You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৫ মার্চ ১৯৭১ঃ কলকাতার পথে তাজউদ্দীন

স্থান ৭৫১ নং সাতমসজিদ রোড, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা। পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ছিল রাত ১১টার আগেই নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে যাব এবং নির্ধারিত গন্তব্য স্থানের উদ্দেশে রওনা দেব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। এদিকে একটি কাপড়ের থলেতে প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিস রাখা ছিল, সেই থলেটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখন চরম উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছি। এক সময় বলেই ফেললাম, এক মিনিটও যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে বাড়িতে রয়ে যাওয়া, এই দীর্ঘ সময়ের অপচয় নিশ্চয়ই আমার নির্ঘাত মৃত্যুরই ইঙ্গিত বহন করছে।  এমন সময় আমাদের দোতলার ভাড়াটে, আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য ও একনিষ্ঠ সমর্থক আব্দুল আজিজ বাগমার আমার সামনে এগিয়ে এসে বললেন, আমরা সামরিক বাহিনীকে প্রতিহত করব। আমি বললাম, সেটা তো আরো পরের কথা। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে পারলে উচিত শিক্ষা হতো। বিভিন্নমুখী চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে আমি বলেই ফেললাম, আর কোথাও যাব না। কিন্তু এটা আমার উত্তেজনার কথাই ছিল, সিদ্ধান্তের নয়। আমি মন ঠিক করে ফেলেছি, যেতে আমাকে হবেই। বাংলাদেশ ও জাতির এই চরম দুর্যোগের মোকাবিলা করতেই হবে।  আমি বেরিয়ে পড়ব এমন সময় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন এলেন। তারা বললেন, শহরের পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। কয়েক মিনিট কথা বলে আমরা তিনজন একসঙ্গে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে আমি শুধু আমার স্ত্রীকে বলে গেলাম, ‘আমি যাচ্ছি, আর্মি আসছে, তোমরা যেখানে পার চলে যেও।’  বাসা থেকে পথে নেমে দেখি ততক্ষণে সমস্ত পথঘাট আওয়ামী লীগ কর্মীরা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে প্রতিবন্ধকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব বেশি দূর যেতে পারিনি।  গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। ড. কামাল হোসেন বললেন, একসঙ্গে তিনজন থাকা নিরাপদ নয়। তিনি এখানেই তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে নেমে যাবেন। পরে আবার মিলিত হবেন। ড. কামাল হোসেনকে ধানমণ্ডিতে তার আত্মীয়ের বাড়িতে নামিয়ে, আমীর উল ইসলাম এবং আমি সাতমসজিদ রোডের দক্ষিণে পিলখানার দিকে কিছু এগিয়ে আবার ঘুরে উত্তরে লালমাটিয়ার দিকে পৌঁছেই দেখতে পেলাম মোহাম্মদপুর এবং মানিক মিয়া এভিনিউয়ের দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে। সামনে এগিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হলো না। পথের পাশেই একজন পরিচিত ভদ্রলোকের বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়ির মালিক জনাব আব্দুল গফুর (ইঞ্জিনিয়ার)। এই বাড়ির পাশের বাড়িই ছিল সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর। সেখান থেকে ছেলেদের ডাকা হলো। তাদের পতাকা নামিয়ে অফিস বন্ধ করে দিতে বললাম। আরো বললাম, সেনাবাহিনী আসছে, সংগ্রাম পরিষদের অফিস বুঝতে পারলে এখানকার সব শেষ করে দেবে।

প্রতিরোধ করবার মতো শক্তি এখন আমাদের হাতে নেই। সময়ের প্রয়োজন আছে। তাই সেই সময় পর্যন্ত আমাদের সাবধানে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা নির্দেশ মেনে নিল।  এদিকে চারদিক থেকে আক্রমণের ভয়াবহ শব্দে আমার ধারণা হলো সামরিক বাহিনী আগামীকাল নদীর ঘাটে, স্টেশনে অনেক লোক মারবে। কারণ, শহর ছেড়ে যেতে হলে ওই দুটো পথেরই আশ্রয় নিতে হয়। আমি তখন ভাবছি, এ পথ বন্ধুর, এ পথ ভারি কঠিন। স্বাধীনতার ‘সূর্য’ বহু রক্ত চায়। কারণ তার আবির্ভাবের রংও রক্তিম। এদিকে আমরা বুঝতে পারছি এখানে কোনো নিরাপত্তা নেই। যে কোনো মুহূর্তে সেনাবাহিনীর লোক এসে পড়তে পারে। তাই প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে আমরা ঠিক করলাম আমাদের দুজনের নাম পাল্টে ফেলব। আমার নাম তাজউদ্দীন আহমদের পরিবর্তে হবে মোজাফফর হোসেন এবং আমীর-উল ইসলামের নাম রহমত আলী। আরও ঠিক করলাম আমরা যথাক্রমে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে ঠিকাদারের অধীনে চাকরি করি। মালিকের বাড়ি কুষ্টিয়া। টাকার জন্য ঢাকায় এসেছি কিন্তু গণ্ডগোলের কারণে মালিকের বাড়ি যেতে পারিনি, তাই এখানে আশ্রয় নিয়েছি। আপাতত আমাদের এই পরিকল্পনাই স্থির রইল। তারপর সারারাত আমরা গুলির শব্দ শুনলাম এবং আগুনের লেলিহান শিখা প্রত্যক্ষ করলাম। সামনে একটু দূরেই ছিল বস্তি। আমার ধারণা হয়েছিল এখানেও আক্রমণ হবে কারণ বর্বরদের হাতে বস্তি কিংবা বস্তির মানুষ রেহাই পাবার কথা নয়।
নোটঃ রওয়ানা দেয়ার সময় তাজউদ্দীনের কাছে একটি রাইফেল ও একটি পিস্তল ছিল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!