ঢাকার বুকে ২৫ মার্চের কাল রাত বাঙালি জাতিকে ধ্বংস ও পরাধীন করে রাখতে ইয়াহিয়া ভুটো আঘাত এবং আক্রমণ করার নীল নক্সা তৈরি করে অবশেষে হানাদারদের লেলিয়ে দিয়ে সরে গেল। আগেই তা তৈরি করে অবশেষে হানাদারদের লেলিয়ে দিয়ে সরে গেল। প্রকৃতপক্ষে আগেই তা তৈরি করে রেখেছিল, আলােচনা নামে ভাওতাবাজির ভেতরে প্রস্তুতি চলছিল বাঙালিদের মনে উত্তেজনা, গভীর উদ্বেগ; আশার তুলনার নিরাশাই অধিক পাওয়া গেল। বুঝতে পেয়েছিল ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ছেড়ে যেতে নির্দেশ দেওয়া হল। কথা ছিল ২৩ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেবেন, কিন্তু সে ভাষণে ক্ষমতা হস্তান্তরে কোনও কথা নেই। ২৪ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অগণিত মানুষের ভিড়, সকলের কথা আলােচনা নয়, যুদ্ধ সকলেই চরম আত্ম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত তারপরও কী হয়, প্রতিটি মুহূর্ত চরম উত্তেজনাকর । অবশেষে বিকেলেই জানা গেল আলােচনা ভেঙ্গে গেছে। ২৫ মার্চ ‘৭১ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কালক্ষেপনের নিষ্ফল আলােচনা করে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করেছেন। কিন্তু ভেতরে বাংলাদেশ আক্রমণ এবং মুজিবকে খতম করার সকল অভিসন্ধি সমাপ্ত করা মাত্র ইয়াহিয়া বিমানে উঠে হাওয়া। কেউ এ খবর জানত না যে ক্যান্টনমেন্টে কী হচ্ছিল রাত এগারটায় প্রেসিডেন্ট থেকে সংকেত আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বহর ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রবাহী যান আর হায়েনা সদৃশ পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী কয়েকটা পয়েন্টে অতর্কিত আক্রমণ করল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি এসব খানে একযােগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র-শিক্ষক নির্বিচারে হত্যা করল, মেয়েদের হলে প্রবেশ করে বীভৎস অত্যাচার করল; রাজারবাগে ও পিলখানায় অনুরূপভাবে ট্যাঙ্ক-মেশিনগান দিয়ে হত্যা ও বিধ্বস্ত করল। রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়ে ড্রেনে গড়িয়ে পড়ল।
রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মারল। ঠিক সাড়ে বারােটায় ‘অপারেশন বিগ ফিস’ নামে ‘ব্ল্যাক ডগরা’ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলল এবং তাকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে এল সারারাত ধরে ঢাকার সবখানে চলল হত্যাকাণ্ড; তাছাড়া লিস্টিভুক্ত অনেকের বাসভবনে গিয়ে হত্যা করে এল, যেমন লে, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হােসেনকে ডেকে নিয়ে কোনও কথা বলতে না দিয়ে ঘরের সামনে এল করে মারল। এরপর পত্রিকা অফিসে হানা দিয়ে যাকে পেল মারল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক, যেমন দার্শনিক গােবিন্দ দেব, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন প্রমুখকে হত্যা করল। রাতে রাতেই সেনা সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয় এবং সম্পূর্ণ ঢাকা করায়ত্ত করে। বিশেষত হিন্দুপ্রধান এলাকাতে ঢুকে বীভৎস অত্যাচার চালায় বিদেশি গবাদিকরা ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা ও অগ্রগতি রিপাের্ট করার জন্য বিভিন্ন হােটেলেঅবস্থান করছিলেন। বিদেশি সাংবাদিকদের অস্ত্রের মুখে বিমানবন্দরে নিয়ে বিমানে। দেয়। তাদের ক্যামেরা ও সংবাদ গ্রহণের অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করা হয়। কেবল ব্রিটিশ সাংবাদিক কৌশলে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কোনও এক কক্ষে লুকিয়ে থেকে ঢাকার দৃশ্য দেখতে পান। পরে তিনি প্রথম বাইরে এ সংবাদ পাঠান। তার বর্ণনা সে রাতে যে ভয়াবহ দৃশ্য ও রক্তপাত হয়েছিল তা দিল্লিতে চেঙ্গিস খানের হত্যাকাণ্ডতে হার মানায়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের লাশ পড়ে ছিল, পরে সেনাবাহিনীর ট্রাক এসে সেগুলাে কুড়িয়ে নেয়। পরদিন বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে হাজার হাজার লাশ ভাসতে দেখা গেছে। কারফিউ আগে থেকেই জারি করা ছিল, তবু মাইকযােগে কাউকে ঘরের বাইর হবার জন্য নিষেধ করে দেওয়া হল। প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বাহিনী এক যােগে আক্রমণের উদ্দেশ্যে লােকালয়ের দিকে ধাবিত হয়। কুমিল্লা থেকে বিশেষ বাহিনী চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বন্দর মুক্ত করার জন্য প্রেরিত হয়। তারা চট্টগ্রাম-নােয়াখালি সংযােগ শুভপুর ব্রিজের গােড়ায় আটকে পড়ে, চট্টগ্রামের প্রতিরােধকারীরা ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রেখেছিল। এমনি যশাের, রাজশাহি, রংপুর, খুলনা, বরিশালেও অনুরূপভাবে রাতে রাতেই আক্রমণের। প্রস্তুতি ছিল।
সে কারণে ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য স্থানে কমবেশি সে রাতে সেনাবাহিনী বাঙালি। নিধন করেছে।ঢাকার সমস্ত প্রকার আন্দোলন ও সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক। মেশিনগান দিয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালাল মধ্যরাতে ট্যাঙ্কের গােলার আঘাতে সার্জেন্ট জহুরল হক হল ও জগন্নাথ হল একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। জহুরল হল ছিল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু, ছাত্র সংগ্রাম পরিণদের অধিকাংশ নেতা সেখানে থাকতেন। আর জগনাথ হলে হিন্দু ছাত্ররা। পাক বাহিনী কেন এমনভাবে ছাত্র হত্যার জন্য মরিয়া হয়ে। উঠেছিল তার কারণ খুবই সােজা। পাকিস্তানের সৃষ্টি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জিন্নাহকে নাে নাে বলেছে, বায়ান্নের একুশের আন্দোলন সৃষ্টি করেছে উনসত্তরে গণ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। মােট কথা এই ছাত্ররাই পাকিস্তানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে। গেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় অধ্যাপক, তারাও কম দায়ী নয়। তাই তারা পারে তাে সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়কে একেবারে নিঃশেষ করে দিতে উদ্যত হয়েছিল এক রাতের ভেতর। রাজারবাগে বাঙালি পুলিশ আর পিলখানায় ইপি আর ঘাটি কেন আক্রমণ করল। তাদের হাতে অস্ত্র আছে এবং সেনাবাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য গােয়েন্দা রিপাে তাদের কাছে ছিল, সে কারণে এ তিনটি স্থানে আক্রমণ হয়েছে ভয়াল, হত্যা ও ধ্ব হয়েছে অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করে তাকে বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে। এল। তাকে হত্যা করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে। গিয়ে তার জন্য খোড়া কবরের পাশে বন্দি রাখা হল।
সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ