বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৫মে আগস্ট, রবিবার, ৮ই ভাদ্র, ১৩৮১
গণপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাচ্যুত করা হলো
সরকার ইউনিয়ন কাউন্সিলকে একটি ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। একটি আয়ের সম্ভাব্য উৎস কেড়ে নিলেন। সম্প্রতি মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনের নিকাহ ও তালাক রেজিস্টার লাইসেন্স এখন থেকে সরকার দিবেন। আগে মিউনিসিপাল পরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিল এ কাজটি করতেন।
সরকার এ ধরনের একটি কাজের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদ বা মিউনিসিপাল কমিটির কাজ থেকে কেন নিজেদের মধ্যে টেনে নিলেন তাঁর কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। সরকার রেজিস্টারদের লাইসেন্স ইস্যু করলে আমাদের প্রচলিত বিবাহ প্রথার উন্নতি হবে এবং ইউনিয়ন কাউন্সিল বা অন্যকোন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ইস্যু করার কারণে এক্ষেত্রে ক্ষতি হতে পারে এমনটা ভাবারও কোন কারণ নেই। এক হতে পারে সরকারের রাজস্ব খাতে নতুন অজুখানা কিন্তু যেখানে ইউনিয়ন কাউন্সিল ও মিউনিসিপ্যালিটি গুলিকে সরকারি সাবসিডি দিতে হচ্ছে সেখানে তাদের রাজস্বের উৎস বন্ধ করার কোনো কারণ থাকতে পারে কি? পরিণতিতে এক হাত দিয়ে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে দিতেই হচ্ছে। তাহলে কেন এমন একটি অপ্রয়োজনীয় আইন পাস করা হলো।
এমনিতেই আমাদের সরকারের উপর দায়িত্ব অনেক। দেশের নানা ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে তার নাভিশ্বাস। উচ্চতম মহলের হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো কাজেই এখানে এগোয়না। তার উপর ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগ এর মত একটি অনুৎপাদক ও অপ্রয়োজনে ঝামেলাও তারা কাঁধে নিয়ে দেশের এমন কি উপকার করবেন। প্রি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সরকারকে কিভাবে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রণালয় কত বিবাদ ও দলাদলির নথিপত্র এসে জমা হয়েছে সরকার নিশ্চয় সে সম্পর্কে অনভিজ্ঞ নয়। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ঘুষ, দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে। আর তার দায় ও দায়িত্ব এসে পড়েছে সরকারের উপর। এতে সুনাম নষ্ট হয়েছে। বাড়েনি। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিষয়টি যে শেষ পর্যন্ত কেমন একটি টাউটদের কারবারে পরিণত হবে না তারই বা গ্যারান্টি কোথায়! সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কে আবার দলাদলির, লাঠালাঠির মীমাংসার জন্য অতিরিক্ত সময় অপব্যয় করতে হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়।
মিউনিসিপালিটি ও ইউনিয়ন কাউন্সিল ও জনগণের নির্বাচিত স্বায়ত্তশাসিত প্রাথমিক সমাজ সংস্থা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের যে নীতি সরকার সাংবিধানিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন তার অধীনে ক্রমাগত অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করে এগুলোকে শক্তিশালী করার কর্মসূচিই সরকারের লক্ষ্য হওয়া দরকার ছিল। এর বিকল্প নেই কাজও নীতির মধ্যে গভীর পার্থক্য ধরা পড়ে। জনগণ সরকারকে ভুল বুঝবেন। তাই এমন ক্ষমতা সরকারের গ্রহণ করা উচিত নয়, যার ফলে সরকার কোনক্রমেই লাভবান হচ্ছেন না। অথচ ঝুঁকি বাড়ছে আর তার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে সংশয়।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণদানকালে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি গত বুধবার বলেন যে, বর্তমান জন্মহার অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে দ্বিগুণ হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলের বাংলাদেশের ন্যায় সমস্যা না থাকলেও বিশ্বসমাজ যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিরোধ গ্রহণে প্রস্তুত না থাকে তাহলে সম্পদ বন্টনের কোন না কোন পন্থা উদ্ভাবন করতেই হবে। সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক শতকরা হার হল তিন ভাগ এবং তা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষ হবার আগেই বর্তমান সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা ১৫ কোটিতে দাঁড়াবে এবং সেই সমস্যার সাথে যোগ হবে বন্যা ও ঘূর্ণিবাত্যার দরুন ফসলহানির সমস্যা।
আগামী ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে ১৫ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে এটা কোন নতুন কথা নয়। কারণ বারান্তরে বিভিন্ন তথ্যে আমরা অনাগত অনেক দেশে ভয়াবহ সমস্যার কথা শুনে আসছি এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু প্রধান কথা হল প্রতীক্ষারত সেই ভয়াবহ সমস্যাকে এড়াবো কিভাবে আমরা? মাত্র ৫৪ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির জন্য বর্তমান জনসংখ্যার একটি বিরাট বোঝা এবং পৃথিবীতে এমন আর কোনো দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই যে, এই ধরনের স্বল্প আয়তন এলাকার মধ্যে এতগুলো লোক বাস করে। আমাদের সম্পদ অত্যন্ত সীমিত এবং কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের বন্যার পানির মতো জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলেও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ আগে যা ছিল এখনও তাই রয়েছে। ভবিষ্যতে নদী অথবা বাংলাদেশ সংলগ্ন সাগরে চড়লেও সামগ্রিক জনসংখ্যার তুলনায় তা হবে কতটুকু? তোদের বাড়ির জমির উৎকর্ষতা লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। জন্মহার ও খাদ্য ভাবে দুটো সমস্যা পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং দিন যতই যাচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যাভাবও আমাদেরকে জর্জরিত করছে উত্তরোত্তর এবং তাতে করে পরনির্ভরশীলতার দুষ্টগ্রহ আমাদেরকে বাঁধছে আষ্টেপৃষ্ঠে। বর্তমানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উদরপূর্তির জন্য কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ এবং দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যে মোটা অংক চলে যাচ্ছে খাদ্য শস্য ক্রয়ে। ঠিক এমনি অবস্থায় যদি আগামী ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ১৫ কোটি হয় তাহলে অবস্থাটা কিরূপ ভয়াবহ হবে আমরা অনেকেই তা আজ করে শিহরিত হলেও ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকরী পন্থা অর্থাৎ জন্মহার প্রতিরোধের ব্যাপারে ব্যাপক কার্যক্রম খাতা-কলমে থাকলেও কার্যতঃ এখনো তা গ্রহণ করা হয়নি।
বুখারেস্ট সম্মেলনে যোগদানকারী জনৈক জনপ্রতিনিধির বক্তব্য এখানে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি মানব সন্তানের জন্য সুষ্ঠু জীবন-যাত্রার নিশ্চয়তা বিধান কল্পে বিশ্বের সর্বত্র মানুষের কাজ করে যাওয়া উচিত এবং এতে পর্যাপ্ত অর্থনীতি কল্যাণ, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিচর্যা ও আশ্রয়ের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন যাদের জন্য উন্নত জীবনযাত্রা বিধানের দরকার তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের প্রয়োজন সর্বাধিক।
আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সব নীতিই মূলতঃ জনগণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কিন্তু হিসেবে জনগণের কল্যাণে যদি আমাদের নিত্যদিনের শ্রমের ফসলকে কাজে লাগাতে না পারে তাহলে সব শ্রম যে বৃথা সে কথা আজ সবাই আমরা না বুঝলেও ২৫ বছর পরে হারে হারে আমরা তা টের পাব। কিন্তু কেন এই ব্যাপক আকারের জন্মহার বৃদ্ধি, অন্ততঃ আমাদের এই বাংলাদেশে? এ দেশের শতকরা ৮০ জন লোক নিরক্ষর এবং এদের সবাই সন্তানের জন্মদান ও তার উদরপূর্তির ব্যাপারে অদৃষ্টবাদী। সনাতন কুসংস্কারের পক্ষ থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ হল গণশিক্ষা এবং সেইসাথে ব্যাপক আকারের জন্ম প্রতিরোধের সার্বিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ। তাছাড়া রয়েছে চিত্ত বিনোদনের অভাব জনিত সমস্যা, এদেশের অশিক্ষিত শুধু নয়, শিক্ষিত নারী পুরুষের কাছে চিত্তবিনোদনের ব্যতিক্রম পন্থা নেই বলে বছরের পর বছর ধরে আমরা সন্তানের জন্মদান করে অনাগত ভয়াবহ দিনগুলোকে হাতছানি দিয়ে ডাকছি। বিভিন্ন সমস্যা গুলিকে সামনে রেখে আমাদেরকে জনপ্রতিরোধের ব্যাপক ও কার্যকরী ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে। সুষ্ঠু জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের আর্থিক সঙ্গতির প্রশ্ন বর্তমান খাদ্য সংকটের দিনে উত্থাপিত হতে পারে। তবে এই ভয়ে ভয়ে সমস্যাকে কোনোভাবেই আমরা পাশ কাটিয়ে চলতে পারিনা এবং পারিনা বলেই বুখারেস্ট সম্মেলনে আমাদের প্রতিনিধির প্রদত্ত ভাষণের কোনই অর্থ হবে না, যদি আমরা কার্যকরীভাবে তার প্রয়োগ না ঘটাতে পারি। আমরা মনে করি বাংলাদেশের জন্মহার বৃদ্ধির একটা আন্তর্জাতিক মানবিক সমস্যা এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের বর্তমান ও অনাগত সংকটকে এড়ানো সম্ভব।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক