You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.17 | দেশপ্রেম সঞ্জাত যুদ্ধের দিনগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চলগুলি কর্মের সঙ্গে ঐক্যের বাণীকে মুখর করে তুলেছিল | পশ্চিমবঙ্গ - সংগ্রামের নোটবুক

দেশপ্রেম সঞ্জাত যুদ্ধের দিনগুলিতে
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চলগুলি কর্মের সঙ্গে ঐক্যের বাণীকে মুখর করে তুলেছিল
মানিক সরকার

যুদ্ধ চলেছিল পূর্ব পশ্চিম রণাঙ্গনে। এই বিস্তীর্ণ রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগে ছিল ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ-যুদ্ধের সেটা দ্বিতীয় বাহু ঐক্যবদ্ধ বেসামরিক জনগণের স্বেচ্ছানির্মিত দেশপ্রেমিক ব্যুহ। পূর্ব রণাঙ্গনে এই দ্বিতীয় ব্যুহের একটি অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ।
এই দ্বিতীয় ব্যুহের শিল্পোন্নত পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক শ্রেণী একটি প্রধান অংশীদার তারা বিশ্বকর্মা। তাদের শ্রমেই কল চলছে। চলছে যন্ত্র চালিত আধুনিক জীবনও। তারাই উৎপাদন করছেন সমরাস্ত্র রাইফেল, বারুদ, গােলাগুলি তৈরী করেছেন নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রী।
শিল্পাঞ্চলগুলি এখন কর্ম মুখর। পাক আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ চলছিল, কলকারখানাগুলিতে চলেছিল উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতিযােগিতা। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত গােলাগুলি, কামানের, গর্জন তর্জন আর শিল্পাঞ্চলগুলির কলকারখানায় মেশিন চলার অবিরাম শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে উভয়েই মিলেছে আজ দেশের ডাকে। অধিকাংশ কল কারখানা প্রয়ােজনবােধে ওভার টাইমে কাজ হয়েছে কোথাও কোথাও রবিবারেও কাজ চলছে। শ্রমিকরা পুরাে সংখ্যায় হাজির হয়েছেন। ছুটি বা কামাই নেই বললেই চলে। ওরা বলেছেন, আমাদের জওয়ানরা মৃত্যুভয়কে পদদলিত করে আছেন যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা সর্বপ্রকার আলস্যকে পরাভূত করে আছি মেশিনের পাশে। দ্রব্য সম্ভারের উৎপাদনে কোন ফাঁকি নেই। মহৎ দেশপ্রেম উভয়কে একই কর্তব্যকর্মে বেঁধে ফেলেছে।
শ্রমিকরা এই দেশপ্রেমিক যুদ্ধ সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন। তারা রেডিওর সামনে জমা হয়ে যুদ্ধ বুলেটিন শােনেন, শােনেন জাতীয় নেতৃবৃন্দের ভাষণ। দল বেঁধে কাগজ পড়েন-তা হিন্দি বাংলা উর্দু যে ভাষারই কাগজ হােক না কেন। যুদ্ধ নিয়ে আলােচনা করেন। নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হন। ওদের দায়িত্ব শিল্পোৎপাদনকে অব্যাহত রাখা তাকে বাড়িয়ে তোেলা ওদের কর্তব্য, এই দায়িত্ব ওরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
বারাকপুর পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি বড় শিল্পাঞ্চল। হুগলী নদীর পূর্ব পাশে দমদম থেকে কাচড়াপাড়া পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চলে ছােট বড় বহু কল কারখানা রয়েছে-চটকল, সুতাকল, রংকল গােলাবারুদ ইত্যাদি বহু জাতের কারখানা। আধুনিক এই কলকারখানাগুলি ভারতের বিভিন্ন জাতি, উপজাতি বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্নধর্মাবলম্বীর মানুষকে টেনে এনেছে, সমবেত করেছে, একত্রিত করেছে। একই সঙ্গে কাজ, একই সঙ্গে বাস, একই সাথে চলাফেরা, একই ঘাটে স্নান। একই বাজারে কেনাবেচাএমনি করে নিত্যকার জীবনযাত্রা এদের সংহত করেছে। দেশের উপর চীন মার্কিন সাহায্য পুষ্ট পাক আক্রমণ ওদের জীবিকার সংহতিকে দেশপ্রেমিক সংহতিতে রূপান্তর করেছে। জীবন্ত ভাবাবেগ সমৃদ্ধ সংহতির ভারতবর্ষে এই শিল্পাঞ্চলগুলি কর্মযজ্ঞের সংহতিররূপ নিয়েছে।
কল-কারখানায় কর্মোদ্যমের সঙ্গে মিশে ছিল প্রতিদিনের স্বাভাবিকতা। আমাদের দেশপ্রেমিক জওয়ানদের যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে পরাস্ত করার যুদ্ধনৈপুণ্য এই স্বাভাবিকতাকে দিনে দিনে বলিষ্ঠ করে তুলেছিল। আবার পশ্চাৎভাগের জনজীবনের এই স্বাভাবিকতা অগ্রবর্তী রনাঙ্গনে জওয়ানদেরও প্রেরণা যুগিয়েছে। তাই মাঝে মাঝে বিটি রােড পেরিয়ে ঘােষপাড়া রােডের উপর দিয়ে বীর জওয়ানদের কনভয় যখন যায়, তখন অনেক স্থানেই হাত তুলে অভিবাদন এবং প্রত্যাভিবাদনের মধুর সম্পর্কের প্রতিযােগিতা চলে। যে শ্রমিক কলে কঠোর পরিশ্রম করে, আর যে জওয়ান রণক্ষেত্রে দুধর্ষ শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করেন, তারা উভয়েই এখানে প্রতিমাখা হাত দুলিয়ে ঘােষণা করেন-আমরা একই পরিবারের লোেক আমরা ভারতবাসী। আমাদের জওয়ান দেশের রক্ষক, আমাদের শ্রমিক দেশের চালক-উভয়েই আজ মিলে মিশে গেছে। ওরা সীমান্তের প্রহরী, এবার ওরা বাংলাদেশের মুক্তিরও দূত। আর এই শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রাকে মজবুত করেছেন। তাই শিল্পাঞ্চলের পথে পথে জওয়ানদের দখলে গর্বোদ্যত মস্তকে শ্রমিকদের আনন্দ উল্লাস অভিন্ন জীবনাদর্শেরই তা পরিচায়ক।
যুদ্ধের দিনে সতর্কতারই আর এক নাম স্বাভাবিকতা। এই ভয়ভীতিহীন স্বাভাবিকতা ছিল সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে-তার বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রে, বিশাল বিশাল শিল্পাঞ্চলে স্কুলে কলেজে, পথে ঘাটে, সিনেমা থিয়েটারে স্বাভাবিকতা ছিল শ্রমিকদের বস্তীতে, কৃষকের ঘরে। পাক আগ্রাসীদের চাপিয়ে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছি আমরা জীবন দিয়ে বরণ করেছি আমরা দেশপ্রেম দিয়ে । শত্রুর পরে তাই পাল্টা আঘাত হানা নিয়ে কোন বিতর্ক ওঠেনি কোন মহলে। এ নিয়ে কোন তর্ক বিতর্ক নেই শ্রমিক মহল্লাতে।
জগন্দলের ১১নং গলিতে বাসুদেব সিংহের বাড়ি। বাড়িতে বহু ভাড়াটে আছেন, বিহার উত্তরপ্রদেশের মানুষ তারা ধর্মে কেউ হিন্দু কেউবা মুসলমান মাতৃভাষায় কেউ উর্দু, কেউ বা হিন্দী। বাড়ির পাশেই চায়ের দোকান। চায়ের দোকান দিয়েছেন এক বাঙ্গালি যুবক। ওই দোকানে আছে রেডিও। সবাই এসে ভীড় করেন সেখানে। জওয়ানদের এক একটি যুদ্ধ জয়ের সংবাদে, বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলের প্রসারতায় ওরা সকলেই উল্লসিত হন কামুদ্দিনও। লেপ তােষক তৈরীর কারিগর কামুদ্দিন। ঘরে আছে স্ত্রী আর একটি মেয়ে। তার আদি বাসভূমি বিহারের এক গ্রামে। এখন স্থায়ীভাবে আছেন এখানে। নিজস্ব কোনাে বাড়ি নেই। জন্মকাল থেকেই ভাড়াটে। প্রশ্ন করেছিলাম বাড়ি কোথায় ?
উত্তরে বললেন ১১নং গলিতে। জগন্দলের ১১নং তার এখন দেশ অর্থাৎ আপন বাসভূমি। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস এখানে।
কামুদ্দিনের লেপ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই ঘরে ওঠে। সে লেপ শীতের রাতে সবাইকে আরাম দেয়। তাতে তুলার তাপের সঙ্গে কামুদ্দিনের শ্রমের উত্তাপও মিশে আছে। এ বাড়ির ছাদ, ও বাড়ির বারান্দা কিম্বা কোন উঠনে বসে কামুদ্দিন নিজের মনে ক্রেতার নির্দেশ মাফিক লেপ বানায় তারই ফাঁকে ফাকে যুদ্ধের কথা শােনেন। বাংলাদেশের কথা বলে, আলােচনা শােনেন। ইয়াহিয়ার দুশমনিকে ধিক্কার জানায়। এ ধিক্কার কাকিনাড়া আলমবাজার হাজি নগর ইত্যাদি সর্বত্রই।
বিচিত্র জীবন ধারায় বৈচিত্র্যময় জীবিকার পেশা। ফল বিক্রেতার এজাহার মৌসুমের ফল ফেরি করে বেড়ায়। ঘরে ঘরে যায় হিন্দী উর্দু যেখানে যে ভাষার প্রয়ােজন সে ভাষাতেই ফলের দরদাম করে। ফল বেচার ফাঁকে ফাঁকে যুদ্ধের খবর নেয়। কখনাে বা নিজের মতাে উপস্থিত করে বলে দুশমন লােক বহু দুশমনি কেয়া ; আভি-। পাক দুসমনদের পরাজয়ের হারের মনেও আনন্দ আসে। আনন্দের হাসি ফোটে বৃদ্ধ সাহেবুদ্দিনের কঠোরে কোমলে মিশ্রিত চোখে-মুখে। আলেকজান্ডার জুট মিলের তাঁত ঘরের তিনি লাইন সর্দার ছিলেন। তিনি ৩৭ বছর টানা কাজ করেছেন। তার বাবাও একজন শ্রমিক ছিলেন। সাহেবুদ্দিন এখনও কর্মক্ষম। ওয়েভারলি চটকলে বদলি শ্রমিকের কাজ করেন। বদলি শ্রমিকের মাঝে মাঝে কাজ। মাঝে মাঝে অবসর। অলস জীবন তার ধাতে সয় না। কাজ যখন থাকে না তার তখন চাদর বিক্রির কাজে নেমে পড়েন। সঙ্গে নেন নাতি ইস্তিখার উদ্দিনকে। নাতি দাদুর কাছে ব্যবসা শিখছে। দাদু আর নাতি মিলে কাঁধে চাদর নিয়ে যান আতপুরে, গাড়লিয়া, শ্যামনগরে, ইছাপুরে। চলতে চলতে কোন দোকানের পাশে বা ঘরের কোন রেডিওতে সংবাদ প্রচারের সময় ওরা দাঁড়িয়ে থাকেন। সংবাদ শােনেন। বাংলা বা হিন্দি যে ভাষাতেই সংবাদ প্রচারিত হােক না কেন ওরা তা শােনেন। নাতিকে দাদু বলেন, হামারদেশ পর ও লােক হামলা কিয়া, মেরা জওয়ান ভাই আগে বাড়রাহে ইত্যাদি। বাংলাদেশের কথা ইসতিখার উদ্দিন জিজ্ঞেস করলে দাদু ঢাকার কথা বলেন। যৌবনকালে সাহেবুদ্দিন একালের বাংলাদেশের সেকালের ঢাকা শহরে একবার গিয়েছিলেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে কিশাের ইসতিখার উদ্দিনের মনে ওদেশে যাবার কথা হয়তাে মাঝে মাঝে উকি মারে। বাংলাদেশের মানুষের ত্যাগ, শৌর্য, বীরত্ব এদেশের মানুষের অন্তরে কত শত স্বপ্ন এনে দিয়েছে।
ওদের কথা ভাবছে দক্ষিণ ভারতের অন্ধপ্রদেশের মানুষ পশ্চিমবাংলায় কর্মরত শ্রমিক এরেসু। এরেসু মাতৃভাষা তেলেগু। নিজেদের মধ্যেই তেলেগুতেই কথা বলেন, বাঙালিদের সঙ্গে আধা বাংলা আধা হিন্দীতে বলেন। কিছু ইংরেজীও বলতে পারেন। এখন কাজ করেন টিটাগড়ের কেনিসন জুট মিলে, থাকেন জঙ্গলা শউ-এর গলিতে। বহু বছর ধরে আছেন পশ্চিমবঙ্গে। অন্ধ্রে ফিরে যাবার কথা বড় ভাবেন না। ভাবেন কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে। উনি ২/৩ বার সল্ট লেকে এসে শরণার্থীদের দেখে গেছেন, তাই শরণার্থীদের আলােচনায় উনি উৎসাহ পান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার উনি উল্লসিত হন।
এমনি বিভিন্ন জাতের বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের পাশাপাশি বাস পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চলগুলিতে। এঁরা মিলে-মিশে বাস করে আসছেন। এরা খেটেখাওয়া মানুষ। জাত নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, ভাষা নিয়ে তাই এঁদের মধ্যে কোন বিরােধ নেই। যদি কিছু বিরােধ থেকে থাকে তবে তা আছে আর্থিক বৈষম্যে ধনী আর দরিদ্রে। তবু বিদেশী আক্রমণের মুখে সে বিরােধেরও স্থান ছিল না।
শিল্পাঞ্চলের বিচিত্র জীবনে পথে পথে রয়েছে জীবন বৈচিত্র্যের ছাপ, এ বৈচিত্র্য দোকানে দোকানে, সাজপােষাকে, কিন্তু তার মধ্যেই একটি ঐক্যের সুর প্রতিনিয়ত বেজে চলেছে- ভারতীয় ঐক্যের সুর। এই সুর আমাদের সবাইকে টেনে রেখেছে, এই সুর আমাদের সকলের অন্তরকেই বেঁধে রেখেছে। এটাই আমাদের গর্ব, এটাই আমাদের চিরকালের সম্পদ- এ কালের মহান অস্ত্র, সর্বকালের অগ্রগতির বিশ্বস্ত পাথেয়।

সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১