You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৭ই জুন, বৃহস্পতিবার, ২৩ শে জৈষ্ঠ্য, ১৩৮১

পাকিস্তানে অশুভ শক্তির পদচারণা

পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। গত বেশ কিছুদিন পূর্বে এই দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটলেও বর্তমানে তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। খবরে প্রকাশ, কাদিয়ানী সম্প্রদায় ও গোড়া মুসলমানদের মধ্যে এই আত্মঘাতি সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত যে খবর পাওয়া গেছে তাতে কমপক্ষে তিরিশজন নিহত ও দু’শ জনেরও অধিক লোক আহত হয়েছে। দাঙ্গায় লিপ্ত থাকার দায়ে এ পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। দাঙ্গাকারীরা পাঞ্জাবে রেলের লাইন তুলে দিয়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনকে উলটে দিয়েছে, তাতে বহু লোক হতাহত হয়েছে। দাঙ্গার কারণে পাঞ্জাবের রাবওয়ার অবস্থা অত্যন্ত মারাত্মক। ঐ শহরে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ও সহকারী জেলা কমিশনারকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। শহরের টেলিফোন যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। এই ভয়াবহ দাঙ্গার কারণে সরকার সারা দেশে জনসভা, বিক্ষোভ, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এক নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবরে প্রকাশ, কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী নেতা মৌলভী রশীদকে গত পরশুদিন গ্রেফতার করা হয়েছে। জানা গেছে, তার নাকি পাঁচ হাজার উগ্র কাদিয়ানী সমন্বয়ে একটি জঙ্গি বাহিনী ছিল। এদেরই দুর্ধর্ষ আক্রমণের দরুন রাবওয়া শহরে পুলিশ বা আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনী ভিড়তেই পারছেনা। পাকিস্তানের জন্মের মাত্র বার বছর পরই পাঞ্জাবে কাদিয়ানী ও উগ্র সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে এক মারাত্মক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। সেই দাঙ্গায় কমপক্ষে দু’হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৫১ সালে সেই দাঙ্গা রোধ করতে পাকিস্তানকে সামরিক আইন জারি করতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া বেতারের এক খবরে জানা গেছে, পাকিস্তানের বর্তমানের এই দাঙ্গা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নি সংযোগ, খুনজখম ও হত্যাকাণ্ড চলছে। দাঙ্গা শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবের লায়ালপুর শহর থেকে; কিন্তু বর্তমানে তা রাজধানী ইসলামাবাদ সহ প্রায় সকল শহর-নগরেই ছড়িয়ে পড়েছে। একমাত্র গুজরানওয়ালা শহরেই পঞ্চাশটি দালান ও কয়েকটি মসজিদ পুড়ছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। দাঙ্গাকারীদের পক্ষ থেকে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে ঘোষণা না করা হলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ভবন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এদিকে পাঞ্জাবের দাঙ্গা সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলি ভূট্টো জাতীয় পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে সম্প্রতি বলেছেন-সাম্প্রতিক সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পাকিস্তানকে দূর্বল করার জন্যে কোন গোপন পরিকল্পনা প্রসূত। পরিষদে বিরোধী দলের বির্তক প্রস্তাব উথাপনের বিরোধিতা করে জনাব ভুট্টো জাতীয় স্বার্থের খাতিরে এই সাম্প্রদায়িক বিধয়ের প্রতি ভাবাবেগ বর্জিত নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বির্তক উথাপিত হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। লাহোরের এই দাঙ্গা তদন্ত করে দেখার জন্যে লাহোর সুপ্রিম কোর্ট অবিলম্বে তদন্ত অনুষ্ঠান করবেন বলে প্রধানমন্ত্রী ভূট্টো পরিষদে জানিয়েছেন কাদিয়ানী সম্প্রদায় অধ্যূষিত রাবওয়া। কাদিয়ানীরা রাবোওয়াতে মেডিক্যালের দু’শো ছাত্রের উপর অমানবিক হামলা চালিয়েছে। দাঙ্গার সূত্রপাত সেখান থেকেই। পাকিস্তানে দীর্ঘদিন পরে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে। একে কার্যকর করার দ্বায়িত্ব আজ সরকারী কতৃপক্ষের। অতীত দিনে পাকিস্তানি শাসকরা সাম্প্রতিককালে উত্তেজনা টিকিয়ে রাখার জন্যে বিভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতো। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতো। সেদিন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে এটা তাদের একটি অস্ত্র ছিল। আজ ঘটনা পরিক্রমায় দেশের সেই অবস্থা আর নেই। পাকিস্তানেও সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাও এখন তাদের পরিতাজ্য বিষয়। অতএব পাকিস্তানের কতৃপক্ষ সুস্থচিত্তে এ সকল দাঙ্গার মোকাবেলা করবেন। পাকিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই আমরা চাই। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিশেষ হোক পাকিস্তানের মাটি থেকে-এটাও আমাদের কামনা।

খেসারতের পালাগান বন্ধ হোক

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের লাভ ও ক্ষতি দুটোর প্রতিই আমরা সমান সচেতন। যখন দেখি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা লাভ করে তখন জাতীয় অর্থনীতির সম্ভাব্য উন্নতির আশায় আমরা উৎফুল্ল হই কিন্তু তারই পাশাপাশি যখন ক্ষতির পরিমাণটা দেখি তখন জাতীয় স্বার্থেই আতঙ্কিত না হয়ে পারিনা এবং সামগ্রিক ক্ষতির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত যখন দেখি তখন আতঙ্ক ছাড়িয়ে হতাশায় নেমে পড়তে বাধ্য হই।
জাতীয় সংসদে আলোচনা কালে যে কয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ক্ষতি হিসাব দেয়া হয়েছে তারই নমুনা তুলে ধরলে অবস্থার কিছুটা আচ করতে পারা যাবে। ১৯৭৩-৭৪ সালের অর্থনৈতিক বছরে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ বিভ্রাট বন্ধ থাকার জন্যই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানার সাড়ে সাত কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। জাতীয় সংসদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বিভাগের মন্ত্রী এই তথ্য পরিবেশন করেছেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় বস্ত্রশিল্পের ৪ কোটি ৬৮ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, কাগজ ও বোর্ড সংস্থার মোট ৪টি কারখানায় ১ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। এতে মোট ৩৪ লাখ ৬ হাজার মানুষ ঘন্টা বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল বলেও প্রতিমন্ত্রী জানান। এমনি সার ও রসায়ন অধীনস্থ শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহ কারিগর ও জাহাজ নির্মাণ সংস্থা যথাক্রমে ১২ লক্ষ টাকা এবং ৭১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়। খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি প্রস্তুতের মোট ১১ টি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় উৎপাদন শিল্প সংস্থার অধীনস্থ ৯টি কারখানায় যথাক্রমে ২৯ হাজার টাকা এবং ৮১ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে এবং এইসব শিল্প-কারখানায় হাজার হাজার ঘন্টা বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পৌঁছতে পারেনি। ‘বাংলার বাণী’তে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের উৎপাদনক্ষমতা ১লক্ষ ৬৯ হাজার টন। কিন্তু চলতি বছরে চিনি উৎপাদিত হয়েছে ৮৮ হাজার ৩১৫ টন। বলা হয়েছে, অবৈধভাবে গুড় উৎপাদনই এর কারণ। কথা হলো কারণ যাই হোক ৮০ হাজার ৬০৫ টন চিনি কম উৎপাদন হয়েছে এ হল বাস্তব বিষয়।
স্বাধীনতার পূর্ব বছর পর্যন্ত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল লাভ করে যাচ্ছিল। সেখানকার গত চার বছরে হিসেবেও এবার প্রায় ৩ কোটি টাকা লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে। ১৯৭০-৭১ সালে ক্ষতি হয়েছে ১৩ লাখ ৪ হাজার টাকা, ১৯৭১-৭২ সালে ১ কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ১৯৭২-৭৩ সালে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। অধিবেশন বিতর্কের সূত্রেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতি মাসে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৮০ টন কাগজ উৎপাদন কমে গেছে একই সঙ্গে লোকসান ও উৎপাদন কমিটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য যে সোনায় সোহাগা সে কথা বলাই বাহুল্য।
সড়ক পরিবহন সংস্থার ক্ষেত্র নৈরাশ্যজনক খবর মাত্র দুটি সড়কে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ এবং জয়দেবপুর সড়ক বিআরটিসি প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে বাস চলাচলের ব্যাপারে রাজ্য আছে। মোট ৫৬১ টি বাসের মধ্যে ১১২ টি ৫০ টি দ্বিতল বাসের মধ্যে ৩০ টি ১০১ টি কোচের মধ্যে ৮১ টি কোচ অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। ফলে ঢাকা-জয়দেবপুর নারায়ণগঞ্জ সরকার নির্ধারিত ৩০০ টি বাসের মধ্যে মাত্র আড়াইশো বাস চালানো হচ্ছে। ঢাকা-পাবনা, ঢাকা-ফরিদপুর কোচ চলাচল বন্ধ রয়েছে। একদিকে লোকসান অন্যদিকে বাস বসিয়ে রাখা এই দুটোই লোকসানের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
দেশের নানাবিধ সমস্যা আছে আমরা জানি সেই সমস্যাগুলো মোকাবেলার সংশ্লিষ্ট মহল কার্যরত আছেন তাও সত্য তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় তবুও এই দশা কেন? জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থের যেখানে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করার কথা জাতীয় অর্থনীতিতে স্থিতাবস্থা আনার জন্য যেখানে উৎপাদন বাড়ানোর কথা সেখানে সবক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা পেছনে পড়ে থাকছে। অথচ বর্তমান অবস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে গেলে দ্রুত উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ আমাদের নেই এই সত্য কথাটা না বোঝার কথা নয়। দেখা যায় সময় মতো ছোট ছোট জিনিসের সরবরাহ না থাকার জন্যই ব্যাপক ক্ষতি গুলো হয়ে যায়। যেমন ফার্নেস তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকে তার ফলে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়। খুচরো যন্ত্রপাতির অভাবে বাস ইত্যাদি অকেজো হয়ে পড়ে থাকে এবং অবশেষে সামরিক ক্ষতিসহ লক্ষ লক্ষ টাকার গাড়িগুলোর ও এক সময় চোখের সামনে পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। যার ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে নতুন সমস্যা ও বিপর্যয় নেমে আসে।
দেশের অভাব অভিযোগ চাহিদা ক্ষতি ইত্যাদির আবর্ত আছে এটা ঠিক তবে তাকে লঘু করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলিকে অধিকতর কর্মনিষ্ঠ হতে হবে। যথেষ্ট সময় হাতে রেখে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে কলকারখানা কোচ বাস ইত্যাদি চালু রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কোন ঢিলেমি বা গড়িমসি আর সহ্য করা যায় না। দেশীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড এত লোকসানের তেলেসমতি সহ্য করতে পারবে না-পারবে না জনগণও তার খেসারত দিতে। এখনো সময় আছে। সমগ্র জাতির কল্যাণের স্বার্থে লোকসানের গহ্বরগুলোকে আর যেন কিছুতেই না বাড়তে দেওয়া হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!