হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ : ড. নীহার সরকার
বাম চিন্তাবিদদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা
স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই রাজনীতি বিষয়ে যে দুটি বই পড়ে ছিলাম। দুটি বইয়েরই লেখক ছিলেন ড. নীহার সরকার। একদা তাঁর লেখা ওই দুটি বই-ই ছিল বহুপঠিত এবং বিখ্যাত। একটি ‘ছোটদের রাজনীতি’, অন্যটি ‘ছোটদের অর্থনীতি’ জ্ঞানী, বিনয়ী নীহার সরকার। থাকেতেন দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর সংলগ্ন লায়েলকায়। একই নকশায় তৈরি হওয়া পাশাপাশি দুটি বাড়ির একটিতে।
আমাদের বাংলা ভাষা বিষয়ক আন্দোলনকে সমর্থন করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাই এর মূল কারণ বলে বর্ণনা করে। “একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি জাতির অর্থনীতি, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব” বলে মন্তব্য করেছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ তিনি বহুজাতিক সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নীহার দা-র সঙ্গে কিছু মত পার্থক্য হয়েছিল। তবে সে প্রসঙ্গ এখানে নয়। ১৯৮৭ সালে তিনি এ বিষয়ে যে লেখাটি দিয়েছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’।
সেখানে তিনি লিখেছিলেন, বহু ভাষাভাষী সোভিয়েত দেশ। সেখানে ছোট ছোট জাতিগুলোও তাদের কৃষ্টি ও ভাষার অভিব্যক্তির সম্পূর্ণ সুযোগ পাচ্ছে ।” শুধু নীহার সরকার নন, এ ক্ষেত্রে দু’একজন বাদে অন্য বামপন্থী কবি-লেখক-রাজনীতিবিদ প্রায় সকলের মূল কথা ছিল ওই ধারার।
১৯৮৭ সালে লেখা নীহার সরকারের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। তার দু-বছর আগেই সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দুঃখজনক পতন ঘটে। এবং ওই পতনের নানা কারণের মধ্যে ছিল, অ-রুশভাষী অন্য জাতিগুলোর উপর রুশ ভাষা ও রুশ জাতির আধিপত্য। এখানেই রয়েছে বাম চিন্তাবিদদের কাঠামোগত চিন্তার সীমাবদ্ধতা।
একুশের ডাক
‘একুশের ডাক’ পত্রিকায় প্রকাশিত ড. নীহার সরকার-এর লেখা থেকে কিছু অংশ। “বহু ভাষাভাষী পুঁজিবাদী দেশ যে একেবারেই নেই তা নয়। তবে সেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে বিরোধ লেগেই আছে যেমন বেলজিয়াম ।
বেলজিয়ামে ফ্লেমিশ ডাচ ও ফরাসি ভাষাভাষীদের মধ্যে বিবাদের শেষ নেই। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ড, ইতালিয়ান, জার্মান ও ফরাসি ভাষাভাষীরা মোটামুটি একসঙ্গে মিলেমিশে আছে। তার কারণ তারা প্রায় সমান ক্ষমতাসম্পন্ন এবং পুঁজিবাদী বিকাশের একই স্তরে আছে।
এবং চারপাশের বৃহত্তর দেশগুলোর চাপে তারা একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তেমনি কানাডার সংখ্যাগরিষ্ঠ ফরাসিভাষীরা সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকে। পাছে তাদের কৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে গিয়ে তারা সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষাভাষীতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
ভারতের ভেতরেই একটা অভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্যবাদ প্রথা চালু হয়েছে, যেমন ছিলো ব্রিটিশ আমলে। শুধু তফাৎ এই যে ব্রিটিশ যুগে সাম্রাজ্যবাদীরা ছিলো সাদা রং-এর এবং তারা থাকতো বিলেতে।
রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের ন্যায় মৃত ভাষার কবি
বর্তমান সাম্রাজ্যবাদীরা কালো চামড়ার এবং থাকেন এদেশে। সাম্রাজ্যবাদের একটা বিশেষ চরিত্র হ’ল, সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা ও কৃষ্টি কলোনির উপর চাপিয়ে দেওয়া এবং এই উদ্দেশ্য কলোনির ভাষাকে ও সংস্কৃতিকে গলা টিপে মেরে ফেলা।
ইংরেজরা ভারতবর্ষকে জয় করে আমাদের উপর ইংরেজি চাপিয়েছিলো। ফরাসিরা তাদের কলোনিগুলোতে ফরাসি ভাষা চালু করেছিলো, ওলান্দাজরা তাদের কলোনি ইন্দোনেশিয়ায় তাদের ডাচ ভাষা চাপিয়েছিলো।
আর পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশের উপর চাপিয়েছিলো উর্দু। আজ ভারতের সাম্রাজ্যবাদীরাও তাদের ভাষা ‘হিন্দি’কে জোর করে তাদের কলোনিগুলোতে চাপাতে চাইছে।
আমাদের দেশেও যদি পুঁজিবাদী রাজত্ব আরও কিছুদিন চলে তাহলে আমরাও বাংলা ভুলে যাবো। এবং রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের ন্যায় মৃত ভাষার কবি হয়ে থাকবেন ।”
নিচের ছবি:
“১৯৪৭-এর বঙ্গবিভাগ কি অপরিহার্য ছিল ?”
শিরোনামে আয়োজিত সভায়
বক্তা ড. নীহার সরকার,( ছবির ডান দিক থেকে)।
বসে ডাক্তার শিশির বসু,উদিতেন্দু প্রকাশ মল্লিক ।
https://web.facebook.com/profile.php?id=100007783878282&sk=timeline