You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.06.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সাংবাদিকের দ্বায়িত্ব | লবণের কৃত্রিম সংকট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১২ই জুন, মঙ্গলবার, ২৮শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

সাংবাদিকের দ্বায়িত্ব

সাংবাদিকরা যেমন দেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় তেমনি সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত বিশেষ দায়িত্ব থেকেও তারা দূরে সরে থাকতে পারেনা। জনসাধারণের ইচ্ছে প্রতিফলনে তারা ভাষা যোগায় আর দেশের অগ্রগতির বাস্তব ছবি জনগণের সামনে তুলে ধরে তারা জনগণকে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত করে তোলে। সাংবাদিকের দায়িত্ব এককথায় তাই দেশের এবং দেশের বাইরের ঘটনাবলীর বাস্তব এবং তথ্যনির্ভর ছবি তুলে ধরা হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রবীণ সাংবাদিক জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের নির্ভয়ে সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বৃটিশ ভারত থেকে শুরু করে নিজের সাংবাদিক জীবনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, অতীতে বিভিন্ন সমস্যা এবং বাধা-বিপত্তির সাথে লড়াই করেই সাংবাদিকদের টিকে থাকতে হয়েছে, এখনো সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হবে।
জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী অতীতের রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে সে সকল সংগ্রামে সাংবাদিকদের গৌরবজনক ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এদেশে সাংবাদিকদের ত্যাগকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তারা অনেকেই জীবন দান করেছেন। বাংলাদেশের স্তরানুক্রমিক আন্দোলনে সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ এবং তাদের লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে তারা যে ভূমিকা পালন করেছে তা নিশ্চয়ই দেশবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রতিটি আন্দোলনের সাথে প্রগতিশীল সাংবাদিক একাত্ম হয়েছিলেন। কে বাংলাদেশের জনসাধারণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদেরকে অধিকার সম্বন্ধে সজাগ করে তোলায় মুসাফিরের লেখনীকে খাটো করে দেখবেন? রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মিঠেকরার লেখক ভিমরুলের অংশীদারত্বকে ছোট করে দেখবেন এমন লোক বাংলাদেশে আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।
তারা জনগণের কাছে যেতে পেরেছিলেন। জনসাধারণের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে তারা একাত্ন হয়েছিলেন। তাদের লেখনীতে জনসাধারণ খুঁজে পেত তাদের নিজেদের অভিব্যক্তি। তাই সেদিনের সেই সাংবাদিকদের আপন ভেবে নির্ভর করতে পেরেছিলেন সাধারন মানুষ। সেই নির্ভরতা এবং ভালবাসা পাবার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। মানুষকে ভালোবেসে তাদের নিকট আত্মজন জন হিসেবে যেতে হয়। জনাব চৌধুরী তার ভাষণে সেই যোগ্যতা অর্জনের জন্য নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের নানা সমস্যার রয়েছে, রয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি। স্পষ্ট করে সত্যি লেখাতেও যে প্রতিবন্ধকতা আসে না তাও নয়। কিন্তু এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই সাংবাদিকদের তাঁদের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার সাথে অগ্রসর হতে হবে । আমরা আগেই বলেছি যেহেতু সাংবাদিকরা সমাজের একটি সচেতন অংশে সেইহেতু তাদের ওপর দায়িত্ব সর্বাধিক। সাধারণ মানুষ তাদের নিকট থেকে অনেক কিছুই আশা করে। সেই আশা পুরনে, বিশেষ সেই দায়িত্ব পালনে তাই পিছু হটবার অবকাশ নেই।
আজ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলনের শেষ দিনে স্বাধীনতাত্তোর উনত্রিশ মাসের দিকে আবার ফিরে তাকিয়ে লাভ নেই। অতীত অতীতই। তখনকার সাফল্য-ব্যর্থতার দুটো থেকেই নতুন করে পথ চলার অনুপ্রেরণা নিতে হবে। নির্ভয়ে সুষ্ঠুভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে আমরা শুধু এইটুকুই বলবো, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্র যেখানে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত সেই স্তম্ভকে মজবুত রাখতে তাদের দায়িত্বও কম নেই। সে দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের সাথে সাথে তাদের ও সুস্থ মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।

লবণের কৃত্রিম সংকট

রাজধানীতে আবার লবণের অভাব দেখা দিয়েছে। গত রোববার থেকে প্রকৃতপক্ষে বাজারের লবণ এক বারেই নেই। যেখানে কিছু লবণ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে দাম খুব চড়া। প্রতি সের ১.২৫ পয়সায় বিকাচ্ছে। অথচ লবণের সরকার নিয়ন্ত্রিত দাম ২৮ পয়সা। এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে গত ১৫ দিন থেকেই লবণের দাম চড়তে শুরু করে এবং বর্তমানে তা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে।
লবণ সংকটের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ কুটির শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান সূত্রে জানা যায় যে, গত ছয় মাস থেকেই নাকি আবহাওয়া জনিত কারণে লবণ উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। তবুও দেশ লবণ সংকট দেখা দিতে পারে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তবে সাম্প্রতিক লবণ সংকটের পেছনে অসাধু মজুতদার ও মুনাফাখোরদের সক্রিয় তৎপরতা আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি এও জানান যে, উৎপাদনের সঙ্গেই তার সংস্থার সম্পর্ক সরবরাহের প্রসঙ্গে নয়। উক্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এবং খাদ্য সচিব জানান রেশনের লবণ সরবরাহ করার সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন। উৎপাদন সূত্র বলেছেন-উৎপাদন যা হচ্ছে তাতে ঘাটতি করার কথা নয়। সরবরাহ সূত্র বলছেন-রেশনের লবণ সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু অবস্থা হচ্ছে বাজারে লবণ নেই এবং যাও আছে তারও অত্যাধিক চড়া দাম।
আমরা জানি লবণ আমাদের দেশেই প্রচুর উৎপাদন হয়। প্রকৃতিদত্ত লবণ সম্ভারে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলব্যাপী লবণ উৎপাদনের কাজ চলে। যার ফলে লবণের ঘাটতি কথাটা শুনলে অবাক লাগে। অথচ মাঝে মাঝে লবণ সংকট দেখা দেয়। স্পষ্টতই বোঝা যায় এ সবই অসাধু ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য কারসাজি। আরও অবাক লাগে সেই দিকে তৎপরতা অর্থাৎ দুষ্টু দমনের কথা না বলে রেশনে লবন দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। রেশনে লবণ সরবরাহ করলে সমস্যা মিটে যাবে না। কারণ রেশন দেশের সবাই পায়না এবং এরাই দেশের অধিকাংশ মেহেনতি ও সীমিত আয়ের মানুষ। সে কথা বিবেচনা করেই লবণের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন সৃষ্টিছাড়া সব কাজ করে বেড়াবে আর সবাই দেখবে- এ হতে পারেনা প্রয়োজনবোধে কাটা লাগাম দিয়েও সেই পাগলা ঘোড়ার বিক্ষিপ্ত গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা বাঞ্ছনীয়।
মাত্র দু’তিন মাস আগেই একবার এমনই লবণ তেলেসমাতি শুরু হয়েছিল। দুই দিনের মধ্যে লবণের চার থেকে ছয় টাকায় উঠেছিল। ১৬ টাকা সেরের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আতঙ্কে অনেকে সেই উচ্চমূল্যে লবণ কিনে কয়েক মাসের জন্য সঞ্চয় করেন করলেন। একদিনে লবণের ব্যবসায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার যৌথ উদ্যোগ নিলেন। একদিকে রেশনের লবণ সরবরাহ করা অন্যদিকে জনগণকে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের সহযোগিতা দিয়ে মজুদদারদের গণপিটুনির বন্দোবস্ত করলেন। দুর্ঘটনাও ঘটলো। কিন্তু ফল হলো শুভ। লবণ আবার আগের মতোই সহজে ও সুলভে পাওয়া গেল।
এই দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। যেকোনো সংকটে সরকার যদি যথাসময়ে হস্তক্ষেপ করেন তবে তার সেই শুভকর্মে জনগণ ও স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সহযোগিতা দান করতে এগিয়ে আসেন। দেশের সার্বিক কল্যাণে যেকোন সমস্যার সংকট কাটিয়ে উঠতে গেলে এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করলে তার ফল যে ভালই হয় এ তারই নমুনা। অতএব আমাদের দাবি-আবার পূর্বের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একটা দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হোক। সেইসঙ্গে সরবরাহের ব্যবস্থা উন্নত ও নিয়মিত যেন হয়। আত্মপর লবণ সংকট সৃষ্টির মূলে সক্রিয় অসাধু ব্যবসায়ীদের নির্মম সাজা দেওয়া হোক। এবার নিশ্চয়ই জনগণ সহযোগিতা দেবে। কারণ এই একটা নিমকহালালীর পবিত্র কাজ। আর যৌথ অভিযান তো চলছেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন