প্রত্যক্ষদর্শী বিদেশী নাবিকের বিবরণ
পাক ফৌজ চালনা বন্দর জ্বালিয়ে দিয়েছে
‘পাক ফৌজ ৪ এপ্রিল বিকালে চালনা বন্দর জ্বালিয়ে দিয়েছে। বন্দরের ছােট শহরটি এখন শ্মশান। ৫ এপ্রিল সকালে সেখানে আমি জনপ্রাণী দেখিনি। তবে বন্দরের অদূরে চারটি জাহাজ নােঙর করে দাঁড়িয়েছিল। আর ছিল একটি ডেস্ট্রয়ার। কিন্তু স্থলের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক ছিল না আমাদেরও। এদিকে রসদ ফুরিয়ে আসছিল। দুদিনের মত পানীয় জলও ছিল না আমাদের। বাধ্য হয়ে চালনায় সব মাল খালাসের আশা ছেড়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি না দিয়ে বে-আইনীভাবে বিশাখাপত্তনমের উদ্দেশ্যে রওনা হই। মাঝপথে ওয়ারলেসে নির্দেশ আসে, তােমরা কলকাতায় যাও’। তাই এখানে। শনিবার সন্ধ্যায় খিদিরপুর ডকে একটি ফিলিপিন জাহাজের ক্যাপটেন (জাহাজটি করাচির হেগেল কোম্পানির ভাড়া করা বলে ক্যাপ্টনের অনুরােধে তার ও জাহাজের নাম প্রকাশ করা হল না। তাঁর কেবিনে বসে কথাগুলি বললেন।
৩৬ বছর বয়স্ক ক্যাপ্টেন ইতিমধ্যে পৃথিবীর বহু বন্দরে গিয়েছেন; কিন্তু ৪ এপ্রিল চালনায় যা দেখেছিলেন তাতে শিউরে ওঠেন। এই ধরণের অভিজ্ঞতা এই প্রথম তাঁর। বললেন, ‘জীবনে আর চালনায় যাচ্ছি না।’
জাপান থেকে চাল নিয়ে জাহাজটি প্রথম চট্টগ্রামে গিয়েছিল। সেখানে মাল খালাসের পর ১৬ মার্চ চালনায় পৌঁছায়। তারপর মাল খালাস করতে থাকে। কিন্তু ২৩ মার্চ খুলনা থেকে চালনায় আর কোন গাদাবােট যায়নি। ফলে চাল খালাস বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বন্দরের শুল্ক অফিসাররা কাজ ছেড়ে চলে যান। কাজ বন্ধ করে অন্য কর্মীরাও। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘২৫ মার্চ রাতে বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আমাকে বললেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ, যুদ্ধ বেধেছে। এখানে গানবােট এলে আমরা লড়াই করব পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে।
আমি বললাম- তােমাদের অস্ত্র আছে? পুলিশ অফিসার রাইফেল দেখিয়ে বললেন, এই ত ।
ক্যাপ্টেন ওই খবর বন্দরে নােঙর করা ৩টি জাহাজকে (চীনা, গ্রীক ও ইংল্যান্ডের) জানিয়ে দেন। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করেন না।
ক্যাপ্টেন স্টিভেন্ডরদের সঙ্গে দেখা করেও যুদ্ধ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু নৌবাহিনীর অফিসাররা লাউডস্পিকার দিয়ে বলতে থাকেন, ‘সব স্বাভাবিক, সব স্বাভাবিক। অথচ এর আগে পাইলটরা (সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী) ভয়ে বন্দর ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
৩ এপ্রিল পেট্রল বোেট এল। গান বােট ভেবে হইচই হল তীরের লােকের মধ্যে। পেট্রল বােট থেকে গুলি ছোঁড়া হল তাদের লক্ষ্য করে।
৪ এপ্রিল সকালে এল ডেস্ট্রয়ার দুপুরে পর্যন্ত সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিকালে এই ডেস্ট্রয়ার থেকে প্রচণ্ডভাবে গুলি ছোঁড়া হল এক কিলােমিটার দূরে ছােট শহরের দিকে। অফিসারস কোয়ারটার ছাড়া বাকি বাড়িগুলি তখন দাউ দাউ জ্বলছে। তীর থেকে ডেস্ট্রয়ারের দিকেও গুলিবর্ষণ হতে থাকে, তারা গ্রেনেডও ছোঁড়ে। কিন্তু তা মাঝ নদীতেই পড়ে। তীরে চিৎকার। আগুনের আলােয় দেখলাম লােকজন ছুটে পালাচ্ছে। ওই রাতেই দেখি করাচি থেকে আগত মালবাহী জাহাজ থেকে ডেস্ট্রয়ারের গান বােটে পেটি নামছে। চীনা জাহাজের ক্যাপ্টেন জানালেন, এগুলি অস্ত্রশস্ত্র। তখনও মাঝে মাঝেই বুম বুম শব্দ। কী করব বুঝতে পারছি না। গণ্ডগােল হতে পারে জেনে করাচিতে খবর পাঠিয়েছিলাম হেগেল কোম্পানিকে। তারা কোন উত্তর দেন নি। খুলনা শহর থেকেও কোনাে সাড়া শব্দ নেই। অবস্থা স্বাভাবিক’ সত্ত্বেও সব মাল খালাস না করে ফিরলে আমার কোম্পানিকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। কিন্তু রসদ নেই। কী করে আর থাকব। এদিকে সঙ্গে অফিসার, ক্রু সহ ৪২ জন লােক আমার জাহাজে ।
পাইলট ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে ৫ এপ্রিল চালনা বন্দর ছেড়ে এসেছি। ফিলিপিনের এই জাহাজে এখনও ১,৪০০ মেট্রিক টন জাপানী চাল। কোম্পানির অনুমতি পেলে এখানে ওগুলি খালাস করা হবে।
চট্টগ্রাম থেকে আরও চারটি জাহাজ কলকাতায়
বৃহস্পতিবার-শুক্রবার চট্টগ্রাম থেকে চারটি মালবাহী জাহাজ কলকাতায় এসেছে। জাহাজগুলি চট্টগ্রামে মাল খালাস করতে পারেনি। তারা এখন এখানে শুষ্ক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায়।
সূত্র: আনন্দ বাজার : ৩.৪.১৯৭১