You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.06.18 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সমবায়কে দুর্নীতি মুক্তকরণ | বার্মায় বিপদের সংকেত | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৮ই জুন, বুধবার, ৪ঠা আষাঢ়, ১৩৮১

সমবায়কে দুর্নীতি মুক্তকরণ

আইনের জালে সমবায় সমিতিতে ছেঁকে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে এবার। গত সোমবার এর জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সমবায় সমিতি সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। এই সংশোধনী বিলে ১৯৪০ সালের সমবায় সমিতি আইন এর ব্যাপক সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৪০ সালের এই আইন বলে রেজিস্ট্রিকৃত কিছু ব্যাঙ্ক আইনের বরখেলাপ করে সমবায়ের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে এবং কতিপয় সমবায় সমিতির ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও সমিতির স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলি থেকে সমবায়কে মুক্ত করা এবং সমবায়রক সাধারণ মানুষের কল্যাণের কাজে নিয়োজিত করা এই সংশোধনী বিলের উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করা হয়।
আমরা জানি সমবায় সংগঠন আজ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের অন্যতম অপরিহার্য মাধ্যম। আর সমবায় বা সমবেত চেষ্টার মাধ্যমে কাজ করার প্রেরণা মানুষের সহজাত। আদিম ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে গিয়ে যৌথ চেষ্টা ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে মানব জাতির কল্যাণ সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার স্বার্থে সমাজ গঠন করা তারই ফলশ্রুতি। মনীষীরা তাই বলে থাকেন ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’ সবার স্বার্থে সমঝোতার চেষ্টায় যে কাজ হাত দেওয়া হয় তার কল্যাণ ও যেমন বহু ভোগ্য এবং অকল্যাণ তেমনি বহুজনের দুর্ভাগ্যের কারণে।
উন্নয়নশীল দেশ ও সমাজের ভূমিকা অপরিসীম আঞ্চলিক চাহিদার ভিত্তিতে বা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে সমবায় সমিতি এদের কাজ বৃহত্তর ক্ষেত্রে নিরীহ সাধারণ মানুষের যোগাযোগ রক্ষা করা। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও পণ্যদ্রব্য দিতে যথাযথ বিতরনের সহায়তা দেওয়া যৌথ প্রচেষ্টায় সঠিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে অংশ নেয়া এবং সুলভ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সুষম বন্টনের সক্রিয় তৎপরতা রাখা।
বাংলাদেশ বহু সমবায় সমিতি আছে বিভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চাহিদাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমিতিগুলি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দেশীয় সমবায় সমিতি গুলি তাদের বৃহত্তর মানুষটাকে ভূলে গিয়ে সমবায়ের নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে সমবায়ের নামে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করতে বেশি তৎপর। সমবায় সমিতির নামে চলে বেপরোয়া মুনাফা লুটার ব্যবসা। শিল্পক্ষেত্রে, কৃষি ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বত্র এক অবস্থা। জনসাধারণের চোখে আজ সমবায় সমিতির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির কেন্দ্র।
শুধু তাই নয়, দেশে বর্তমানে অসংখ্য ভুয়ো সমবায় সমিতি আছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রের অভিযোগ প্রকাশ। কোন মহৎ পরিকল্পনা বা বাস্তব কাজের উদ্দেশ্য সামনের না রেখেই অত্যন্ত সচেতন ভাবে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি সমবায়ের নামে নতুন ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। এমনও সমবায় সমিতি আছে যার সদস্য সংখ্যা ৩ থেকে ৫ জনও আছে। সরকারি জিনিসপত্র ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করে এরা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু কার্যত দেখা যায় সমবায় সমিতির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অন্যায় ভাবে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে আর সাধারন মানুষের দুর্দশা সীমাহীন দুর্গতির মুখে নেমে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের রকেট গতি দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা এবং পাচারকারীদের তৎপরতার মূলেও সমবায় সমিতির প্রত্যক্ষ ভাগবাটোয়ারার সম্পর্ক আছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। কারণ তাদের হাতে পর্যাপ্ত মালপত্র পৌঁছানোর অবৈধ সিদ্ধ পথের অন্যতম প্রধান সূত্র সমবায় সমিতি গুলো।
এবার সমবায় সমিতি সংশোধনী যে বিলটি পাস হয়েছে তার দ্বারা সরকার এখন যথাযথ তদন্তের পর প্রয়োজনবোধে কোন সমিতির ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করতে পারবেন বা কোনো সদস্যকে অপসারণ করতে পারবেন। তবে তার আগে তাদেরকে নিজ বক্তব্য পেশ করার সুযোগও দেয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
দেশের সার্বিক স্বার্থেই সমবায় সমিতির গুরুত্বকে আমরা স্বীকার করেছি এবং করছি কিন্তু তা বলে কোন অবস্থাতেই কোন সংস্থা মানব কল্যাণমূলক তথা রাজ্য কল্যাণমূলক কাজের নামের দুর্নীতির চর্চা করবেন এ বরদাস্ত করা যায় না। এই সংশোধনী বিলের দুর্নীতি দূরীকরণের যে পদক্ষেপ নেয়া হলো তার প্রতি আমাদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি। কিন্তু সেই সঙ্গে গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রত্যাশা করব সমবায় সমিতি এবার তাদের ন্যায্য ভূমিকা পালন করে দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মসূচি বিতরণ ও সরবরাহ সমস্যা দূরীকরণ ও কুটির শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে সহায়তা দিবে।

বার্মায় বিপদের সংকেত

পৃথিবীর সর্বত্রই কিছু-না-কিছু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারকে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে হয়েছে। বিশ্বে এমন কতগুলো ঘটনা ঘটেছে যার প্রতিক্রিয়ায় অনিবার্যভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। প্রত্যেকটি সরকারকে আজ এক নাজুক অবস্থায় পড়তে হয়েছে। উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করে তাদের অগ্রসর হতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী একারণে তাই চলছে এক নিদারুন মুদ্রাস্ফীতি। স্ব স্ব সরকার এই মুদ্রাস্ফীতির রোধের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টার লিপ্ত। জাপানে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ২৪.১ ভাগ, ডেনমার্কে বেড়েছে ১৪.৬ ভাগ, ব্রিটেনে বেড়েছে ১০.২ ভাগ, ইটালিতে ১২.৬ ভাগ, ফ্রান্সে ১০.১ ভাগ, সুইজারল্যান্ডের ১০.৮ ভাগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৭ ভাগ, সুইডেনে ৮.২ ভাগ, বেলজিয়ামে ৭.১ ভাগ এবং পশ্চিম জার্মানিতে ৭.৫০ ভাগ। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে তা হলঃ নেদারল্যান্ডের ১০ ভাগ, নরওয়েতে ৯ ভাগ, ইটালিতে ১৬ থেকে ১৮ ভাগ। তাছাড়া বড় বড় দেশগুলোর অধিকাংশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি চলছে এবং উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের দেশের রাজনীতির উপর মারাত্মক আঘাত হানছে। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বহুলাংশে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এর ওঠানামার সঙ্গে রাজনীতির ভালো-মন্দের একটা সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্যেকটি সরকার আজ এই সমস্যার মধ্যে পতিত হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দিক থেকে মারাত্মক আঘাত আসছে। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বার্মায় এক বিরাট কোনো অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। খবরে জানা গেছে, উত্তর বার্মায় শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিপুল সংখ্যক ফ্যাক্টরি মিল বন্ধ হয়ে যায়। ধর্মঘটী শ্রমিকদের দাবি ছিল বর্ধিত হারে মজুরি ও খাবার দেওয়া। এই ধর্মঘট অসম্ভব তীব্র হয়ে ওঠে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ধর্মঘটের বার্মার প্রেসিডেন্ট উইনের ব্যক্তিগত ও তার শাসন সম্পর্কে কোন দ্বিমত পোষণ করেননি।
জানা গেছে-বার্মায় এখন খাদ্য সমস্যা বিশেষ করে চাল এর সমস্যা অত্যন্ত তীব্র। প্রতিদিন খাদ্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সমাধান করতে হলে বাজারে অধিক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য বাড়াতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বার্মার কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা হল ১ কোটি দশ লাখ। এরমধ্যে এগারো লাখ বিশ হাজারের মতো শ্রমিক। এদের বৃহত্তর অংশ রাজধানী রেঙ্গুনে থাকে এবং তারা যেকোনো সময় সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে। বর্তমানে বার্মার রপ্তানি বাণিজ্য কমে গেছে। সে কারণে আমদানি বাণিজ্য কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বার্মার রাজনীতি সব সময় বিদেশী শক্তির প্রভাব এড়িয়ে চলতে সচেতন। বিদেশি সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারেও তারা অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। প্রেসিডেন্ট নে-উইন তার জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নীতিতে অটল। সাম্প্রতিককালের দ্রব্যমূল্য জনিত কারণে বার্মায় যে ধর্মঘট শুরু হয়েছে তাকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়েছে; সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত আটই জুন সেনাবাহিনীর গুলিতে তেইশ জন ধর্মঘটী নিহত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নে-উইন তার গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর বাতিল করে দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বের সকল উন্নয়নকামী দেশের রাজনীতির আজ এমনই একটি দুর্বিপাকের দিকে মোড় নিচ্ছে। এর মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যেকটি সরকারের উচিত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সময় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিভিন্ন প্রকার অনাচার-অবিচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কেন না এমনিতেই অনিবার্যভাবে যে দুঃখ-কষ্ট এসে জাতিদের গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। আবার একশ্রেণীর লোকের অভিসন্ধিতে দুঃখ-কষ্ট আরো তীব্র আকার ধারণ করছে। তাই এই বিশেষ সুযোগ সন্ধানী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সঠিক সময় মতো ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। নইলে অনিবার্যভাবে যে দুঃখ দেখা দেয় তাকে জনসাধারণ সঠিক উপলব্ধি করতে পারে না। তারা ভাবে ঐসকল সুবিধাবাদীদের জন্য এবং তাদের লালনকারীদের জন্যেই এত দুর্ভোগ। অতএব বার্মার মত বিপদের সংকেত দেখা দেওয়ার পূর্বেই প্রত্যেকটি উন্নয়নকামী দেশের সরকারকে সতর্ক হওয়া জাতীয় স্বার্থে এমনকি তাদের নিজেদের স্বার্থেই আবশ্যক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন