ব্রহ্মপুত্রের যুদ্ধ : প্রতিরক্ষা দুর্গ
সৈনিকদের সকালটাও কম বিচিত্র নয়। রাতে যারা নগর বিছিয়ে বসেছিল, ভাের হতেই তারা সেসব গুটিয়ে ট্রাকে ও লরিতে এসে জমা হল। দুটি দল আগেই মার্চ করে এসেছে। আমরাতাে বিছানায় শুয়ে উঠব উঠব করছি, ততক্ষণে আমাদের ইমারতের সব সৈনিক বিছানাপত্র বেঁধে ট্রাকে চড়ে বসছে।
দিনে বকশীগঞ্জের আসল রূপ দেখা গেল। প্রত্যেক জায়গায় পাকিস্তানীরা বাংকার তৈরী করেছিল। একেবারে নিরেট সিমেন্টের বাংকার। ওপরে ঘাসের আস্তরণ। সামনের বড় বাড়িটাতে ছিল ওদের কার্যালয়। তিন সারি প্রতিরক্ষা দুর্গ ; আর লড়াইয়ের মালমসলার তাে কোন হিসেবই নেই। ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রশস্ত্র মেয়েদের স্কুলবাড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঐ বাড়িটাতে তিনটা বাংকারে গােলাবারুদ ঠেসে ঠেসে ভরে রাখা হয়েছে।
আমরা মেসে যাওয়ার পথে এসব বাংকার দেখতে পাচ্ছি। ওখানে ওরা মেয়েদের আটকে রেখেছিল। ওখানে একটা বড় তক্তাপােষ রাখা হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র তাে আমেরিকা ও চীন তাদের মিত্রকে দিয়েছে। কিন্তু তক্তপােষ দিয়েছে ? “তক্তপােষ বােধহয় ইরান থেকে এসেছে। মেসের নতুন সঙ্গীরা টিপ্পনী কাটল। আর এতেই সবার ইরানী বন্দীদের কথা মনে পড়ে গেল। ওদের সঙ্গে দেখা করাবার জন্য বলবীর সিংহ আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন।
সেই আর্যজাতির দুই রত্নের সঙ্গে মিষ্টি সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে আমাদের দিনের কাজ শুরু হল। ইয়াহিয়া খানের মিত্র আর্য শিরােমনি শাহেনশাহ আর্য মিহিরের এই দুই প্রজার নাম, খুজা দাদ ও খান আলি। ফর্সা রঙ। দুইজনেই আপন ভাই। দুজনেই ব্যান্ডেজ সুশােভিত। বাংলাদেশের অত্যাচারিত গ্রামবাসীদের কাছে ওরা ঐ ক্ষত ও জখম উপহার পেয়েছে। মলম আর ব্যান্ডেজ জুগিয়েছে ভারতীয় সেনার মেডিকেল ইউনিট। গ্রামবাসীরা বলেছে, কামালপুরের যুদ্ধের পর কোনমতে প্রাণ হাতে করে বেরিয়ে এসেও এই দুই ভাই গ্রামবাসীদের ঘরে লুটতরাজ ও ধমকানির অভিযানে বেরিয়েছিল। বড় ভাই রসিকতারও কিছু আভাস দিচ্ছিল। দায়ে কাটা পড়েছিল নাকটা কিন্তু কি করে যেন অর্ধেক নাক বাঁচিয়ে ও বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। পরাজয়ে ওদের কোন দুঃখ ছিল না, প্রাণটা যে বেঁচেছে সেই আনন্দেই খুশী। বড় পুলকিত হয়ে ওরা আমাদের এসব কথা বলছিল।- “আমরা দু’ভাই ইরান থেকে সাত বছর আগে এসে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীতে বহু ইরানবাসী আছে। আট মাস আগে আমাদের বলা হল, পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়ান আর্মি হামলা করেছে- তােমরা যাও। সাহেব, আমরা এসে গেলাম প্রথম এসেছি রাজশাহী, ফির সারা বাঙ্গাল, কখনও এখানে কখনও-বা সেখানে। একমাস ধরে কামালপু আছি।”
“তাে তােমরা পূর্ব পাকিস্তানে আটমাস আগে ইন্ডিয়া আর্মি দেখেছাে?”
“কোথায় সাহেব? আমরা মিথ্যে কথা বলি না। আমরা ধর্মভীরু মুসলমান। এই পরশু আমরা প্রথম ইন্ডিয়া আর্মি দেখলাম। এরা খুব ভাল আর্মি, সাহাব। বহু শরীফ মানুষ। বন্দীদশায় যত আদর যত্ন পাচ্ছি, এমন তাে মুক্ত অবস্থাতেও পাইনি। আমরা সিপাহী আদমী, সাহাব আপনারা বড় সাহেবকে বলুন, আমরা ইন্ডিয়ান আর্মি সেবা করব। সত্যি ওরা খুব শরীফ আদমী।”
পুস্পমালা ও জয়ধ্বনি
সাড়ে সাতটা বেজেছে। ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল পৌঁছবার আগেই আমাদের শেরপুরে পৌঁছনাে জরুরী। জীপ তৈরী। সড়কের দুইধারে নানা স্থানে দাঁড়িয়েছিল প্রত্যেক গ্রামের বুড়ােরা ও বাচ্চা ছেলেরা। আমাদের দেখে তারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলল। জীপ দেখেই ক্ষেত থেকে বাচ্চারা ‘জয় বাংলা’ চিৎকার করে ছুটে এল। মুখে ঝলসে উঠছে খুশীর উল্লাস, সন্তুষ্টি।
শেরপুরের একটু আগে পাকা সড়ক। তিনি দিন থেকে কাঁচা রাস্তায় চলে ফিরে ধুলাে আর ধাক্কা খাচ্ছি। এখন পাকা সড়কে এসে মনে হল যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। জানতে পেরেছি, শেরপুর হয়ে এ রাস্তা ব্রহ্মপুত্রের পার পর্যন্ত চলে গেছে।
বাংলাদেশের মুক্তির চাবিকাঠি রয়েছে ব্রহ্মপুত্রের কাছে, এই শেরপুরে। পূর্ব কমান্ডের সারা রণকৌশল সত্যি বড় কুশলতার সঙ্গে রচনা করা হয়েছে। জেনারেল নাগরা ও ব্রিগেডিয়ার ক্লের খুব সাবধানে এগােচ্ছেন। জেনারেলের বিশ্বাস যে, তিনি ও ক্লেই প্রথমে ঢাকা পৌঁছাবেন।
কিন্তু আমরা যখন শেরপুর পৌঁছলাম দেখলাম অন্য এক খুশীর আবহাওয়া। মুক্ত প্রফুল্ল নাগরিকদের মােরচা। ভারতীয় মিত্রদের স্বাগত জানাতেই তারা আজ এত খুশী। সড়কের ওপর একটা খুব সুন্দর উচু তােরণদ্বার বানান হয়েছে। পাশে মুনসেফকী আদালত। সেখানে আমাদের সৈনিকদের অগ্রগামী দলটি শিবির তৈরী করছে। সামনে শেরপুরের বিরাট ময়দানে লােকেরা সমবেত হয়েছেন। হাজার হাজার লােকরঙ-বেরঙের লুঙ্গি পরা কিশাের যুবক, ঈদের উৎসবের মত জামাকাপড় পরেছে বাচ্চারা, কুর্তা পাজামা পরে, গলায় রুমাল বেঁধে বৃদ্ধ মৌলানা, স্টেনগান হাতে মুক্তিবাহিনীর দল। আশেপাশের গ্রাম থেকে কৃষকরা এসে সড়কে ভিড় করেছে, ভারতীয় সেনাদের প্রত্যেকটি ট্রাক, প্রত্যেকটি জীপকে তারা স্বাগত জানাচ্ছে। ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করে, হাত মেলাচ্ছে তাদের সঙ্গে। নিষেধ করা সত্ত্বেও ওরা পান সিগারেট এনে দিচ্ছে। একধারে পান-বিড়ি, বাদাম, মিষ্টি ও নারকেলের দোকান বসে গেছে। লাউড স্পিকারে মুক্তিবাহিনীর একজন সৈনিক কি যেন বলে যাচ্ছে। – বাংলা বুঝতে চেষ্টা করছি। সে বলছে, “পনেরাে দিন আগেও এখানে পাকিস্তানী সৈন্যদের শাসন বহাল ছিল। সেজন্য আপনারা ঈদ উৎসব পালন করতে পারেন নি। আজ স্বাধীনতার ঈদ-উৎসব। আর কখনাে আমরা কারাে গােলাম হব না। আমাদের ভারতীয় মিত্ররা নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদেরই জন্য এই মুক্তির উৎসব নিয়ে এসেছেন। ওরা শেখ মুজিবকেও নিয়ে আসবেন।” ধ্বনিতে আকাশ অনুরণিত হয়ে উঠল, “জাতির পিতা শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।”
ফুপিয়ে কেঁদে উঠল
হেলিকপ্টার থেকে জেনারেল নামলেন, পেছনে ক্লের। জনতা ওদের ঘিরে ফেলে মালায় মালায় ভরে দিল। বৃদ্ধরা এগিয়ে এসে এই দু’জন যােদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে ওঁদের কল্যাণ কামনা করল। একজন বৃদ্ধ যুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, “ইউ আর আওয়ার ফ্রেন্ড। গ্রেট ফ্রেন্ড।” এখনাে কেঁদে যাচ্ছে সে। লােকেরা তাদের বাচ্চাদের কোলে নিয়ে ওদের দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছে। লাউডস্পিকারে ধ্বনি দিচ্ছে-‘জয় ইন্দিরা, জয় ইন্দিরা।” হঠাৎ নতুন জয়ধ্বনি শােনা গেল- “মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনী জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। ভারতবাংলা-মিত্রবাহিনী জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।” জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন আবদুল আজীজ আর তার সহায়ক এ.এস.ভূঁইয়া।
জেনারেল ভাষণ দিলেন (হিন্দীতে), “বাঙালি ভাইসব। আপনাদের এলাকা আজ দুশমন মুক্ত হয়েছে, আমি খুবই খুশি।” এই কথাগুলির সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনি উচ্চারিত হল। একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, “আপনাদের মুক্তিবাহিনী জয়ী হয়েছে। শ্রীহট্ট ও যশাের মুক্ত হয়েছে। (জয় বাংলা, জয় বাংলা) আমরাও খুব দ্রুত ঢাকা পৌঁছে যাব। (মিত্রবাহিনী-মিত্রবাহিনী, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ)। বাংলাদেশের সরকারকে ভারত ও ভূটান স্বীকৃতি দিয়েছেন। এর সব কৃতিত্ব মুক্তিবাহিনীর বাহাদুর সৈনিকদের। আপনাদের সহায়তায় আমরা একাজ সম্পূর্ণ করতে পারব। আমার সঙ্গে তিনবার বলুন, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা।” ক্যাপ্টেন আব্দুল আজীজ এগিয়ে এসে মাইক হাতে নিয়ে বলে উঠলেন- “জয় হিন্দ”।
লােকেরা হাত উচিয়ে বলল, “জয় হিন্দ”। “ভারত-বাংলা-মৈত্রী জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।” একজন মৌলানা নিজের নাতিকে নিয়ে এসেছে। জেনারেল ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করবেন এই তার আশা। জেনারেল নিজের মালা বাচ্চাটির গলায় পরিয়ে দিয়ে কোলে টেনে নিলেন।
বেশ কয়েক মাস পরে ফুলের মালা ও মিষ্টির দোকানগুলি কাল সারা রাত খােলা ছিল। পেছনে শেরপুর ক্লাবের ইমারতে ভারতীয় অতিথিদের জন্য জলপানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হবার ঠিক একমাস পরে ২৬ শে এপ্রিল পাক-সৈন্যরা এখানে আসে। তখন থেকে কলেজ বন্ধ। চারদিকে তখন হত্যা, লুটতরাজ ও পাশবিক অত্যাচারের ধুম। এমন জায়গা নেই যেখানে অমানুষিক এই তাণ্ডবলীলা হয়নি। বারাে বছরের মেয়েদের উপর অত্যাচার করে শেষে সঙ্গীন দিয়ে তাদের মেরে বাজারের মাঝখানে ফেলে চলে গেছে।
গােপন বার্তা
বলবীর সিংহ আমাকে আলাদা ডেকে বললেন যে, জেনারেল নাগরা ও ব্রিগেডিয়ার ক্লের হেলিকপ্টারে দ্রুত ব্রহ্মপুত্রের তীরে যাচ্ছেন। ঐ জায়গাটা ওরা পরীক্ষা করে পরবর্তী রণকৌশল রচনা করবেন। তাড়াতাড়ি কথাবার্তার পাট চুকিয়ে আমরা যেন জীপে করে এখুনি রওনা হই। ব্রহ্মপুত্র এখান থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। জেনারেলের কড়া নির্দেশ, ব্রহ্মপুত্রের দু’মাইল এদিকে আমাদের যে ঘাটি আছে আমরা যেন সেখানে জেনারেলের জন্য অপেক্ষা করি। গােলাবারুদ দু’দিক থেকেই চলছে। ওখানে থাকতে থাকতেই যদি গােলাবারুদ চালু হয়ে যায় তবে জীপটাকে যেন খােলা রাস্তায় না রাখি।
এখন আমাদের জীপ খুব স্পীডে পাকা-সড়কের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। হঠাৎ উড়ােজাহাজের আওয়াজ এল। আমাদের দুটো বােমারু বিমান জামালপুরের দিকে যাচ্ছে। রাতে শত্রুপক্ষের ওয়ারলেসে গােপন বার্তা ধরা পড়ল। পাক-সৈন্যধ্যক্ষ নিয়াজী জামালপুরের কমান্ডার সুলতান আহমদেক নির্দেশ দিচ্ছেন। শুধু জামালপুরকে রক্ষা করলেই চলবে না। কামালপুর, বক্সীগঞ্জ, শেরপুর আর অন্য জায়গা থেকে যে-সব সৈন্য পিছু হটে গেছে তাদের একত্র করে সম্ভব হয়তাে ব্রহ্মপুত্রের এপারে ভারতীয় সৈন্যদের ওপর হামলা কর। তাদের ঘিরে ফেল। তাদের যেন কোন প্রকারে ব্রহ্মপুত্রের এই তীরে আসতে না দেওয়া হয়। আমাদের কমান্ডার বিমানবাহিনীর সাহায্য চেয়েছেন। তাদের বলা হয়েছে দিনের বেলায় আমাদের বােমারু বিমানগুলি জামালপুরে ওদের সদর শিবির, অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটি আর ছাওনীর ওপর যেন চারক্ষেপ বােমাবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে বিমান থেকে বােমাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। আমাদের বােমারু বিমান উড়ে গিয়ে জামালপুরে চক্কর দিচ্ছে। ওখানে থেকে ওদের গােলন্দাজবাহিনী গর্জে উঠল। আমাদের বিমান চিলের মত ঝাপট মারছে। দুটি ভয়ানক বিস্ফোরণে আওয়াজ শােনা গেল। অনেক দূর পর্যন্ত কেঁপে উঠল গ্রাম, ক্ষেত, রাস্তা। আধ মিনিট পরে আরাে দু-দুবার বিস্ফোরণ শােনা গেল। তারপর আমাদের বিমানগুলি যথাস্থানে ফিরে গেল। পাঁচ মিনিট পরে পাকিস্তানের গােলন্দাজবাহিনীর গর্জন শােনা গেল। জীপ থেকে নেমে পড়লাম। কিন্তু ভারতীয় সৈনিকরা আমাদের বললেন, এখন আমরা এগিয়ে যেতে পারি। ভারতীয় সৈন্যের যে দলটি রাতের অন্ধকারে বক্সীগঞ্জের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে নদী পার হয়ে জামালপুরের বাঁ দিকে প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করে বসে আছে- পাকিস্তানের গােলন্দাজবাহিনীর তােপ তাদের দিকেই তাক করছে। “আচ্ছা, তবে আমাদের সৈন্যরা ওদের ঘিরে ফেলছে?” “হ্যা, জেনারেলের হুকুম যে, ওদের পালাবার ও ঢাকা পৌঁছবার সব পথ বন্ধ করে দাও। যদি ওরা পালিয়ে যেতে পারে ঢাকা যাবার পথ ধ্বংস করতে করতে যাবে।” জামালপুরের বিশাল শত্রু সৈন্যদলের মাঝখানে আমাদের একটা ছােট্ট দল গিয়ে কি ভয়ানক বিপদের মুখে পড়বে, তা কল্পনা করে শিউরে উঠলাম ভারতীয় সৈন্যরা কি বস্তুতে তৈরী।
পালিয়ে বেঁচেছে
জেনারেলের হেলিকপ্টার এদিকে এসে নামল। নামলেন জেনারেল নাগরা ও ব্রিগেডিয়ার ক্লের। জেনারেলের নির্দেশ আমরা যেন রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলি, দলবদ্ধ হয়ে নয়। রাস্তার এদিক ওদিকে যেন এক পাও না যাই, কারণ মাইন বিছানাে। জেনারেলের সঙ্গে সঙ্গে একটা ওয়ারলেস অপারেটার চলছে। তিনি ওয়ারলেসে অনবরত নির্দেশ পাঠাচ্ছেন। রাস্তার দুই ধারে দু’জন সৈনিক মাইন-নিরীক্ষণ ঘড়ি হাতে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। বিপদ আছে নিশ্চয় তবে কয়েক ফার্লং পর্যন্ত নয়।
ব্রহ্মপুত্র এখন দেখা যাচ্ছে। ওপারে নদীর কিনারায় মাইলের পর মাইল জুড়ে জামালপুর। উত্তরে ঢাকার প্রতিরক্ষা লাইনের প্রথম দুর্ভেদ্য সৈন্য-শিবির। আমি বলবীর সিংহের কাছ থেকে দূরবীনটা চেয়ে নিয়ে দেখতে লাগলাম। ক্লের বারণ করলেন, ওদিকে বাংকারের ভেতর পরিখার বসে দেখা ঠিক হবে। এখন বালু বিছানাে পথ, কাঁটা ঝােপঝাড়। বালির ওপর ওরা একটা বড় শিবির তৈরী করেছিল। তিনটি সুগভীর ট্রেঞ্চ, মাঝে মাঝে ও প্রত্যেক কোণে বাংকার। এই বাংকারে অনেক অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে। বাংকারে একটা ট্রানজিসটার, অন্য একটায় ভাঙ্গা চুড়ি ও মহিলাদের কয়েকটি কাপড়। মেশিনগান তােপের খালি বাক্স এখনও এদিক ওদিক ছড়িয়ে। রাত্রিবেলা পর্যন্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা এখানে জমিয়ে বসে ছিল । মধ্যরাত্রিতে পালিয়ে বেঁচেছে।
মেজর বামীর হাতে রয়েছে প্লাস্টিক কভারে আঁটা খুব বড় একটা মানচিত্র। মাটিতে তা বিছানাে হল। পরিখার ভেতর দাঁড়িয়ে জেনারেল ক্লের, বেরী আর অন্য সব অফিসার। সবাই মানচিত্র রেখে রণক্ষেত্রের পরবর্তী নীতি রচনা করছেন। মাঝে মাঝে ওয়ারলেসে খবর আসছে, নির্দেশ পাঠান হচ্ছে। একটা খবর এল আর ক্লের রিসিভারের মুখটা জেনারেলের কানের কাছে এগিয়ে দিলেন। জেনারেলের চেহারায় খুশীর ঢেউ খেলে গেল। জেনারেল দূরবীনটা নিয়ে পরিখা ও বালির ঢিবির উপর থেকে জামালপুরের একটা অঞ্চল পরীক্ষা করে দেখলেন। এবার মেজর বামী নিজেই ওয়ারলেসটা হাতে তুলে নিলেন। ওদিক থেকে কিছু একটা খবর এল। মেজর বামী প্রথম ক্লেরকে ডেকে খবর দিলেন, পরে জেনারেলকে ডাকা হল। জেনারেল প্রথমে পরামর্শ করলেন এবং নির্দেশ পাঠালেন “শােন, একটা তৈরী ট্রেন দাঁড় করান দেখা যাচ্ছে। ওদের সৈন্যরা ট্রেনের ভেতর কিসব বােঝাই করছে। এটা যদি সত্য হয়, তবে ট্রেনটাকে আটকাও। ট্রেনটার ভেঙ্গো না, গাছগাছড়া কেটে রাস্তায় ফেলে রাখ। “কি একটা খবর জেনারেল খুব মন দিয়ে শুনলেন, “আমাদের জওয়ানরা ব্রহ্মপুত্রের তীরে পৌঁছে গেছে শুনে আমি খুব খুশী হয়েছি। আমার ছেলেরা খুবই বাহাদুর।”
ওদিকে জামালপুর একেবারে নিঝুম। মানুষ তাে কোন ছার, রাস্তায় ঘাটের কিনারে একটা চড়ুই পাখী পর্যন্ত নজরে পড়ছে না। ওখান থেকে জামালপুরের ঘাট সবচেয়ে কাছে,” জেনারেল বললেন, এখানে নদী বাঁক নিয়েছে।
জামালপুর নিশ্চল, নিথর
জেনারেল জায়গাটা নিজে দেখতে চাইলেন। প্লেনের আওয়াজ আবার শােনা গেল। এখন তবে অন্য শহর। আমাদের উপর দিয়ে আমাদেরই বােমারু বিমান উড়ে যাচ্ছে। দু’চারবার তীব্র বেগে ছোঁ মেরে আবার চুপ করে গেল। জামালপুরের এক জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। পাকিস্তানের গােলন্দাজবাহিনী একেবারে চুপ মেরে গেছে।
পরিখা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলাম। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি না। মুক্তিবাহিনীর লিয়াজো অফিসার এখন আমাদের সবাইকে সড়ক পেরিয়ে ক্ষেতে নিয়ে গেলেন। ঝােপ-আড়ালের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। বারবার আমরা দূরবীন দিয়ে দেখছি। জামালপুর নিশ্চল, নিথর। ক্ষেত পেরিয়ে একটা গ্রাম। চারদিকে সবুজ, গাছপালা, ফুলের সমারােহ। আমরা গ্রামে পৌঁছে অল্পক্ষণের জন্য দাঁড়ালাম। ইউসুফ গ্রামের লােকেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। ক্ষেত পেরিয়ে এলাম। বালির স্তর হালকা হয়ে এসেছে। পায়ের সাথে সাথে বালি উড়ছে। এদিকের পার খুব উচু। নদী মাত্র ৫০০ গজ চওড়া। ওদিকে জামালপুরের তীরও বেশ নীচু। ঘাট পর্যন্ত সড়ক চলে গেছে। জামালপুরের ঘাটের কাছে একটা বেসরকারী বাসের চাকা পাংচার হয়ে পড়ে আছে। আমাদের দিকে একটা জায়গায় পাকা কনক্রিটের জেটি। নীচের দিকে বালি গড়িয়ে পড়ছে। বাইরের দিকের জেটির একটা অংশ ভাঙ্গা। কয়েকটা খুঁটির ওপর ভর দিয়ে ঝুলছে। সামনে ব্রহ্মপুত্রের জলে বাঁশ পুঁতে একটা মাচা করা হয়েছে। এখানে মাছের জাল শুকতে দেয়। এই জেটির পাশে বাঁশের মাচার পেছন দিকে দাঁড়িয়ে জেনারেল আর তাঁর সহযােগীরা জায়গাটাকে পরীক্ষা করছেন। এটা জামালপুরের জলের ট্যাঙ্ক, ওটা রেডিও টাওয়ার। এই তাে এখানে চারতলা উঁচু লাল রঙের বেসরকারী ইমারত। ওটা কলেজের পেছন দিক। বলবীর সিংহের দূরবীন হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। কেউ বলে উঠল, “ঐ দেখুন ঘাটে একটা জীপ এসেছে। ঐ দেখুন আবার ব্যাক করে বাসের আড়ালে চলে গেল। আবার সব চুপচাপ। এক মিনিট আশ্চর্য নীরবতা। ব্রিগেডিয়ার ক্লের নীরবতা ভাঙ্গলেন। জেনারেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “কাজ যখন হয়ে গেছে, চলুন এখন ফেরা যাক।”
গুড়িয়ে যাবেন
আমরা ফিরবার কথা ভাবছি এমন সময় “সু… সু … সু … সিক” । আমাদের মাঝখান দিয়ে কি যেন একটু ফেটে বেরিয়ে পাশের বালির ভেতর ঢুকে পড়ল। বালির ধূলা উড়ল। এক মুহূর্তে ব্রিগেডিয়ার ক্লের মাটিতে শুয়ে পড়লেন। নিজের পাশে জেনারেলকে টেনে নিলেন- “লাই ডাউন। শত্রুরা গুলী ছুঁড়ছে”। কথা শেষ করতে পারলেন না। আমরা শুয়ে পড়ার আগেই আবার শব্দ “সু … সিক”। অনর্গল গুলির আঁক পড়তে লাগল। আমার সামনে এক মুহুর্তের জন্য গভীর অন্ধকার তার ডানা বিছিয়ে দিল। লাল লাল আগুন উড়তে দেখলাম। হয়তাে ভয় .. বিভীষিকা … কি জানি ! সঙ্গে দু’জন বিদেশী ফটোগ্রাফার কনক্রিটের ফলকের নীচে মাথা গুঁজে আছেন। তার পেছনে বাইরের দিকে জেনারেল নাগরা। আর এদিকে একেবারে খােলা জায়গায় আমি। ওসব সা-সা-আওয়াজ করা জিনিষগুলাে ঠিক আমাদের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে ঠিক ৫ গজ, ৬ গজ দূরে এসে পড়ছে। হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানি সব যেন বন্ধ হয়ে গেছে। ক্লের যেন কিছু বললেন কিন্তু আমরা শুধু একটা আওয়াজেই শুনছি- “সু … সু … সু সিক”। এখন শুনতে পারছি। একটু যেন চেতনা ফিরে এসেছে। কোথায় আছে বালকৃষ্ণ, ব্রিগেডিয়ার বেরী, ক্যাপ্টেন ভাটনগর, আমি ঘাড় ফেরালাম। জেনারেল কেমন যেন কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “নড়াচড়া করবেন না, গুড়িয়ে যাবেন। ওরা রিকয়েললেস গান ব্যবহার করছে। আমার জিভ শুকিয়ে কাঠ, গলায় কি যেন আটকে গেছে। যতদূর মনে পড়ে রিকয়েললেস গানের কথা শুনে আমি জোর করে হেসে বললাম, “ওরা কি আমাদের ট্যাঙ্ক ঠাওরেছে নাকি? কিন্তু শব্দুগলি বােধহয় কাঁপছে। তবু না বলে তাে মনটাও হালকা হয় না। একে বরে অচৈতন্য আমরা এবার জেগে উঠেছি। আমি দেখতে পাচ্ছি ব্রহ্মপুত্রের শান্ত জল, ঝকঝকে রােদ। প্রত্যেক ১০ সেকেণ্ড পরে পরে বুঝতে পারছি আমাদের খুব কাছে ওদের নিশানা। মুক্তিবাহিনীর একজন সৈনিক হঠাৎ পিছন থেকে উঠে পড়ল। ভয় পেয়ে যেমন টিকটিকি পালায় তেমনি একদিকে ওর হাত পা অন্য দিকে, সে নদীর কিনারে এল। গুড়িসুড়ি মেরে বালির পথ দিয়ে দৌড়াল। পিছলে নেমে গেল সােজা নদীতে। গুড় গুড় গুড়ম- একটা গুলী ঠিক ওর পাশে নদীতে গিয়ে পড়ল। আবার উঠে দৌড়াল। তারপর কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। “ওরা মর্টারও চালাতে শুরু করেছে,” ক্লের বললেন। জেনারেল নাগরা আর ব্রিগেডিয়ার ক্লের অনড় শুয়ে আছেন। শত্রুপক্ষরা গুলি চালাবার কি কলাকৌশল ব্যবহার করছে, দু’জনে হেসে হেসে সেসব কথাই বলছেন। আমাদের যােদ্ধাদের কি অসম্ভব আত্মবল, বিচিত্র আত্মশক্তি। মর্টারের গুলি আমার ঠিক নীচে জলে গিয়ে পড়ল। অল্প একটু ভিজে গেলাম। ফরাসী ক্যামেরাম্যান মার্ক রিবু কনক্রিটের ফলকের ভেতর থেকে আমার নাম ধরে চিৎকার করে কি যেন সব বললেন। মর্টারের বিস্ফোরণে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। কে যেন হাত বাড়িয়ে আমার গলার কাছে রাখা একটা রঙিন ঝােলা টেনে ভেতরের দিকে ছুঁড়ে ফেলল। ক্লের ঈশারায় জানালেন মাটির সঙ্গে যেন সেঁটে থাকি। জেনারেল নিজের হ্যাট খুলে ভেতরের দিকে ছুঁড়ে ফেললেন। কে যেন শুয়ে শুয়েই আমার উপর বালি ছড়িয়ে দিতে লাগল। নাক, কান, ঠোট, গলা, সব বালিতে ভরে গেল। পরে বুঝতে পারলাম যে জেনারেল ও তার ডান দিকে আমি, একেবারে উন্মুক্ত জায়গায়। জেনারেলের হ্যাটের লাল পট্টিতে, আমার গায়ের হলুদ রঙের জামায়, নীল ঝােলার উপর রােদ লেগে চকচক করছিল। ওরা ওগুলাে তাক করেই লক্ষ্য স্থির করছিল।
আমার ঠিক পিছন দিক থেকে এক ঝাঁক গুলি পড়ল। প্রথমে ভাবলাম শত্রুপক্ষরা আমাদের পেছন দিকও ঘেরাও করেছে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার বেরী চিৎকার করে যা বললেন তাতে বুঝতে পারলাম,- বলবীর সিংহ নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে হাঁটু গেড়ে ক্ষেতের আলের নীচে বসে বন্দুক চালাচ্ছে। বলবীর সিংহের বন্দুকের ইশারায় এদিক থেকে আমাদের গােলন্দাজবাহিনী গােলা বর্ষণ করতে লাগল। হয়তাে আমাদের গােলন্দাজবাহিনীর গােলাগুলির মুখােমুখি হয়ে আধ মিনিটের মধ্যে ওরা মর্টার ও রিকয়েললেস গানের পজিসন বদলাতে বাধ্য হল। কারণ ততক্ষণে ওদের গােলাগুলি স্তব্ধ হয়ে গেছে। “মাটির বুকে ঘষটাতে ঘষটাতে ফিরে চলুন।” আমরা ছুটে চললাম।
দম যেন ফুরিয়ে গেছে। মুখে অল্প অল্প রক্ত, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ, চারদিকে যেন ধুয়াে দেখছি। শরীরের রক্তের উৰ্দ্ধগতি তাে আছেই তারপরে আবার চোখের পাতায় ভরা বালি। কেমন যেন ঘাের লেগে গেল। ঠাহর হল না কখন কোন দিক থেকে গােলাগুলি চলছে। অনবরত উঠছি আর শুয়ে পড়ছি। উঠছি আবার দৌড়চ্ছি। সেও আবার বালুর পথে, উচু নীচু ক্ষেতে। গ্রাম এখনও কতদূরে? দেখে তাে মনে হচ্ছে কত কাছে গ্রাম, অথচ জানি প্রত্যেক ক্ষেত পেরিয়ে পৌঁছতে চার চারবার গােলাগুলির মুখােমুখি হতে হবে।
গ্রামে পৌঁছিয়ে একেবারে যেন দম বন্ধ হয়ে এল। ধুকছি, বার বার পড়ে পড়ে যাচ্ছি। গােলাগুলি তখনও চালু। কোথা থেকে যেন ওরা আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। কারণ ওদের গােলাগুলি এখন গ্রামে এসে পড়ছে। একটু বেড়ার আড়াল- তা সে কলার ঝাড় বা খড়ের ছাওনী হােক, কত না সাহস বাড়িয়ে দেয়। গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য। গােলাবারুদ চলা সত্ত্বেও ওরা সবাই গ্রামেই রয়েছে। দু’জন লােক তাড়াতাড়ি করে বালতিতে জল ভরে নিয়ে এল। পাঁচ ছটি লোেক তিনটে খাট নিয়ে এসে হাজির, তাতে বিছিয়ে দিল চাদর। দেখলাম মহিলা ও বৃদ্ধরা আসন বিছিয়ে অঞ্জলি ভরে খােদার কাছে দোয়া ভিক্ষা করল, প্রার্থনা করল আমরা যেন বেঁচে যাই। যদি আহত হই তবে তাে আমাদের শেরপুর নিয়ে যেতে হবে। তাই কয়েকজন যুবক প্রস্তুত। আমার এই হুঁস এল। চারদিকে তাকিয়ে হিসাব নিলাম সবাই ফিরে এসেছে কিনা। একে অন্যকে গুনছে। ওরা এখন গ্রামের উপর খুব জোর গােলাবারুদ ছুঁড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নিলাম। জল দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম, জল খেলাম না। কারণ: জল খেলে ছুটতে পারব না। এখনও দেড়মাইল ক্ষেতের পথ। তারপর চৌকি।
আমার মৃত্যু যাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হল। আমরা ক্ষেতের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলতে লাগলাম। মর্টার ও রিকয়েললেসের বদলে ওরা এখন মিডিয়াম মেশিনগান চালাচ্ছে। এখন আমরা আর মাটিতে শুয়ে পড়ছি না, খুব সাবধানে এগােচ্ছি। জীপের কাছে, গােলন্দাজ বাহিনীর কাছে যখন পৌঁছলাম, তখন আমাদের পা ভারী, জহ্বা শক্ত কাঠ, পা ওঠাতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, ককিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে।
মৃত্যুর লীলাখেলা
এখন আমরা আমাদের ঘাটিতে। আমাদের কাছে পেয়ে চৌকির লােকেরা মহা খুশী। এটাও কম বিপদজনক পরিস্থিতি নয়, কোন বেড়ার আড়াল নেই, পরিষ্কার ময়দানে এক একজনকে ওরা চিনে নিতে পারে। ব্রিগেডিয়ার বেরী এখন নিজের পা পরীক্ষা করে দেখছেন। বেশ খানিকটা ছড়ে গেছে, তবে তেমন কিছু না। সবাই নিজের নিজের অবস্থা বলতে লাগলাম। বালকৃষ্ণের একটা ফিল্ম নষ্ট হয়ে গেছে। ও ক্যামেরা খুলে রােল বদলাচ্ছিল হঠাৎ গােলাগুলি শুরু। ওর চশমা ছুটে বেরিয়ে গেল। আমার চকমকে রঙিন কামিজ নিয়ে সবাই খুব টিপ্পনী কাটতে লাগল।
এই ঘটনার স্ট্রাটেজী ও টেকনিক নিয়ে আমরা সবাই হালকা খােশগল্প শুরু করে দিলাম। সৈনিকদের জীবন কত না বিচিত্র। জীবন ও মৃত্যুর লীলা খেলা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে করতে ওরা হৃদয় উজাড় করে হাসছে। ব্রিগেডিয়ার বেরী দূরবীণ ছাড়াই দেখতে পেয়েছিলেন রিকয়েললেস গানে সজ্জিত জীপ এসে বাসের পেছনে দাঁড়িয়েছিল, আবার ব্যাক করে চলে গেছে। বাসের আড়াল থেকে ওরা গােলাগুলি ছুঁড়ছিল।
জেনারেল নাগরা মানচিত্র দেখছিলেন মাথা তুলে বললেন, “ওহে ভাইসব, কালপরশুর মধ্যে জামালপুর দখল করে নেব। যারা গুলি চালাচ্ছিল তখন তাদের স্বাগত জানিও।”
“স্বাগত কি স্যার? এঁকে বলুন না। ওঁর জামাটা দেখেই ওরা লক্ষ্যস্থল ঠিক করছিল, ওঁকে বললে উনি কামিজটাই খুলে দিয়ে দেবেন, “বর্মা আবার ঠাট্টায় মেতে উঠল।
জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার বেরী, মেজর বামী, বর্মা সবাই চলে গেছেন। হেলিকপ্টার ফেরৎ নিয়ে যেতে হবে। ওদের গােলাগুলি আমাদের জীপেই শুধু হয়, হেলিকপ্টারের পাশেও পড়েছে। আমাদের জীপটাকে বেড়ার আড়ালে দাঁড় করান হয়েছিল। দূরে গ্রামবাসীদের দুটি ঝােপঝাড়ে প্রচুর তক্তা ও খড়ের গাদা পড়ে আছে। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও আমরা শুধু রয়েছি। খাবার তৈরী হচ্ছে ; খাওয়া দাওয়া সেরে শেরপুর যাব। ক্লের আহত পা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে খাটের ওপর শুয়ে পড়েছেন। আমিও খুব ক্লান্ত, আমার পা চলবে না। আমি খড়ের গাদার ওপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি শীতের রােদ আমাকে চুম্বন করে যাচ্ছে। রােদে শুয়ে থাকতে মনােরম লাগছে। ঝােপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে একজন কৃষক ধান শুকিয়ে ভেতরে রাখছে। কত শান্ত, কত নিশ্চিন্ত গােলাবারুদ ও যুদ্ধের কোন প্রভাবই যেন পড়েনি।
আঁচল বিছিয়ে
ক্ষেতে শীতের রােদুর তার আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। ধান পেকে সােনার রঙে রঙিন। আলের পাশে ধীরমন্থর গতিতে চলছে সারস পাখী। একটু আগে এখানেই মৃত্যুর নাচ দেখছিলাম। এখন কত শান্তি ; যুদ্ধ ও আলাে-ছায়ার বিচিত্র খেলা।
শেরপুর পৌঁছলে ওদের গােলাগুলি ও আমাদের গােলন্দাজ বাহিনীর প্রতি আক্রমণের বিষয়েই কথাবার্তা হতে লাগল সবাই আমাদের কথা জানতে আসছে, স্বাগত জানাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর বাহাদুর ক্যাপ্টেন হলাল পান্না আর এ. এস ভুইয়া ময়দানে টেনে নিয়ে গেলেন, “আপনি বাহাদুর সাংবাদিক আপনার সঙ্গে একটা ছবি তােলা দরকার।” আমি ওর সঙ্গে মাটিতে বসে পড়লাম। কাগজের ঠোঙ্গায় ডাল মুড়ি ভাজা সবাই বেশ মজা করে খেতে লাগলাম। হলার পান্না নিজের ইউনিটের জওয়ানদের গােলাগুলি ছোড়ার কাহিনী শােনাতে লাগলেন।
বুঝতে পারছি আমরা সত্যি খুব ক্লান্ত। কিন্তু আরাম করবটা কোথায়? আমাদের জিনিষপত্র, বিছানা তাে সব বক্সীগঞ্জে। কিন্তু মেজর রাজ্যপাল জানালেন যে আমাদের সব জিনিসপত্র শেরপুর এসে গেছে।
শুয়ে পড়ার আগে আমাদের স্বাগত জানাতে শেরপুরের সন্ত্রান্ত নাগরিকদের একটি দল এলেন। লণ্ঠনের ম্লান আলােয় কথাবার্তা হচ্ছে। ওঁরা বললেন যে, “ইন্ডিয়ান আর্মির বিজয়ের জন্য আমরা আল্লার কাছে অনেক দোয়া চেয়েছি।” এদের কৃতজ্ঞতা এদের প্রতি ভালবাসার সত্যি কোন তুলনা নেই।
আমাদের সৈন্যদের অতিথি-সকারেরও তুলনা হয় না। ঐ দেখুন ডাকতে এসেছে। মেজর ওয়াদোয়া নিজের ঘরে আমাদের এ্যাডভেঞ্চারের খুশীতে ডিনার দিচ্ছেন। দশটা বেজে গেছে। আমাদের চোখের পাতা প্রায় লেগে এসেছিল। কিন্তু হাসিখুশী, খােলামেলা এই তরুণ মেজরের সুমিষ্ট ব্যবহারে চোখের নিদ্রা সব ঘুচে গেল ।
এক লায়লা মেশিনগানওয়ালী
“হুজুর এই গানবােট আপনাদের জন্যই বিশেষ করে আনানাে হয়েছে, খুরশীদ আমার হাত ধরে স্টীমারে নিয়ে যেতে যেতে বললেন।
এই গানবােটের নাম বঙ্গশক্তি। সব জঙ্গী-নৌকার নামই খুব কাব্যিক বঙ্গব’, ‘বঙ্গধারা, বঙ্গবামা’। এগুলি সবই পাকিস্তান নৌবহরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের এই বঙ্গশক্তির পাকিস্তানী নাম ছিল ‘লায়লা।
ইঞ্জিন চালু হল। বঙ্গশক্তি’ ঢেউ কেটে এগিয়ে চলল। মেশিনগানে গােলাবারুদ চড়ান হল- দুজন সৈনিক সতর্ক পাহারায় বসল। মেশিনগানের ঠিক আগে উক্ত ডেকের ওপরে আমরা বসেছি। ইছামতীর নিরন্তর ঢেউ দেখছি। ঢেউয়ের নাচন দেখে মজা পাচ্ছি। দূরে সবুজ গাছগাছড়ার ভেতর একটা লাল ইমারত দেখা যাচ্ছে। ওখানেই দেবঘাট। খাড়াঘাট, নদীর পার বেশ উঁচু; চারপাশে কালাে থিকথিকে কাদা, ভ্যাপসা গন্ধ, দুটো খেজুরগাছের গুড়ি কেটে কাদায় ফেলে সিঁড়ি বানানাে হয়েছে। তবুও নামা খুব মুশকিল। শেষে একটা লম্বা কাঁচা বাঁশ কেটে আনা হল। আমরা সেটাকে ধর, কখনও বা ভর দিয়ে কোন মতে নামলাম।
এখান থেকে জীপে করে আমাদের কালিগঞ্জ যেতে হবে। জীপ চলেছে আর শত শত সৈনিকরা আঁকাবাকা সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের গার্ড অফ অনার জানাচ্ছে। কয়েক জন গ্রামবাসী লটবহর সঙ্গে নিয়ে হেঁটে চলেছে, তাদের ক্লান্ত অবসন্ন দেখাচ্ছে। এরা কি শরণার্থী নাকি? দেবভাটা থেকে ১২ মাইল দূরে এদের গ্রাম। পাঁচটি পরিবার। দুটি পরিবার হিন্দু, তিনটি মুসলমান। একজন হিন্দু বৃদ্ধা চলতে অক্ষম। হিন্দু-মুসলমান যুবক পালা করে তাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। এখন ফসল তােলার সময়। পাকিস্তানীরা হয়তাে এই ফসল জ্বালাতে পারেনি, তাই এরা ফসল কাটতে যাচ্ছে।
সাখীপুর আর পারুলিয়ায় যুদ্ধ এক ভয়ানক ক্ষত রেখে গেছে। সড়কের দুধারে বাংকার, ছােট ছােট কেল্লার মতই ধরুন। দুটো বাড়ির ছাদে ইট গেঁথে গেঁথে পাকিস্তানীরা বাংকার বানিয়েছে। উদ্দেশ্য, এই সেতুটাকে রক্ষা করা। উপরন্তু সেতুর নিচে দুধারে ওরা বাঁশ দিয়ে তিন তিনটি বেড়া দিয়েছে, আর তাতে বসিয়েছে মাইন। রাতবিরেতে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে কেউ যাতে অতর্কিতে সেতুতে না আসতে পারে তার জন্যই এত ব্যবস্থা। কালিগঞ্জ থেকে পিছু হটে সাতক্ষীরা যাবার পথে ওরা এখানে আর একবার ঘাটি বেঁধে রুখে দাঁড়াবার শেষ চেষ্টা করেছিল। ওদের ছিল পুরাে এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য। সঙ্গে ছিল পঁচিশ পাউণ্ড মুক্তির কামান, রিকয়েললেস গান, ছােট ছােট চাকা বসান অনেক চীনা কামান। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর নিরন্তর আক্রমণের মােকাবিলা করতে না পেরে ওরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পিছু হটার সময় ওরা কেরাসিন তেল ছিটিয়ে আর ডিনামাইট ফাটিয়ে সেতুটা উড়িয়ে দেয়। ওখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা ইটখােলার কাছে রিখা খুঁড়ে ওরা তাক করে বসে আছে। পারুলিয়া সেতুর দুপারে দোকানগুলিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। অবশ্য মাঝে মাঝেই ওদের গােলাগুলি ধারে কাছে এসে পড়ছে। সেতুর নীচে কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুর ঘােরাফেরা করছে। জানতে পারলাম এই পারুলিয়া খালের পাশে আর একটা বীভৎস ঘটনা ঘটেছিল। এপ্রিল মাসে আশেপাশের গ্রাম থেকে প্রায় দু’তিনশ হিন্দু-মুসলমান শরণার্থী প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছিল। তারা পাক সৈন্যদের দেখে ভড়কে গিয়ে এই খালের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। রাত্রিবেলা পাকসৈন্যরা চুপচাপ ছাউনী থেকে বেরিয়ে এসে এদের ঘিরে ফেলে আর পাইকারী হারে গুলি করে শেষ করে দেয়।
সংহারলীলা
আর এই সংহারলীলা শুরু হয়েছিল উর্দুভাষাকে কেন্দ্র করে। পাকসৈন্য মফঃস্বল শহরটিতে ঢুকেই হুকুম জারী করল সব সাইনবোের্ড উর্দুতে লিখতে হবে। কি কে লিখবে? লিখতে তাে কেউ জানে না। দ্বিতীয় দিন ওরা সাতজন দোকানীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করল। ওদের সন্দেহ হয়েছিল যে এরা বাংলায় কিসব লিখে মুক্তিবাহিনীর কাছে সংকেত পাঠায়। মফঃস্বল শহরটির লােকেরা এত ঘাবড়ে গেল যে, চাঁদা উঠিয়ে ওরা সাতক্ষীরা থেকে একজন উর্দু-জানা সাইনবাের্ড লিখিয়েকে ডেকে নিয়ে এসে সাইনবাের্ড বদলালাে।
জীপ দ্রুতবেগে চলেছে- পেছনে ফেলে যাচ্ছে ইতঃস্তত দোকানপাট ও বাড়ীঘর । কালীগঞ্জ এসে গেল। যমুনার কিনারে অবস্থিত এই শহর আজ যুদ্ধ বিধ্বস্ত। তবুও এখানে খুশীর মেলা বসে গেছে। না জানি আগে এখানে কতটা খুশীর মেজাজ ছিল। ঝােপঝাড়ে খড়ের চালাঘর বা টিনের তৈরী ছােট ছােট দোকানপাটের সারি, নদীর দুধারে লম্বা লম্বা গুদাম, জিনিষপত্র ওঠাতে নামাতে সুবিধার জন্য বাঁশ ও লােহার তৈরী ছােট ছােট মাচা। কয়েকটি একতলা আবার কয়েকটি দোতলা পাকা দালান আর তার মাঝে মাঝে ক্ষেত, বাঁশের ঝাড়, কলাগাছের সারি ছড়ান-ছিটানাে। যুদ্ধের আগে এটা খুলনা জেলার খুব বড় নদী বন্দর ছিল। এখান থেকে পাট বােঝাই করে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হত এবং চালনা বন্দর থেকে আমদানী করা মালপত্র ভরে সােজা কালিগঞ্জে আসত।
সত্যি হুদা ঠিকই বলেছিলেন, এই শহর বাংকারের শহর। প্রত্যেক গলিতে বাংকার, নদীর কিনারে বাংকারের সারি, প্রত্যেক সরকারী ইমারতে বাংকারের ঝাক। আর গুলির নিশানা নেই এমন দেওয়াল নেই বললেই চলে। আর এটা কি? নারকেল গাছের মাঝখানে একটা খুব বড় আকারের মাটির স্তুপ। জানতে পারলাম এখানে লাশ পাকৃত হয়ে পড়ে ছিল। গর্ত খোঁড়া হয়নি। চারপাশ থেকে ট্রাকে করে মাটি নিয়ে এসে লাশগুলির ওপরে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। এও আবার এইজন্যে যে, পাকিস্তানীদের এই দুর্গন্ধ ঠিক সহ্য হচ্ছিল না। জানা গেল। জানা গেল এটা নরহত্যার এক ভয়ানক বীভৎস জায়গা। হাসপাতালের পাশে এখনও কত লাশ পড়ে রয়েছে, পচে গলে গেছে।
পরে একজন একটা সেতু দেখাল, যেখানে ছােট্ট একটা বাধ আছে। এই সেই পুল যেখানে রাজাকাররা লােকেদের মেরে জলে ফেলে দিত। ডাক বাংলার চৌকিদারের নাম মহম্মদ লালু, মরবার আগে লােকেদের পেট চিরে ফেলত যাতে পেটে জল ভরে লাশ জলে ভেসে না ওঠে। রােগা পাতলা, কুৎসিৎ চেহারা। মাসখানেক আগে মুক্তি বাহিনী একে ধরে ফেলেছে। সে নিজের মা-বাপের নাম নিয়ে বাচ্চাদের মত হাউ হাউ করে কাঁদছিল।
সন্ধ্যা নেমে এল। হত্যার একটা বিভীষিকা চারিদিকে ছেয়ে গেল। বাঁশঝাড়ের মাথায় সূর্য যেন আটকে গেল, সিন্দুরের রঙ নয়, গাঢ় রক্তের রঙ। এত ভয়াবহ সূর্য আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। যখন পেছনে ফিরলাম। আরও একটা ভয়ঙ্কর জিনিষ নজরে এল। ছােট্ট চার পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা ছেলে একটা নরমুণ্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও বলল, পাশের ক্ষেতে এরকম আরও অজস্র মুণ্ডু আছে। আমরা কেঁপে উঠলাম। এত মৃত্যু, লাশ ও নরমুণ্ডু এর মধ্যে, পালিত হচ্ছে এই শিশু। এ কি কোন দিন সহজ ও স্বাভাবিক হতে পারবে? পাক দস্যুরা কি কাণ্ডটাই না এখানে করে গেছে। দুনিয়ায় মানবতা ও প্রজাতন্ত্রের প্রহরী সেজে যারা ঘুরে বেড়ায় সেই শ্বেতকায় মানুষগুলি কি কখনও এটা অনুভব করতে পারবে? মনুভাই ছেলেটিকে ঐ মুণ্ডুটা ফেলে দিতে বলে, পকেট থেকে একটা টাকা বার করে ওর হাতে দিলেন। ছেলেটি খুশী হয়ে দৌড়ে চলে গেল। কিন্তু এই দয়াদাক্ষিণ্যের প্রতিদান আমরা সঙ্গে সঙ্গেই পেলাম। সামনের মােড়ে তিনটি বাচ্চা হাড় ও মুণ্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল।
মেজর জলীল আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, “চলুন ঐ পারে নাজিমগঞ্জে। নৌকো এল । আমরা পার হলাম। কালীগঞ্জের নতুন নদী পারের শহর হল এই নাজিমগঞ্জ।
এখানে বাজারে বেশ খুশীর মেজাজ দেখলাম। লণ্ঠন ও পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে। একটা পুরােনাে গ্রামাফোনে কে যেন বাংলা গান বাজাচ্ছে। নাজীমগঞ্জ ও কালীগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শচীন এলেন। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, হাসি হাসি মুখ, ঝকঝক করছে দাঁত। মেজর জলীল ওঁকে জড়িয়ে ধরলেন। ওঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের জন্য ডাব, চা আর পান্তুয়ার অর্ডার দিলেন। একটা সরকারী ইমারতের বারান্দায় চেয়ার রাখা হল, ভেতর থেকে একটা গােল টেবিল বার করা হল। আমরা চারপাশে চেয়ার টেনে চাঁদের আলােয় বসলাম। চা এল।
ক্যাপ্টেন শচীন চা খেয়েই নিজের মুক্তিসেনাদের কাছে চলে গেলেন। এই দলটা সাখীপুর যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু ক্যাপ্টেন শচীন বলে উঠলেন, “কালিমায়ের কসম, আজ কাজ পুরাে হাসিল করে আসতে হবে।” ঐ দলের নওজোয়ান মুক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, মা কালীর কসম, বলাে, নারা-এ-তকবীর, আল্লাহু আকবর- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। সম্মিলিত কণ্ঠের আওয়াজে আমার মন ভরে
উঠল।
(পত্রিকার নাম পাওয়া যায় নি)
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯