলেরাই এখন মুক্তিবাহিনীতে। এ অঞ্চল থেকে বেশ কিছু শরণার্থী ফেরবার তােড়জোড় করছে। অনেক পরিবারের কর্তা আগে বাংলাদেশে গিয়ে দেখে আসছে অবস্থা কেমন? তারপর ফিরে এসে পরিবার সমেত ঘরে ফিরছে। গত নয় মাস এই প্রায় এক কোটি শরণার্থী ইয়াহিয়ার বর্বর অত্যাচারে গৃহহারা দেশ ছাড়া। আজ তারা আবার বাঁচবার আনন্দে উদ্বেল। নিজের অতি প্রিয় সােনার বাংলায় ফিরে পাবার আশায় মুখর। অতিথি সৎকারে ভারতের যত আশা ছিল তার সামর্থ ততটা ছিল না। তবু তােমাদের যথাসাধ্য করেছে। আজ এসেছে তােমাদের ঘরে ফেরার পালা। তােমাদের নতুন যাত্রাপথের আরম্ভ শুভ হােক।
অয়মারম্ভ শুভায় ভব?

সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১