You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.06.29 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সিধে পথে মুদ্রা পাচার | বৃক্ষ রোপণ পক্ষ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৯শে জুন, রোববার, ১৫ই আষাঢ়, ১৩৮১

সিধে পথে মুদ্রা পাচার

অপচয় আর লোকসান তো আমাদের প্রতিদিনের খবর। আজ ওখানে ওটা পচছে। কাল সেখানে আর এক জিনিস নষ্ট হচ্ছে অথবা অযথা সরকারকে গচ্ছা দিতে হচ্ছে লক্ষ কোটি টাকা। এ সবই অব্যবস্থার ফল। স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে কেউ কেউ আবার এই গচ্ছা আর লোকসানের বাজারেও নিজ নিজ আখের টা বেশ গুছিয়ে নিচ্ছে। দেশের সম্পদ আর অর্থ নিয়ে একশ্রেণীর লোকের এমনই মহোৎসব জনসাধারণের মধ্যে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। সামগ্রিক অবস্থাটাই চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। ত্রিশ মাসে এমনিভাবে যারা ভাগ্য গড়েছেন তারা সবাই অবৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদ দেশের অভ্যন্তরে রেখে নিশ্চিত হতে পারেননি। যথাসম্ভব পাচার করেছেন বিদেশে এই বিদেশে। সম্পদ পাচারের অভিযোগ কিন্তু বহুদিনের। অনেক দায়িত্বশীল লোক এই অভিযোগ তুলেছেন, এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যও সরকারের নিকট তারা দাবি জানিয়েছেন।
পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, শুধু গায়েবী পথেই নয় আমদানি বাণিজ্যের ‘সদর রাস্তা’ দিয়ে লক্ষ কোটি টাকার বাংলাদেশের পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ বিভাগে এমন সব কেস ধরা পড়েছে যাতে দেখা গেছে তথাকথিত আমদানিকারকরা ঋণপত্র খুলে টাকা ঠিকই দেশে পাঠিয়েছেন অথচ সে টাকার বিনিময়ে তারা মাল এনেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এই শ্রেণীর আমদানিকারকরা কাগজে-কলমে যে ঠিকানা দিয়েছে তা সত্যি নয়। অনেক ক্ষেত্রে ঠিকানা অসম্পূর্ণ। এই ভুয়া আমদানিকারকদের টিকিটিরও সন্ধান কেউ পাচ্ছে না। অথচ গত ত্রিশ মাসে এরা বহু টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বেমালুম বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। উক্ত পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছে এমন সব আমদানিকারক আবার আমদানি লাইসেন্স এর অধীনে মাল আনার কোন প্রমাণপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল না করেও প্রায় প্রতি মাসেই নতুন নতুন লাইসেন্স বের করে নিচ্ছেন। এতে যেমন প্রয়োজনীয় জিনিস যা আমদানির জন্য তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তার স্বল্পতা দেখা দিয়েছে তেমনি আবার দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রার অবাধ পাচার হবার ফলে দেশের অর্থনীতি একেবারে ফাঁকা হবার উপক্রম হয়েছে।
এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। একবারে সব সম্পদ বাইরে পাচার হয়ে গেছে তাও নয়। দিনের পর দিন বা বারবার একই প্রক্রিয়ায় সম্পদ বাইরে সরানো হয়েছে। এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে এড়িয়ে গেছে তাও নয়, কাউকে ঋণপত্র দেবার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিশ্চয়ই অজানা থাকার কথা নয় যে ওই একই ব্যক্তি এর আগে পাওয়া আমদানি লাইসেন্সের অধীনে আনা মালের বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেনি। এছাড়া একটি আমদানি লাইসেন্স বের করতে নিশ্চয়ই অনেক দায়িত্বশীল লোকের চৌকাট মাড়াতে হয়। তারাই বা বারবার একই অন্যায় ঘটতে দিলেন কি করে?
গচ্চা লোকসানের খবর আমরা হরহামেশাই দেখে থাকি। এগুলো প্রায় গা ছুয়ে যাওয়ার মত হয়ে গেছে। কিন্তু একই সঙ্গে বিদেশি মুদ্রা পাচার এবং দেশে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট সৃষ্টি তৎপরতা কাউকে উদ্বিগ্ন না করে পারেনা। কাল বিলম্ব না করে এর তদন্ত হওয়া উচিত।

বৃক্ষ রোপণ পক্ষ

আগামীকাল বৃক্ষরোপণ পক্ষের সূচনা দিবস। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংশ্লিষ্ট মহল সহ সমগ্র দেশবাসীর কাছে বৃক্ষরোপণ পর্বকে সফল করে তুলবার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। এক পক্ষকালের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নানাস্থানে বৃক্ষরোপনের কাজ চলবে। রাস্তার দু’পাশে সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষ ধরনের শিশু চারাগাছ প্রোথিত করা হবে। কিছু জনসমাগম হবে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কৌতুহলী দৃষ্টি সেই অনুষ্ঠানের আশেপাশে পতিত হবে এবং এমনি সব।
একথা অনস্বীকার্য যে, সমৃদ্ধিশালী একটা দেশের পক্ষে বনসম্পদ অপরিহার্য। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে তাই দেখা যায় সুপরিকল্পিতভাবে বনসম্পদ বাড়ানো হয়। সম্ভাব্য সকল প্রকার উদ্যোগ নিয়ে বৃক্ষরোপণ পালনের শুধু নয়, শিশু বৃক্ষকে লালন করে মহীরূপে রূপ দেয়া হয়। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে চাইলেও সেই একই দৃশ্য চোখে পড়ে। পথঘাটের দু’পাশ সবুজ বৃক্ষরাজিতে শোভিত থাকে। কারণ বনসম্পদ শুধু যে চারু শোভার অঙ্গ তাই নয়-সবুজ বৃক্ষ সম্ভার কলকারখানার উৎপাদনে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের জন্যও অত্যাবশ্যকীয়।
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে একথা সত্য যে, সবুজ বনানী বৃক্ষ প্রকৃতিকে তার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোমল করে। এজন্য দেখা যায় কোন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি। আর গাছপালা শুণ্য মরূভূমিতে বৃষ্টি হয় না। স্বাস্থ্যগত কারনেও বৃক্ষরাজি জীবন রক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য বায়ুমন্ডলের শোধন কাজ করে। সবুজ পাতাগুলো প্রচুর কার্বণ-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ছাড়ে। ফলে সবুজ গাছপালার মাধ্যমে সর্বদাই আমরা যে বায়ুমণ্ডলে ডুবে থাকি তার শোধন কাজ আমাদের অজান্তেই হচ্ছে। সে কারণেও অনলস প্রয়াসে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের বৃক্ষসম্পদ আজ বাড়ানো প্রয়োজন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য শ্যামল শোভাময় বাংলাদেশের বৃক্ষ সম্পদ সম্পর্কে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সচেতন ছিলেন। তাদের হয়তো বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। কিন্তু বৃক্ষরোপণের ঐতিহ্য ছিল। তাই পরিবারের সকলের জন্যই গৃহকর্তা প্রতিবছর একটি হলেও ফলের গাছ লাগাতেন। সে মনোভাব আবার জাগানোর উচিত। তার দ্বারা দেশে প্রতিবছর প্রচুর ফল ফুলের চারা রোপিত হবে। এতে ফলমূলাদির চাহিদাও মিটবে এবং বৃক্ষসম্পদ বাড়বে। এর প্রেক্ষিতে প্রতি বছরে আমরা দেখি মহা ঘটা করে বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদযাপন করা হয়, প্রচুর গাছ লাগানো এবং তার শোভন বেড়াও দেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার দেখা যায় গবাদি পশু মহানন্দে ওই শিশু চারা গাছ গুলি কচি নধর সবুজ পেলব পাতাগুলি চিবুচ্ছে। তারপর পথচারী ঘুটে কুড়ুনীর দল ক্রমে এক এক করে গাছের খাঁচাগুলো কে নিয়ে যায় জ্বালানি করার উদ্দেশ্যে। পরের বছর বৃক্ষরোপণ পক্ষ এসে উপস্থিত হবার আগেই ময়দান বা রাস্তার দু’পাশ কিংবা আইল্যান্ডের পরিষদ প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।
এই নিয়ে অনেক লেখালেখি ও বলাবলি হয়েছে। কিন্তু শেষ ফল যা হয়েছে তা আমরা সবাই দেখেছি। আবার এক বৃক্ষরোপন পক্ষের সূচনা হবে কাল। তাই আবেদন রাখছি-শুধু চারা গাছ লাগিয়ে দিয়েই যেন এই মহৎ উদ্যোগকে অবমানিত না করা হয়। বৃক্ষরোপনের কর্মটি সহজ কিন্তু সেই বৃক্ষের লালন অতটা সহজ নয়। সেজন্য সারাবছরই সংশ্লিষ্ট মহলকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হয়। নতুবা বৃক্ষরোপণের স্লোগানই সার হবে। কাজ এগোবে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। এতে বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এছাড়াও বনজ রোগে বনাঞ্চল আক্রান্ত হয়ে বহু গাছপালা প্রায়শই নষ্ট হয়ে থাকে। সুন্দরী গাছের মড়ক সংক্রান্ত এক চাঞ্চল্যকর সংবাদপত্রের প্রতিবেদন মারফত আমরা দেখেছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বাদ দিয়েও বলা যায় বনজ সম্পদ রক্ষা করাও একটা গুরুদায়িত্ব। বৃক্ষরোপণ পক্ষের অন্যতম উদ্দেশ্য তাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। একদিকে মড়ক লেগে গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেলে এবং আরেকদিকে বৃক্ষরোপণের ফলহীন উদ্যোগ নিলে বিয়োগফলের সংখ্যায় বেশি দাঁড়াতে পারে। অতএব বৃক্ষরোপণ পক্ষকে কেন্দ্র করে আজ বনাঞ্চল বৃদ্ধি ও বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণের যৌথ প্রয়াস চালাতে হবে। এবং এ ব্যাপারে সাংবাৎসরিক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে বনজ সম্পদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু স্লোগান দিয়ে কখনো যে কাজ হয় না-একথাটা উত্তমরূপে সংশ্লিষ্ট মহলের বোঝা দরকার। আমরা সংশ্লিষ্ট মহলের সেই শুভ চেতনার উদ্রেকও দেখতে চাই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন