বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩রা নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৩, ১৭ই কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বিশ্বশান্তি সম্মেলনের প্রস্তাব
মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদে অনুষ্ঠিত বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মোট ছ’হাজার প্রতিনিধি যোগদানকৃত সপ্তাহব্যাপী বিশ্বশান্তি সম্মেলন গত ৩১শে অক্টোবর সমাপ্ত হয়েছে।
বিশ্বের সর্বত্র সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত এ মহাসম্মেলনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও বলিষ্ঠ প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে।
গৃহীত এ সমস্ত প্রস্তাবে জরুরী কর্মসূচীর প্রথমেই রয়েছে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত করার আহ্বান, সিমলাচুক্তির কড়াকাড়ি বাস্তবায়ন এবং ভারত মহাসাগর এলাকায় যাবতীয় সামরিক ঘাঁটি ও জোটের উচ্ছেদ।
বিশ্ব যখন এক নতুন শান্তিভঙ্গের হুমকি থেকে কেবল নিস্তার পেতে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী শক্তির উস্কানিমূলক কার্যকলাপকে কঠোর ভাষায় নিন্দে করে ইশতেহারে ভিন্নতর সামাজিক ব্যবস্থা সম্বলিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এ মহাসম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত ইশতেহারে মধ্যপ্রাচ্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং জাতিসংঘের সাম্প্রতিক যুদ্ধ বিরতি কড়াকড়িভাবে পালন করে আগ্রাসী ইসরাইল যাতে দখলীকৃত আরব ভূ-খন্ড ছেড়ে নিজ এলাকায় ফিরে যায় সেজন্যে চাপ সৃষ্টির জন্যে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
কোনো রকমের রাজনৈতিক পরিচাপ না রেখে প্রত্যেক উন্নত দেশ যাতে প্রত্যেক উন্নয়নশীল দেশকে ব্যাপক ভিত্তিতে ও শর্তাবিহীনভাবে যাবতীয় অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে সেজন্যে বিশেষ আবেদনও জানানো হয়েছে। এ বিশ্বশান্তি সম্মেলনের সার্থক অনুষ্ঠানে গৃহীত প্রস্তাবনামাকে সমর্থন জানানোর সাথে সাথে আমরা আবার পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই যে, ভারত মহাসাগরের মতো একটি শান্ত এলাকায় মার্কিন টাস্কফোর্সের এ উপস্থিতি কোনমতেই সৎ-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বা এ কখখনো এতদঞ্চলে শান্তি রক্ষার অনুকূল নয়। বরং, এতে উত্তেজনা ও পরবর্তী কালে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়ে বিশ্বশান্তি ব্যাহত হতে বাধ্য।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন ভারত মহাসাগরকে একটি শান্তি এলাকায় পরিণত করার জন্যে আমাদের যে সরকারী নীতি ঘোষণা করেছেন, তাতে আমরাও আমাদের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করছি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অটোয়ায় কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে কিম্বা আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে, এমনকি জাপান সফর কালেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা ঘোষণার কথা বার বার উল্লেখ করেছেন।
নয়াদিল্লীর এক খবরে প্রকাশ যে, ভারতের বিদেশমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং আশংকা করেছেন যে, মার্কিন টাস্কফোর্সের উপস্থিতি ভারত মহাসাগরকে বৃহৎ শক্তিবর্গের এক শক্তি পরীক্ষা ক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে।
বিশ্বের নানান অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে, বিশ্বের কোথাও এখন শান্তির সোয়াস্তি নেই। মানুষ একেই নানানভাবে নিষ্পেষিত জর্জরিত। ঠিক এমন মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বৃহৎ শক্তির পক্ষে কখনোই উচিত হবে না ভারত মহাসাগরে তার এ নৌবহরের এমন পাঁয়তারা কষিয়ে বিনা উস্কানিতে একটি বিশ্ব অশান্তি সৃষ্টি করা।
তা’ছাড়া, ইতিহাস যখন বার বারই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বাহুবলে ধ্বংস করা যায়, অশান্তি সৃষ্টি করা যায়, সভ্যতা নষ্ট করা যায়, নরহত্যা করা যায় এবং পরভূমিও দখল করা যায়, কিন্তু মানুষের মন জয় করা যায়না, বিশ্বশান্তি স্থাপন করা যায় না বা সভ্যতার গৌরব করা যায় না, তখন যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহূর্তেই শুভবুদ্ধি উদয় হওয়া উচিত এবং বিশ্ব জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তার নৌনবহর নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা উচিত।
বিপর্যয়ের সম্মুখীন প্রকাশনা শিল্প
বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প বিপর্যয়ের মুখে। স্বাধীনতাউত্তর কাল থেকে পাঠ্য পুস্তক, সাহিত্য, রাজনীতি, গল্প-কবিতা, শিশু সাহিত্য ইত্যাদি সব বিষয়েই পুস্তক প্রকাশনা শতকরা ১০০ ভাগ থেকে নেমে ৬০ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের চেয়ে বর্তমানে শতকরা ৪০ ভাগ প্রকাশনা হ্রাস পেয়েছে—এ ছিলো গতকালকের একটি স্থানীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। উক্ত খবরে আরো প্রকাশ, বিশেষ করে সরকারী সহযোগিতার অভাবেই প্রকাশনা শিল্পে এই বিপর্যয় এবং সেজন্যে বাংলাদেশের ৬শ’ প্রকাশক সরকারের প্রতি এ ব্যাপারে অভিযোগ প্রকাশ করেছেন।
প্রাসঙ্গিকক্রমে স্মর্তব্য, জনৈক প্রখ্যাত ব্যক্তির উক্তি অনুসারে বলা যায় একটি দেশ বা জাতিকে ধ্বংস করার সক্ষমতা এবং মোক্ষম পন্থা হচ্ছে সে দেশের লাইব্রেরীকে পুড়িয়ে দেওয়া। এক্ষণে আর একথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না যে লাইব্রেরী গড়ে তোলার প্রধান এবং সবচেয়ে কার্যকর পথ প্রকাশনা শিল্পও যদি ধ্বংস হয়ে পড়ে তাহলেও সে দেশ বা জাতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়তে বাধ্য।
বিগত পাক আমলে বাংলা ভাষায় প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে নানা বাধা-বিপত্তি সুকৌশলে প্রয়োগ করা হয়েছে একথাও কারো অবিম্বিত নয়। সে সময়ে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অথচ নীরব প্রচেষ্টা ছিলো বাঙালীদের ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটানো। এবং তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলেছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে এবং বছরের অন্যান্য সময়ে পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী বা গ্রন্থ প্রকাশনার ব্যাপারে দুর্গম পদ্ধতি অনুসরণ এবং অন্যান্য কার্যকারণে। কিন্তু এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। ধ্বংস স্তূপের উপর সোনার বাংলা গড়ার দৃপ্ত শপথে উদ্দীপ্ত বাংলার প্রতিটি মানুষ। আর এই পুনর্গঠন কালে সমসাময়িক চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ধ্যান-ধারণা ও মননশীলতার প্রকাশ ও প্রয়োগের গুরুত্ব শুধু অপরিসীমই নয়, বরং তা হবে মৌলিক। এবং দেশের কবি সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ এক কথায় বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে দেশ এবং দেশবাসী সেটাই কামনা করে। বর্তমান কালের বুদ্ধিজীবীরা যেমন সমসাময়িক কালের প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমান বিংশ শতাব্দীর যুগ চিন্তার আলোকে ভবিষ্যতের জন্যে কিছু অবদান রাখবেন তেমনি ভবিষ্যত বংশধররাও এদের মৌলিক অবদানকে উপলক্ষ করে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা এবং প্রয়াস পাবে। আর বর্তমান কালের বুদ্ধিজীবীদের অবদানকে ধরে রাখবার প্রধানতম বাহন হচ্ছে গ্রন্থ—যার জন্ম এবং অস্তিত্ব নিহিত প্রকাশনা শিল্পে। সুতরাং প্রকাশনা শিল্পটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যকীয় সে কথা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে, বর্তমানে গোটা সমাজে চরিত্রহীনতার যে কালিমা তার প্রেক্ষিতে বেশী প্রয়োজন আত্মার আদর্শ ও সুষম খাদ্য। সে খাদ্য হচ্ছে গ্রন্থ এবং যার সঙ্গেও সম্পৃক্ত প্রকাশনা শিল্প।
প্রকাশনা শিল্পের বিপর্যয়ের খবর মূলতঃ আত্মার মৃত্যুর শামিল। কাজেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন এই শিল্পকে অনতিবিলম্বে এবং জরুরী ভিত্তিতে শুধু বাঁচিয়ে তুললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং এই শিল্পের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করে একে পূর্ণাঙ্গ করে তোলা একান্ত অপরিহার্য। এবং এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব অপরিসীম।
আরেকটি ছিনতাই : আরেকটি খুন
আবার প্রকাশ্য দিবালোকে খোদ রাজধানী নগরীতে টাকা ছিনতাই। এবার ছিনতাইকারীরা কেবল টাকা নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, একজন লোককেও খুন করে গেছে। আর সব কান্ডই ঘটেছে দিনের বেলায় লোক-চক্ষুর সামনে। অথচ ছিনতাইকারীদের বা হত্যাকারীদের কান্ড-কারখানা সবাই দেখেছেন—পথচারীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন সব কিন্তু কিছু করতে পারেননি। কিছু করবার উপায়ও ছিলোনা তাঁদের। কেননা ওরা সশস্ত্র আর এঁরা নিরস্ত্র। এমতাবস্থায় দেশবাসীর মনে কতটা শঙ্কা জাগতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
কিছুদিন আগেও ঢাকা নগরীতে দিনে-দুপুরে এমন একটা ছিনতাই ঘটে গেছে। সেবার ছিনতাইকারীরা প্রায় আড়াই লাখ টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছিলো। গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা তার চাইতেও ভয়াবহ। সকাল ১১টায় ছিনতাইকারীরা একজন গার্ডকে হত্যা করে পূবালী ব্যাংকের আড়াই লাখ টাকা নিয়ে গেছে অতি নাটকীয়ভাবে। ঘটনার বিবরণ যদি সত্য হয়, তবে এক্ষেত্রে বেশ ক’টা প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। যেমন, ঐ ব্যাংকের মুন্সীগঞ্জ শাখা থেকে দু’লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংকের মেনিটেস্টার দু’জন গার্ড সহ সদর দপ্তরে জমা দিতে আসছিলেন। তাঁরা লঞ্চে করে সদরঘাট টার্মিনালে আসেন। তারপর সেখান থেকে বেবী ট্যাক্সিতে করে মতিঝিলের দিকে আসছিলেন। এখানে প্রশ্ন জাগে, দেশের সর্বত্র আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন ‘কমা’র মধ্যে এসে গেছে, হাইজ্যাকার ও ছিনতাইকারীর অবাধ রাজত্ব চলছে সর্বত্র, সেই সময়ে ব্যাংকের মুন্সীগঞ্জ শাখা কর্তৃপক্ষ কি করে এতগুলো টাকা এভাবে পাঠাতে পারলেন? এটা কি তাঁদের উদাসিনতা নয়? অন্যদিকে একটা বেবী ট্যাক্সিতে দু’জন ব্যাংক গার্ড আর পোটলা-পুটলী থাকলে এটাতো সহজেই অনুমেয় যে সেখানে ‘কিছু’ থাকবে। কাজেই দুষ্কৃতিকারীরা তো তৎপর হবেই। আমাদের বিশ্বাস এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া গেলে এহেন ছিনতাই ও ঐ লোকটির খুন হবার পেছনের সূত্রগুলো অবশ্যই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক