বাংলার বাণী
ঢাকা: ৬ই জুন, বুধবার, ২২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
কর্ম-কমিশনের রিপোর্ট
গত পরশুদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। সংসদের অন্যান্য বিল এর সঙ্গে ১৯৭৩ সালের সরকারি কর্ম কমিশনের (প্রথম ও দ্বিতীয়) রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। কর্ম কমিশনের রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে তাতে একটি হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে এ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগের দরুন উপযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে-প্রার্থীদের গুণগত ও শিক্ষাগত জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। প্রবেশিকা পরীক্ষা হ’তে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের ডিগ্রী পরীক্ষায় কৃতকার্য প্রার্থীদের বিষয়গত ও সাধারন জ্ঞান খুবই নিচু স্তরের। এ ধরনের স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন চাকরি প্রার্থীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। কর্ম কমিশনের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, রাস্ট্রপতির নির্দেশ এবং সরকারের সংস্থাপন বিভাগের সুস্পষ্ট নির্দেশ ভঙ্গ করে কর্মকমিশনের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ্যাডহক ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে লোক নিয়োগ করা হয়েছে। এ সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত যোগ্যতার মাপকাঠি গ্রাহ্য করা হয়নি। এ্যাডহক নিয়োগের সময় থাকে ৬ মাস। কিন্তু সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্বেও প্রায় ক্ষেত্রে ৬ মাসের পর আরো এবং এমনকি অনির্দিষ্টকালের জন্য কোন কোন চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। চাকরি প্রার্থীদের যোগ্যতা ও জ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বিষয়ভিত্তিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের অনিচ্ছা ছাড়াও প্রার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতি বিরাগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কর্ম কমিশনের রিপোর্টে আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে, পরীক্ষায় দুর্নীতি, ছাত্রদের নৈতিক অধঃপতন এবং অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য এধরনের অনুপযুক্ত নিয়োগই দায়ী। এছাড়া কারিগরি শিক্ষায় হাতে-কলমে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অপ্রতুল বলেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। কর্ম কমিশনের অভিমত বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে শিক্ষার মান উন্নত করে শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করতে না পারলে কিছুতেই দেশের যুব শক্তিকে অনাগত ভয়াবহ পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। এ ব্যাপারে কমিশন সরকার তথা দেশের শিক্ষার্থীদের এদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নত করে ভবিষ্যৎ ছাত্রসমাজকে শিক্ষানুরাগী জ্ঞান পিপাসু ও সহিংস করে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্য করে কমিশন বলেছেন, বর্তমান সরকারের ঘোষিত নীতি ও কার্যাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়মাবলী প্রণয়নের পক্ষে কমিশন সুপারিশ করেছেন। অফিসারদের মন থেকে বর্তমানে বিদ্যমান প্রাক স্বাধীনতাকালীন সন্দেহজনক ধারণাসমূহ দূর করার উদ্দেশ্যে চাকরিতে নিযুক্তির আগের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এবং সরকারি চাকরিতে গণমুখী করে তোলার জন্য রিপোর্টে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। একটি তথ্য দিয়ে কমিশন অনুমোদিত এ্যাডহক নিয়োগের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে একজন প্রকৌশলী, চব্বিশজন নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগ করেছেন এবং ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর এ্যাডহক নিয়োগের মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য কমিশনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। বিদ্যুৎ, বন নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কমিশনের অনুমতি ছাড়া ১২৪টি পদে এ্যাডহক নিয়োগ দান করেছে। ২২টি নির্বাহী প্রকৌশলী ও ২টি প্রকৌশলী পদও এভাবেই তারা পূরণ করেছে। কমিশনের অনুমতি ছাড়া এ পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রনালয় এক হাজার তিনশত পঁচিশটি পদে নিয়োগ দান করেছে। নিয়োগের ৬ মাস অতিবাহিত হবার পর আরো মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে আটশত পঁয়ত্রিশটি পদের ক্ষেত্রে। কমিশন কর্তৃক যে সকল প্রার্থীকে অনুমোদন করা হয়েছে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ স্থগিত রেখে ৬ শত চুয়াত্তর জন কর্মচারী চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নিয়োগবিধির তুলনায় শিক্ষাগত যোগ্যতাহীন কিংবা অধিক ও অল্প বয়সের ৫৫ জনকে বিভিন্ন দপ্তরে এ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে। কমিশন সরকারি চাকরিতে এ ধরনের অনিয়ম দূর করার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সরকারি চাকরির ব্যাপারে এ ধরনের লাগামহীন কাজ অব্যাহত থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। চাকরির ক্ষেত্রে অবশ্যই উপযুক্ততা ও নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলা অপরিহার্য। কিন্তু কর্তৃপক্ষ স্বজনপ্রীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের এ্যাডহক নিয়োগ দান করেছেন তা গোটা চাকরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করতে বাধ্য। কর্ম কমিশন এ ব্যাপারে নীতিমালা মেনে চলার জন্য বিভিন্ন দপ্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আমরা তার সঙ্গে একমত। কর্মকমিশনের নিয়ম মেনে তার অনুমোদন সাপেক্ষে চাকরি হওয়া উচিত। বিশেষতঃ একটি নতুন জাতির প্রশাসন গড়ে তোলার প্রাক্কালে এ ধরনের অনিয়ম নির্ধারণ ক্ষতির কারণ। তাই কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা গ্রহণ করবেন বলে আমরা মনে করি।
এশীয় দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা
একলা চলার দিন আর নেই। সভ্যতা এবং অগ্রগতির সাথে সাথে বাড়ছে পারস্পরিক সহযোগিতার চিন্তা। কেউ আর আজ শুধুমাত্র নিজের সামর্থের ওপর নির্ভর করেই চলে না। বাইরের দুনিয়ায় হাত বাড়াতে হয়, নেয়ার জন্য তার জন্য। এই নেয়া দেয়ার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা, মানুষের অগ্রগতি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রশ্নটিই আজ আর কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। রাজনৈতিক দিক থেকে পারস্পরিকভাবে বিরোধী আদর্শে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক সহযোগিতা হস্ত প্রসারিত করেছে। একদিন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম শুনলে চীনের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব আঁতকে উঠতেন সেই চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেদার অর্থনৈতিক লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে, জাপানের সঙ্গে গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সাথে বৃদ্ধি করছে তার অর্থনৈতিক দেনদরবার। পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র এমনি করে যখন সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে তখন সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকার কথা কেউ ভাবে এমনটিও মনে করার কোন কারণ নেই।
ইরানে সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানকার বেতার ও টেলিভিশন সাক্ষাতকারে এশীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে এশীয় বারোয়ারি বাজার প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে এশীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটা স্থায়ী অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত করে। এশিয়ার অধিকাংশ দেশই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর এবং পরনির্ভর। এই অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠার জন্য প্রচেষ্টার অন্ত নেই। উন্নয়নশীল রাষ্ট্র গুলির সাধারণ চরিত্র অনুযায়ী এই দেশগুলি শিল্পের দিক থেকে অনুন্নত এবং তাদের আর্থিক সঙ্গতি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাদের কাঁচামালের ওপর। উন্নত পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে তাদের শোষণ অব্যাহত রাখতে চায়। এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের একতা এবং সংহতি। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন এর উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহের একতার ওপর জোর দিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশেই সম্মেলনে যোগদানকারী সক্রিয় সদস্য হিসেবে সম্মেলনের সেই বক্তব্য বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
বহু আগে থেকেই আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ও সুপারিশ করে আসছি। সরকার সেই সহযোগিতার ব্যাপারে একমত। ইতিমধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দেয়ার কোনো প্রচেষ্টার নেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এশিয়ার দেশ গুলি নিয়ে একটা বারোয়ারি বাজার প্রতিষ্ঠায় সে পথে বাস্তব পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।
কিন্তু একটা ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার মধ্যে যেন অন্য কোন কালির দাগ আঁচড় কাটতে না পারে। একথা উল্লেখ করছি এই কারনে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অর্থনৈতিক সহযোগিতা কালক্রমে ভিন্ন রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রশ্ন সেখানে অনুপ্রবেশ করেছে। আমাদের মত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহকে এসব ব্যাপারে একটু বেশি মাত্রায় সতর্ক থাকতে হয়। কারণ, ধকলটা সইতে হয় এসব দেশের জনসাধারণকেই সবচাইতে বেশি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক