২৭ মার্চ ৭১ঃ কলকাতার পথে তাজউদ্দীন
২৭ মার্চ ১৯৭১ ভোরবেলা আমার সঙ্গের বন্দুক ও গোলা এই বাড়িতে রেখে কারফিউর ভেতরে প্রাচীর টপকে খানিকটা পথ হেঁটে রওনা হলাম। শহর সীমার বাইরে যেতে হবে আমাদের। পাশেই ছিল একটি মসজিদ। একবার ভাবলাম কিছু সময়ের জন্য এখানে আশ্রয় নিলে কেমন হয়। কিন্তু দেখলাম সেখানেও অবাঙালিদের আনাগোনা। মসজিদ, রাজপথ, বস্তি ও ক্যান্টনমেন্ট মিলে সমস্ত ঢাকা শহর যেন রূপ নিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক বর্বর হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতার। তাই মসজিদে না গিয়ে সামনের এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাড়িটি ছিল আতাউল হক সাহেবের। এই বাড়ির দেয়াল ছিল মাত্র পাঁচ ইঞ্চি ইটের। এই গাঁথুনিতে বুলেট সহজেই প্রবেশ করতে পারে তবুও যেখানে কোনো আশ্রয় নেই সেখানে এটাই নিরাপত্তার প্রতীক। এই বাড়ির উত্তর পাশ দিয়ে রাজপথ চলে গেছে সাতমসজিদের দিকে। সামনে ছিল বস্তি। দেখলাম কিছু অবাঙালি লোক মাথায় উর্দি, মুখে রুমাল বেঁধে বস্তির প্রতিটি ঘরে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তখনও কারফিউ বলবৎ আছে। আগুনের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে বস্তির আবাল বৃদ্ধ বনিতা যখন খুপরিগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল ঠিক তখন পৃথিবীর সমস্ত বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়ে নিরীহ নিরপরাধ মানব সন্তানদের ওপর মেশিনগানের বুলেটবৃষ্টি শুরু হলো। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়তে থাকল অগণিত বাংলার সন্তান। অপরাধ, তারা বাংলার স্বাধীনতা দাবি করেছিল। তাদের অসহায় চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছিল। মনে হয়েছে এই প্রকম্পনই যেন প্রেরণা জোগাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে প্রাণ দেব বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করব। সেই মুহূর্তে আমার মুখ থেকে একটি শব্দই বেরিয়েছে ‘এরা হারবে’। ইতোমধ্যে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। আশ্রিত বাড়ির ভেতর থেকে ঢাকা বেতারের ঘোষণা প্রচারিত হলো। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত কারফিউ প্রত্যাহার করা হলো। আর একমুহূর্ত দেরি না করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে করে হোক সাতমসজিদ রোড পার হয়ে রায়েরবাজার দিয়ে শহর ছেড়ে যেতে হবে। কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই দেখলাম মোহাম্মদপুরের দিক থেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি দ্রুত বেগে ছুটে আসছে। আমরা খুব দ্রুত পাশ কাটিয়ে একটি বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত আছে বাড়িওয়ালা যেই হোক যদি জিজ্ঞাসা করেন কেন এসেছেন, কি চান তবে জবাব হবে একটা টেলিফোন করতে এসেছি। বিশেষ প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সামরিক বাহিনীর গাড়ি দ্রুতবেগে পিলখানার দিকে চলে গেছে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে ৩০ সেকেন্ডে সাতমসজিদ রোড পার হলাম। রায়েরবাজার যেতে সাতমসজিদ রোড অতিক্রম করাটাই ছিল সবচাইতে বড় বাধা। এই সময় একবার আমি ভেবেছিলাম আমাদের নিজেদের বাড়িটা দেখে গেলে কেমন হয়, কি অবস্থায় আছে তারা, বেঁচে আছে কি মরে গেছে সেটা অন্তত জানা যাবে। কিন্তু আবার সিদ্ধান্ত নিলাম, হয়ত শেষ মুহূর্তের দুর্বলতায় ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে যেতে পারে। আর একটুও দেরি না করে শংকর দিয়ে রায়েরবাজারে উপস্থিত হলাম।
রায়েরবাজারের অবস্থা দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম! ওপাশের হত্যাযজ্ঞের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি এখানে। অনেকটা স্বাভাবিক মনে হলো। কিন্তু শহরের অসংখ্য মানুষ গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা এসে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করল। ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে নাসরুল্লা নাস্তা করাল। হাঁটার সুবিধার জন্য পালবাড়ির ছেলেরা এক জোড়া নতুন পাম্প সু এনে দিল। এখানে একটি কথা বলে নেই সেই পাম্প সু আমি আজও (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) ব্যবহার করছি। আবার চলতে শুরু করলাম। সামনে নদী, পারাপারের ভীষণ অসুবিধা। এমনি সময় রায়ের বাজারের আওয়ামী লীগ কর্মী রেজা’র চাচা এসে নদী পারের ব্যবস্থা করে দিলেন। নদী পার হয়ে আটির বাজারে পৌঁছলাম। এই পথে পরিচিত বহু মানুষের সঙ্গে দেখা। তাদের প্রাণঢালা যত, সম্মান সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলছি। বাংলার মানুষের এই আপ্যায়ন বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারার ঐশ্বর্যের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে বার বার। বাংলার মানুষের এই রূপ নিজ চোখে যারা দেখেনি তারা কোনোদিন জানবে না বাংলার মানুষ নির্যাতিত মানুষের কত আপনজন। এখানেই সিরাজের সঙ্গে দেখা। ঘর থেকে ২৫০ টাকা এনে হাতে তুলে দিয়ে বলল, নিয়ে যান পথে প্রয়োজন হবে। সিরাজ শুধু টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হলো না, একটা মোটরসাইকেল জোগাড় করে জনৈক মতিউর রহমানের বাসায় পৌঁছে দিল। এদিকে পথে ঘটনাক্রমে বাবুবাজার ফাঁড়ির পুলিশ কনস্টেবল রুস্তমের সঙ্গে দেখা হলো। সে কোনোক্রমে পালিয়ে বেঁচে এসেছে। সে বলল, তার সহকর্মীরা যখন রাতের অন্ধকারে গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখন বর্বর সামরিক দস্যুরা ঘুমন্ত কনস্টেবলদের নির্বিচারে হত্যা করে। ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছিল যে রুস্তম শুধু পালাতেই পেরেছিল কোনো শব্দ করতে পারেনি। তাই হয়ত সে বেঁচে গিয়েছে। ২৭ মার্চ রাতে মতিউর রহমান সাহেবের বাড়ির পুকুরে গোসল করলাম। রাতে পাটখড়ির বেড়ার ঘরে কিছু সময় ঘুমালাম।