বাংলার বাণী
ঢাকা: ১লা এপ্রিল, সোমবার, ১৮ই চৈত্র, ১৩৮০
কৃত্রিম এ খাদ্য সংকটের মোকাবিলায়—
খাদ্যের মওজুদ সন্তোষজনক এমনকি বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির ব্যাপারে কোন প্রকার বেগ পেতে হবে না-এমনি সব আশ্বাসবাণী সত্বেও ঢাকাসহ দেশের খাদ্য বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ‘রেস’ অপ্রতিহত রয়েছে। এর সঙ্গে নতুন উপসর্গ যেটা দেখা দিয়েছে সেটার হল বাজার থেকে চাল উধাও। দোকানে দোকানে ঘুরে এক ছটাক চাল মিলছেনা এমনি নানা অভিযোগ ক্রেতা সাধারণের নিকট থেকে আসছে।
খাদ্যের ব্যাপারটা এমনি গুরুত্বপূর্ণ যে, ইতিমধ্যে নানা মহলে এ নিয়ে প্রচণ্ড শংকা সংশয় প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে মওজুদ খাদ্যের আশ্বাস এবং পাশাপাশি বাজারে তার অপ্রতুলতা দ্বিধা সন্দেহের উদ্রেক করেছে। স্বার্থদ্বেষী মহল থেকে ছড়ানো হচ্ছে আজগুবি নানা তথ্য। এবং সবচাইতে বিস্ময়কর যা তা হল সেই আজগুবি তথ্যসমূহকে ‘ফলো’ করে বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরা খাদ্য বাজারকেও সেইদিকেই পরিচালিত করছেন।
খাদ্য সমস্যা দ্রুত অবনতিশীল চিত্র মানুষের মনে হতাশা এবং আতঙ্ক ভাব এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে যে সে চিত্রে কোন বিপরিত অবস্থা মানুষের চোখের সামনে ধরা না পড়লে হয়তো বা এই সমস্যাই একটা ভয়াবহ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্যমন্ত্রী বর্তমান খাদ্য সংকট কৃত্রিম বলে অভিহিত করেছেন। আমরা খাদ্য মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, দেশে খাদ্য মওজুদ সন্তোষজনক তার সঙ্গেও আমরা দ্বিমত পোষণ করি না। কিন্তু যদি কেউ এই সমস্যাকে হালকাভাবে গ্রহণ করেন অথবা এই সমস্যার মোকাবিলায় কোন সহজ হাতিয়ার ব্যবহার করার কথা চিন্তা করেন তবে তাদের সঙ্গে আমরা কোনো অবস্থায়ই একমত হতে পারি না।
দেশে খাদ্য আছে এবং তা মওজুত রয়েছে এক শ্রেণীর মজুতদারদের হাতে। আমাদের বিশ্বাস এ সত্যের বিরোধীতা কেউই করবেন না। সুতরাং মওজুত চাল তথা চালের বাজার যেহেতু মজুতদারদের হাতে সেহেতু সেই বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অনিবার্যভাবেই সরকারকে সেই সকল মজুতদারদের মোকাবিলায় অত্যন্ত শক্ত হাতে অগ্রসর হতে হবে। এটা স্মরণ রাখতে হবে বর্তমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা গণবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তারা কম শক্তিশালী নন। সরকারি প্রশাসন এবং শাসকদলের তাদের প্রভাব অস্বীকার করবার উপায় নেই। আইন এবং সরকারের চোখকে এড়িয়ে অথবা তাদের দিক থেকে সরকারের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে যারা খাদ্যশস্য মওজুত করতে পেরেছেন, সম্ভাব্য সরকারি কোনো কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহণের বিরুদ্ধেও যে তারা তাদের প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করবেন না এমন কথা ভাবা ঠিক হবে না।
কিছুদিন আগে বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের মওজুতদারদের বিরুদ্ধে সরকারি যে অভিযান শুরু হয়েছিল তার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কেউ বিস্মৃরিত হননি। আমরা সেই অভিযান সহ দুষ্কৃতিকারী, চোরাচালানী এবং দুর্নীতিবিরোধী নানা অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি যতদিন পর্যন্ত সরকারি প্রশাসন এবং শাসক দল থেকে এদের ‘প্রোটেকটর’দের সরানো না যাবে; যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক এবং অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে মওজুতদার, চোরাচালানী, দুষ্কৃতিকারী এবং সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয়দান অব্যাহত থাকবে ততদিন পর্যন্ত এসকল সামাজিক শত্রুদের বিরুদ্ধে কোনো সরকারী অভিযানই প্রাথিত সুফল লাভ করতে পারবে না।
এ ব্যাপারে অত্যন্তঃ ন্যূনতম দেশপ্রেমও যাদের মধ্যে রয়েছে সেই সকল রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সংগঠনকে অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য সমস্যা আর দশটি সমস্যার মতো এমন সমস্যার নয় যে সেই সমস্যার ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে ব্রতী হবেন। যদিও তেমন লোকের অভাব আমাদের দেশের নেই তবুও বর্তমান সঙ্কট মুহূর্তে আমরা সুবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষের কাছে আহ্বান জানাব অন্ততঃ এই একটি ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা সমস্যার মোকাবিলায় এগিয়ে আসবেন।
খাদ্যমন্ত্রী নিজেই যখন বলেছেন এটা একটা কৃত্রিম সমস্যা তখন স্বভাবতঃই মনে করা চলে আন্তরিকতার সঙ্গে সরকার এবং সরকার বিরোধী দেশপ্রেমী শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে সে সমস্যা মোকাবেলায় করা সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা সরকারকে একটি ব্যাপারে সতর্ক করে দিতে চাই। শুধু মুনাফা অর্জনের স্বার্থেই যে খাদ্য সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে এই সহজ উপলব্ধিটা বাস্তব ক্ষেত্রে সত্য নাও হতে পারে। খাদ্য সংকট সৃষ্টির পেছনে আরো নানারকম শক্তি সক্রিয় থাকতে পারে। কারণ বর্তমান এই নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং আমরা বহু আগে থেকে যা বলে আসছি সেই চুয়াত্তর এই ‘ডিসিসিভ ইয়ার’-এ খাদ্য সংকটকে রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক মতলববাজি স্বার্থ পরিচালিত করা যেতে পারে। আমরা সরকারকে সব দিকে সতর্ক নজর রেখে বর্তমানে কৃত্রিম খাদ্য সংকট অত্যন্ত বাস্তবতার সঙ্গে মোকাবিলা আহ্বান জানাচ্ছি। সফলতার সঙ্গে এই সংকট মোকাবিলা ভবিষ্যতে মতলববাজদের আরো কিছু কৃত্রিম সমস্যা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
বেসরকারি যানবাহন চলাচলে অচলাবস্থা
অবিলম্বে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করা না হলে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি যানবাহন অচল হয়ে পড়বে। গত পরশু ঢাকা মোটর ভেহিকেলস গ্রুপের নেতৃবৃন্দ এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মোটর ভেহিকেলস গ্রুপের নেতৃবৃন্দ বেসরকারি যানবাহনের বিবিধ সংকট ও সমস্যাবলী চিত্র তুলে ধরে সরকারের কাছে পরিমিত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান সামগ্রিক নিশ্চিত সরবরাহে প্রয়োজনে আমদানি লাইসেন্স প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, যন্ত্রাংশের অভাবে বেসরকারি যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে এক মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে। যন্ত্রাংশ টায়ার এবং ডিজেল সরবরাহ যদি অনিয়মিত হয়ে পড়ে তাহলে আগামী ছ’মাসের মধ্যে ঢাকা মোটর ভিকেলস গ্রুপের এক হাজার ট্রাক ও পাঁচশো বাসের শতকরা ৭৫ ভাগ বাস এবং ট্রাক অচল হয়ে পড়বে। যন্ত্রাংশ এবং ডিজেলের অভাবে ইতিমধ্যেই শতকরা প্রায় ৩৫টি পুরনো বাস ও ৩৫টি ট্রাক অচল হয়ে পড়েছে। মোটর ভেহিকেলস কর্মকর্তারা তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন যে, বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ প্রয়োজন। সরকারের কাছে এজন্যে আমদানি লাইসেন্স প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি পক্ষ থেকে নাকি কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের আমদানি নীতিতে ঢাকা মোটর ভেহিকেলস গ্রুপকে নাকি কোন যন্ত্রাংশ আমদানির অধিকার দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ উচ্চারণ করা হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এগারো জন প্রাইভেট ডিলারকে বাস ও ট্রাকের যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য ২ লাখ টাকার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকা মোটর ভেহিকেলস ওই যন্ত্রাংশ পাচ্ছেন না। জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে টিসিবি ঢাকা মোটর ভেহিকেলস গ্রুপকে মাত্র এক হাজার টায়ার-টিউব দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর কোন প্রয়োজনীয় উপাদান মোটর ভেহিকেলস গ্রুপকে দেয়া হয়নি। সাংবাদিক সম্মেলনে ঢাকা মোটর ভেহিকেলস গ্রুপের নেতৃবৃন্দ বেসরকারি যানবাহন চলাচলের যে সীমাহীন সংকটের চিত্র তুলে ধরেছেন তা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। নইলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচিরেই যে একটা চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ এবং জ্বালানির পরিমিত যোগান দেয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন জরুরী ভিত্তিতে করা উচিত। ফেরিঘাটের অবস্থা এবং ফেরি অসাম্যও দূর করতে হবে। জ্বালানির অভাবে যেন ভেজাল জ্বালানি ব্যবহার করতে না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সড়কের দু’পাশে বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে বলে মোটর ভেহিকেলস গ্রুপের নেতৃবৃন্দ তথ্য প্রকাশ করেন। এ কথা সত্য যে, বেসরকারি যানবাহন চলাচল সচল রাখার জন্য অবিলম্বে যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান আমদানি লাইসেন্স প্রদানের দাবি অযৌক্তিক নয়। যেখানে ২৮ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ আমদানি আবশ্যক সেখানে যদি এক পয়সারও লাইসেন্স বরাদ্দ না করা হয়, তাহলে বেসরকারি যানবাহন সংগত কারণেই অচল হয়ে পড়বে। তাছাড়া ডিজেল-পেট্রোল ও মোবিল সংকটও চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ন্যায্য মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না, কাল বাজারে যা ও বা পাওয়া যাচ্ছে তাও ভেজাল ডিজেল। ফলে ক্ষতি হচ্ছে ইঞ্জিনের। যন্ত্রাংশ এবং তেলের যদি এরকম অবস্থা বিরাজিত থাকে তাহলে বেসরকারি সড়ক পরিবহন সম্পূর্ণরূপে পঙ্গু ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে। এবং দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি এভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে তাহলে জাতীয় অর্থনীতির দুরবস্থা হবে না। অতএব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাই। নইলে সরকারি যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা কিছুতেই দূরীভূত হবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক