বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৭ই জুন, মঙ্গলবার, ৩রা আষাঢ়, ১৩৮১
চোরাচালান বন্ধ করতে হবে!
মাল পাচারের অভিযোগ আজ নতুন নয়। বাংলাদেশের বিস্তৃত সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে মাল লেনদেনের বহু অভিযোগ এ যাবত পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। গত সোমবার দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা বাংলাদেশ বার্মা সীমান্তে চোরাচালান সম্পর্কিত এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় যে, একটি সঙ্ঘবদ্ধ চোরাচালানির দল প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার পণ্য দ্রব্য সীমান্তের ওপারে পাচার করে দিচ্ছে পাচারকৃত দ্রব্যের মধ্যে আছে দেশীয় নাইলন ও আমেরিকান টায়ার কাট সুতো, সয়াবিন তেল, ঔষধ ইত্যাদি। ওষুধের মধ্যে ম্যালেরিয়া নিবারক বরি কুইনাইন চর্মরোগ নাশক ওষুধ ফুলসিন ফোর্ট ও টেটালাইক্লিন সহ সকল প্রকার জীবনরক্ষকারী ওষুধ।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ আছে যে চোরাচালানের তীর্থকেন্দ্র হচ্ছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপপুঞ্জ টেকনাফের হোয়াই কং, নীলা ও শাহপুরী দিয়ে পণ্যদ্রব্য পাড়ে পৌছায়। এইসব স্থান থেকে বার্মার সীমান্তে দূরত্ব খুবই কম এছাড়া বাঁশখালী এবং কক্সবাজার থেকে সাম্পান বোঝাই পণ্যদ্রব্য সেন্টমার্টিন হয়ে চলে যায় ওপারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, টেকনাফ থানা থেকে জলপথে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৮ মাইল। বলা যায় সেন্টমার্টিন টেকনাফ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আবার সেন্ট মার্টিন থেকে বার্মার আকিয়াব শহরের দূরত্ব হলো ৬০ মাইল। এ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য চোরাকারবারীরা ইঞ্জিনচালিত দ্রুতগামী নৌকা ব্যবহার করে। সংবাদ সূত্র আরো জানায় যে, সাতকানিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ৪/৫ টি চেকপোস্ট আছে চোরাকারবারীরা বাসে ট্রাকে করে মালামাল বহন করে করার সময় চেকপোস্টের আগেই নেমে পড়ে। অতঃপর চেকপোস্ট সংলগ্ন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় অঞ্চল দিয়ে কিছুটা পথ পার হয়ে আবার চেকপোস্টের ওপারে গিয়ে ট্রাকে বা বাসে চড়ে এবং এরা এককভাবে এ কাজ করে না। সংঘবদ্ধভাবে শক্তিশালী চক্রের ইঙ্গিতে কাজ করে। চোরাকারবারীদের মাথা মুরব্বীদের বাস নাকি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চারতলা আবাসিক হোটেলে। বিশ্বস্ত সূত্রের উল্লেখ করে প্রতিবেদনে এ পর্যন্ত জানানো হয়েছে।
আমরা জানি গোটা দেশটাই হয়েছে আজ ফুটো কলসি। চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য সব কিছুই আমদানি করা হয়। অথচ ক্রেতাসাধারণের হাতে (ন্যায্য দামের তো প্রশ্নই ওঠে না) তা পৌঁছে না। সয়াবিন সরবরাহের অভাবে রেশনে পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়না অথচ তার চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। ওষুধের অভাবে জীবন রক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষা করা দুষ্কর। অথচ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সব চলে যাচ্ছে আঁধারের জীবদের হাতে। রাজধানী শহরের কোথাও আজ চোখের ড্রপ পাওয়া যায়না। মাঝে মাঝে বেদনানাশক ওষুধ ও এন্টাসিড বড়িও অমিল হয়ে যায়। বাংলাদেশে ব্যাপক ওষুধ সংকট এর পেছনে এই বেশুমার পাচারই প্রধান কারণ।
চোরাচালান শুধু যে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন সীমান্ত দিয়েই হচ্ছে তা নয়। স্থলসীমানা বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ব্যাপকহারে ধান, চাল, পাট, সুপারি ইত্যাদি প্রতিদিন পাচার হয়ে যাচ্ছে। এবং কোটি কোটি টাকা মূল্যের দেশীয় সম্পদ এভাবে বেহাত হয়ে দেশের অর্থনীতিকে আরো ধ্বংসের পথে ঠেলছে। সাম্প্রতিককালের যৌথ অভিযানে কিছু কিছু চোরাচালানী অবশ্য ধরা পড়েছে। কিন্তু সেসব চুনোপুটি রাঘববোয়ালরা তেমনি সুখে আছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এমন একটা কেন্দ্রে আছে যার তিন পাশেই আছে ভারত ও বার্মার সীমান্ত। শত শত মাইল বিস্তৃত এই সীমান্ত এলাকাকে সুরক্ষিত রাখা কষ্টকর বটে। তবে অসাধ্য বা অসম্ভব নয়, অতীতে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সুদীর্ঘ এই সীমান্ত পথের চোরাচালান তখনও ছিল কিন্তু তখন দেশপ্রেম না থাকলেও ভয় ছিল। আর আজ কোনটাই নেই। তফাৎটা হল এইখানে।
জলপথে চোরাচালান প্রসঙ্গে অভিযোগ যে, উল্লেখযোগ্য কোনো টহলদারি গানবোটের ব্যবস্থা নেই যারা চোরাচালানকে প্রতিরোধ করবে। অন্যান্য চোরাপথ সম্পর্কেও ওই একই অভিযোগ সীমান্ত প্রহরার উল্লেখযোগ্য লক্ষী থাকে না। এনিয়ে পত্রিকান্তরে মাধ্যমে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও নৈরাজ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল। কারণ চোরাচালান বন্ধ না করলে দেশের উন্নতি হতে পারে না। যেমন দেহের কোথাও পচন পুষে রেখে সুস্থ থাকা যায় না ঠিক তেমনি।
সন্ত্রাসবাদি তৎপরতা
হিংসার অপদেবতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাজার লুট, রেলস্টেশন আক্রমণ, শহরে বন্দরে বোমাবাজি, বেশ কমাস বন্ধ থাকার পর পুনরায় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই বোমাবাজির শিকারে পরিণত হয়ে কজন আহত হয়েছেন, জনৈক সাংবাদিক বাদ পড়েননি হিংসাশ্রয়ী তৎপরতা লক্ষ্য থেকে। পনেরো, ষোল, সতেরো এই তিন দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এবং লৌহজং বাজার দুটি লুট হয়েছে গত রোববার। পনেরই জুন রাত দেড়টায় আশীজন সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ত্রিশাল থানার তামিম নগর রেলওয়ে স্টেশন আক্রমন করে তারা স্টেশনের সমস্ত ভারী যন্ত্রপাতি ধ্বংস এবং স্টেশনটিকে তছনছ করে দেয়।
গত উনত্রিশ মাস ধরেই একশ্রেণীর লোক সময়-সুযোগমতো ওই হিংসাত্মক তৎপরতা চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় এদের দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও তা সফল হতে পারেনি। থানা লুটের খবর ইদানিং পাওয়া না গেলেও গত বছরের শেষের দিকে তারা থানা এবং পুলিশ ফাঁড়ি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা আর কোনদিন দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখা দরকার যারা এই সকল হিংসাত্মক তৎপরতায় অংশগ্রহণ করে তারা সবাই এক গোত্রের নয়। এক উদ্দেশ্য নিয়ে তারা বাজার লুট অথবা থানা আক্রমণ করে না। এদের মধ্যে রয়েছে সত্যিকারের ক্রিমিনাল, ডাকাত লুটেরা আবার রয়েছে বিভ্রান্ত হঠকারী রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী তরুণের দল। এই দুই শ্রেণীর লোককে এভাবে মোকাবিলা করার নীতি অনুসরণ করলে তা খুব একটা সাফল্য আনতে পারে না। ক্রিমিনাল ডাকাতদের পরিচয় তারা ক্রিমিনালই। সে তারা যে স্লোগানই সামনে এনে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চান না কেন। বলিষ্ঠ প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের নির্মূল করা সম্ভব। হঠকারী এবং বিভ্রান্ত তরুণদের মোকাবিলার জন্য কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে এগিয়ে আসার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ যে কোন প্রকার সামাজিক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয় না সে কথাটি তাদের উপলব্ধি করতে হবে। জনগণকে সংগঠিত করতে হবে এদের প্রতিরোধে।
যুগে যুগে এই ভ্রান্তপথের অনুসারী হয়েছেন অনেকেই। তাদেরই একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পরবর্তীকালে অংশ পরবর্তীকালে তাদের সূত্র বুঝতে পেরে হিংসাত্মক তৎপরতা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। পরোক্ষভাবে যে সন্ত্রাসবাদ প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী শক্তিকেই মদদ যুগিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত ভুরিভুরি উপস্থাপন করা যায়।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে সামাজিক প্রগতির স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়ার জন্য চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী শক্তিসমূহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং গণহত্যা ও সন্ত্রাস জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা চালায়। হঠকারী উগ্র বামপন্থীদের কর্মকাণ্ড সেই প্রতিক্রিয়াশীলদের উদ্দেশ্য সাধনে যথেষ্ট সহায়ক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। চরমপন্থীদের একাংশ প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আশ্রয় গ্রহণ করেছে আর একাংশ হাত মিলিয়েছে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে। তাদের এই অবৈধ যোগসাজশে তারা যে কর্ম সাধন করে চলেছেন তা আর যাই হোক দেশের জন্য মঙ্গলকর হতে পারে না।
সরকারকে এ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। গত তিন দিনে বিভিন্ন সংবাদপত্র অফিসের সামনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। সংবাদপত্র অফিসের সামনে আজই যে প্রথম বোমাবাজি করা হলো তা নয় বরং এর আগেও বেশ ক’বার তারা পত্রিকা অফিসের সামনে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ‘বাংলার বাণী’ অফিসের সামনেও গ্রেনেড এবং হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। আমরা সেদিনও যেমন এই বোমাবাজির নিন্দে করেছিলাম আজও করছি। গণতান্ত্রিক দেশের নিজ নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই রয়েছে। হুমকি দিয়ে অথবা বোমাবাজি করে সেই স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। যারা এই চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা ভুল পথে অগ্রসর হয়েছেন। আমরা তাদের কাছে আবেদন জানাব হুমকি-ধামকি অথবা বোমাবাজি নয় বরং নিজেদের বক্তব্য গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী জনগণের সামনে পেশ করুন। অযথা হত্যা সন্ত্রাস চালিয়ে কিছু লোকের জীবনহানি করা যায় বাজার লুট করে গরিব ছোট ছোট দোকানদারদের সর্বস্ব অপহরণ করা যায়। জমির ধান কেটে একজন কৃষকের সর্বস্বান্ত করা যায় কিন্তু জাতির পক্ষে কল্যাণকর কিছু করা যায় না। এদেশে কেন বিদেশেও এ পথ অনুসরণ করে বহু তরুণ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ব্যাপক হতাশা আর নৈরাজ্যের মধ্যে পতিত হয়েছে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণও, কিন্তু সামাজিক অথবা রাজনৈতিক পরিবর্তন আনয়নে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশেও তার তারা সফল সফল হবেন না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক