বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩১শে মে, শুক্রবার, ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
বাংলাদেশ সেনেগাল যুক্ত ইশতেহার
সেনেগালের প্রেসিডেন্ট মিঃ লিওপোল্ড সেদার সেনঘর তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত রোববার ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বিভিন্ন বৈঠকে যোগদান ও আলাপ-আলোচনা শেষ করে মহামান্য অতিথি গত পরশুদিন স্বদেশের পথে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ ও সেনেগালের সরকারপ্রধানদের মধ্যে তিন দিন ধরে যে সকল সহযোগিতামূলক আলাপ আলোচনা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তি ইশতেহারে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেদার সেনঘর এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন যে, উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আফ্রিকার জনগণের সংগ্রামের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। সেনেগালের রাজধানী ডাকার ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পক্ষ থেকে একসঙ্গে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে আরো বলা হয়েছে যে, আরবদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি দু’দেশের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি স্থাপনের পদক্ষেপ হিসেবে আরব ভূমি থেকে ইসরাইলের সৈন্য প্রত্যাহার এবং প্যালেস্টাইনীদের ন্যায্য অধিকার মেনে নেয়া উচিত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহের মধ্যে ঐক্য ও বন্ধুদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহের বিনিময় বাণিজ্য জোরদার ও চিন্তা কর্ম পদ্ধতি সমন্বয় সাধনের কথাও বলা হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলী কার্যকর করার স্বপক্ষেও জোর অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। সেনেগাল ও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশ্বের মুক্তিকামী দেশগুলোর স্বপক্ষে দুই নেতা অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক বৈষম্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতায় দূর করার জন্য কাজ করে যাওয়া উচিত বলে উভয় নেতা একমত হয়েছেন। উপমহাদেশের শান্তি ও সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের আন্তরিকতা উল্লেখ করে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট প্রশংসা করেছেন। উভয় নেতা সেনেগাল ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট সেনঘর ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উভয়েই অসীম আন্তরিকতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপর মতামত বিনিময় করেছেন। আফ্রিকা মহাদেশের রাষ্ট্রটির সামনে যে সকল সমস্যা রয়েছে তার সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে এশিয়ার নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যাবলীর। দুটি দেশই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্বের যে সকল দেশে মুক্তির সংগ্রাম চলছে তাদের প্রতি সমর্থন দানের প্রশ্নে উভয় দেশই সম আদর্শে বিশ্বাসী। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তারা একমত। সাম্রাজ্যবাদ , উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে এই দু’টি দেশ একই মনোভাব পোষণ করে। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে যে সকল নির্যাতনমূলক আচরণ প্রদর্শন করে থাকে–সেনেগাল ও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ তা সমদৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে থাকেন। রোডেশিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিক সহ বিভিন্ন আফ্রিকান দেশের উপর আজও যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করে ঐ সকল মুক্তিকামী দেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেনেগাল প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক এই সফরের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দু’দেশের বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে যারা বছরে অন্ততঃ একবার বৈঠকে বসবে। বাণিজ্য চুক্তির মূল বৈশিষ্ট্য হলো-দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ একে অন্যের কাছ থেকে কাঁচামাল আমদানির ব্যাপারে সর্বাধিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করবে। জানা গেছে, সেনেগাল বাংলাদেশ থেকে পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা ও অন্যান্য দ্রব্য আমদানি করবে আর বাংলাদেশ সেনেগাল থেকে ফসফেট সার, রক ফসফেট, ক্লিংকার ও সিমেন্ট আমদানি করবে। এছাড়া বাংলাদেশ ও সেনেগালের যৌথ উদ্যোগে একটি চটকল স্থাপনের বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট মিঃ সেনঘর ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সেনঘর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বীরত্বের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। উল্লেখ্য যে, আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে প্রথম সেনেগাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সানিদেয়াল এর প্রেসিডেন্টের এই সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।
যে কাহিনীর শেষ নেই
চট্টগ্রাম বন্দরে আবার মালের পাহাড় জমে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি আমদানিকারকরা সময় মত মাল খালাস না করার ফলশ্রুতিতেই মালের পাহাড় সৃষ্টি।
পত্রিকান্তরে সংবাদে প্রকাশ, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪১ হাজার ৪৮৪ টন গম সাইলো গুদামে পড়ে আছে। পতেঙ্গার কয়লার গুদামে ১৬ হাজার ২৯৪ টন কয়লা পড়ে আছে। বন্দরের শেডের মধ্যে পড়ে আছে ৪২ হাজার ৭৯৪ টন অন্যান্য পণ্য সামগ্রী। এই মালের মধ্যে মাত্র ৯ হাজার ৬৭১ টন মাল টিসিবির, ৯৮৫ টন মাল বিএডিসির, ১ হাজার ৩০ টন মাল ওয়াপদার, ৮ হাজার ৩০২ টন মাল সাপ্লাইয়ের, ৫৫০ টন রিলিফ কমিশনারের, ইউনিসেফের ২৯ টন, ২ হাজার ৮৭১ টন বিভিন্ন রিলিফ সংস্থার। এছাড়া ৪ হাজার ৯৫৪ টন সিমেন্ট, ২৪ টন সার ও বেসরকারি আমদানিকারকদের আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী জমে আছে।
বন্দর পূর্ণ হয়ে থাকার পেছনে আরও একটি কারণ বিদ্যমান। তা হচ্ছে আমদানি করা নানা ধরনের গাড়ি। এরমধ্যে ইউনিসেফের আছে ৬টি, পিওএস এর একটি, ওকপ ৬টি, বিডিআরের ৪২টি, বিআইডিসি ৬০টি, পাটকলের একটি এবং অন্যান্যদের ৪৬টি গাড়ি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ৪৪ হাজার ৮৯৯ টন গম নিয়ে তিনটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। ৫০ হাজার টন গম নিয়ে আরও দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছবে খুব শীঘ্রই। মোদ্দা কথা হল চট্টগ্রাম বন্দরের সব মিলে এক লাখ টন মাল পড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের দুটি বন্দরেই আছে। একটি চট্টগ্রাম। অন্যটি চালনা। চট্টগ্রাম বা চালনা বন্দরে মালের পাহাড় জমে ওঠা এমন কোনো নতুন কাহিনী বা ঘটনা নয়। পুরনো কাহিনীই। এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেকবার। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই মাল জমে থাকার কাহিনীর জন্ম হয়েছে। তখন অবশ্য অনেকগুলো কারণও ছিল। তার মধ্যে প্রধান কারণ পরিবহন এর অভাব। বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। তবুও মাল জমে থাকা সম্পর্কিত বিষয়টির একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চেষ্টা চালানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
গত বছরের ৯ই ডিসেম্বর সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আকস্মিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করেন। বন্দর পরিদর্শনকালে বঙ্গবন্ধু ওয়াপদা, টিসিবি ও খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন সংস্থার যেসব কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলোর একটি তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। ওয়াপদার বিপুল পরিমাণ বিদেশ থেকে আনা জেনারেটর ও মূল্যবান বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্দর এলাকার একটি অবহেলিত স্থানে পরিণত হতে যাচ্ছে দেখে তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অবিলম্বে যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
উল্লেখ্য যে, কাজে চরম গাফিলতি করা এবং সময়মতো মাল খালাস না করায় সে সময় মাল চলাচল সংক্রান্ত বিদ্যুৎ বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধুর চট্টগ্রাম বন্দর সফরের পর চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই চার মাসের মধ্যে অনেক আদেশ-নির্দেশ বর্ষিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকবারই বৈঠকে মিলিত হয়েছেন পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য। রেল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন যে, খাদ্যশস্য পরিবহনের ক্ষেত্রে রেল অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এদিকে আবার নির্দেশ জারি করা হয়েছে যে, সময়মতো মাল খালাস না করলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি কিছুই। যথা পূর্বং তথা।
কথায় বলে কাশীর পথ যদি ধুলায় অন্ধকার হয় তাহলে সেখানে পৌঁছায় কার বাপের সাধ্যি। যতই আদেশ-উপদেশ, নির্দেশ বর্ষিত হোক না কেন কাজ কিছুই হবে না। খালি ঠেলাঠেলিই চলবে। একে চাপাবে অন্যের ঘাড়ে দোষ। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঠেলাঠেলির ফলশ্রুতিতে যা দাঁড়াচ্ছে তার নাম মালের পাহাড় তারই পরিণতিতে মাল থেকেও মাল পাচ্ছে না জনসাধারণ। জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্যও মালের অভাব এর সুযোগ নিয়ে কালোবাজারি আর মুনাফাখোররা তৎপর। এতে দিনের-পর-দিন জনসাধারণের দুর্ভোগ বাড়ছে বৈ কমছে না।
আগেই বলা হয়েছে, এ কাহিনী শেষ হবার নয়। এই কাহিনীতে যদি সমাপ্তি রেখার টানতে হয় তাহলে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর নীতিকে পরিহার করা প্রয়োজন। আটুনিটা সত্যি সত্যিই বজ্র আটুনি হলেই কাহিনীর শেষ হবে। অন্যথায় বিপরীত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক