You dont have javascript enabled! Please enable it!

সত্তরের ঘূর্ণিঝড়  বাংলাদেশ ও নির্বাচনপ্রাচীনকালেও বঙ্গে ঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের কথা শােনা যায়। সারাদেশে কালবৈশাখী, প্রকোপে অনেকের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু সমুদ্র উপকূলে সমুদ্র থেকে উথিত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস বড় মারাত্মক। বাংলাদেশের দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল সুন্দরবন থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত। বিশেষত নদী-বিধৌত চরাঞ্চলে এই ঝড়-জলােচ্ছাসে প্রতি বছর কিছু না কিছু ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে থাকে। বছরের দুটি সময় গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এবং শীতের শুরুতে সাধারণত এ ঝড়ের প্রকোপ দেখা দেয়। সমুদ্রে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তা প্রবল হয়ে ঝড়ের আকার ধারণ করে উপকূলের দিকে ধাবিত হয়। ঘণ্টায় একশ’ থেকে দুশ’ মাইল বেগে বাতাসের গতিবেগ সঞ্চার করে সে ছুটে। ঘরবাড়ি-গাছপালা উপড়ে ফেলে। কিন্তু তার চাইতে মারাত্মক ব্যাপার হল বাতাসের আঘাতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি বিশ থেকে ত্রিশ ফুট কি তার চেয়ে উঁচু হয়ে স্থলভাগে পাহাড় সমান ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ে। পরমুহূর্তে পানির টানে স্থলভাগ থেকে যা কিছু সাথে পায় প্রচণ্ড স্রোতাবেগে সমুদ্রের বুকে টেনে নিয়ে চলে যায়। ১৮৮৯ সালে তেমনি একটি ঘূর্ণিঝড় জলােচ্ছাস। চট্টগ্রাম-ননায়াখালির উপকূলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। অতি প্রাচীনদের মুখে প্রায় ষাট বছর আগে শােনা, যে নারকোল গাছের ওপর দিয়ে জলােচ্ছ্বাসের পানি গড়িয়ে গেছে, গাছের মাথায় স্রোতের বেগে খড়কুটা জড়িয়ে রয়েছিল। ঘরের চালা খুলে ভেলা করে কেউ কেউ বেঁচেছিল, অন্যরা সমুদ্রে চলে গিয়েছিল। ১৯৬০, ১৯৬৩, ১৯৭০, ১৯৯১ সালে প্রায় সে রকম ঝড়ের প্রকোপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ যুগে ঝড়ের পূর্ব সংকেত দেবার উপায় থাকলেও এখনও পর্যন্ত এদেশের মানুষকে সতর্ক করে নিরাপদ আশ্রয়ে নেবার দায়িত্ব পালন করা প্রায় হয় না। লােকজনও সচেতন থাকে না, ভবিতব্যের ওপর ভরসা করে আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে কুঁড়েঘরে পড়ে থাক। ফলে লক্ষ লক্ষ লােক মারা পড়ে এবং ব্যাপক সহায়-সম্পত্তির ক্ষতি হয়।১৯৭০ সালের ৯ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নােয়াখালি, বরিশাল, খুলনায় তেমনি এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে প্রায় দেড় কোটি লােক গৃহহারা হয় এ লক্ষের অধিক লােক প্রাণ হারায়। গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পদের যে পরিমাণ হয়েছল তার হিসেবে নেই। কিন্তু এই ঝড়টি এমনই সময় হল তার মাসখানেক না” ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে প্রথম বারের মতাে জাতীয় সংসদ। তফসিল ঘােষণা করা হয়েছে। দীর্ঘ ২২-২৩ বছরের সংগ্রামের সুফল পাকত গণতাত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার একটা সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ  হবে।

১৯৬৯ সালের মার্চ মাস থেকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যে দেশের মানুষের প্রত্যক্ষ ভােটে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। ৭০ সালের আগস্ট মাসে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল তখন প্রায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন, মুসলিম লীগের কয়েকটা ভাগ, আওয়ামী লীগেরও তাই, নামসর্বস্ব ইসলামি দলগুলাে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে ভােট আদায় করে থাকে, তারাও একে-অন্যের প্রতিপক্ষ। তবে মওদুদিপন্থি জামায়াতে ইসলামি পার্টির জনসমর্থন না থাকলেও তাদের সংগঠনের ভিত্তি খানিকটা দৃঢ় । পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতি ইসলামের রাজনীতি ছিল না। আইয়ুব খানের চেষ্টায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের দিয়ে এখানে জামায়াতের সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সংগঠন ছয় দফা ভিত্তিক কর্মসূচির দেওয়া কারণে বিরাট জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেটা বাইরে তেমন বােঝা যায় নি। মানুষের অন্তরে শেখ মুজিব ও পূর্ব বাংলার এই স্বার্থ আদায়ের উপায় বিশ্বস্ততা পেয়েছে। মওলানা ভাসানী ও তাঁর ন্যাপ চরম চীনা পন্থায় হঠকারীভাবে উচ্চারণ করল, ভােটের আগে ভাত চাই, কিংবা ভােটের বাক্সে লাথি মার পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন কর, ভাসানির অনুসারীরা নির্বাচন বয়কট করে শ্রেণিশত্রু নিধনে রত রইল। শেষ পর্যন্ত ভাসানী-ন্যাপের ১৭ জন প্রার্থী তাদের ধানের শীষ মার্কা নিয়ে লড়াইয়ের ঘােষণা দিলেও নির্বাচন থেকে বিরত রইলেন। আতাউর রহমান খানের জাতীয় পার্টিও নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়াল। তাদের মার্কা ছিল লাঙল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাদের এ কাজকে রাজনৈতিক হারিকুরি আখ্যা দিলেন। ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাঠে রইলেন। আওয়ামী লীগ তাদের পুরানাে নির্বাচন প্রতীক নৌকায় ভর করলেন।
চরমপন্থি অন্তর্ঘাতী তৎপরতা ও শ্রেণিশত্রু হত্যা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন প্রচার অভিযানে ব্রতী হলেন। চরমপন্থিরা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি সর্বহারা পার্টি ইত্যাদি নাম নিয়ে শ্রেণিশত্রু নিধনের নামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুণ্ড নিপাত করতে লাগল। কিন্তু তারা ভুলেও জামায়াতি আর মুসলিম লীগের ভেতর শ্রেণিশত্রু খুঁজে পায় না। নির্বাচন যত কাছে এল ততই আওয়ামী লীগের পক্ষে মানুষের মন আকৃষ্ট হল, ছয় দফা ও জয় বাংলার স্লোগান জাতীয় দাবির প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। যারা পশ্চিম পাকিস্তানে কিংবা বিদেশে চাকরিরত তারা দেশে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বিশেষভাবে আবেদন জানাল ভােট জয় বাংলা, নৌকা মার্কা, মনে থাকে যেন, ভুল করবে না। বঙ্গবন্ধু যেমন ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন তেমনি পরিকল্পনায় এর জন্য একটি ভূখণ্ড ও নির্দিষ্ট করে অলিখিত ভাবে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের কাছে তার স্বপ্ন স্বরূপ ধারণা দেন। সুফলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলা, বিশ্বকবির সােনার বাংলা আমি তামায় ভালােবাসি, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা আর নজরুলের বাংলাদেশ। প্রাচীনকাল কে বল-বঙ্গদেশ, এমন দেশটি কোথাও খুঁজেপাবে নাকো তুমি, কবিদের হৃদয় থেকে  বঙ্গবন্ধু এক সময় ঘােষণা দিলেন সে দেশটি হল বাংলাদেশ। মুহূর্তে পূর্ব “তানের নামকরণ বাংলাদেশ সারা বাংলার মানুষের কাছে গিয়ে সকলের হৃদয়ে স্থান পেল। বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, দুই যুগ ধরে বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েছে, শােষণ নির্যাতন চলেছে তাদের ওপর। ক্ষমতার লােভে, অর্থের লো শ্রেণির দালাল মীর জাফররা বাঙালির স্বার্থ পশ্চিমাদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে। খান নির্বাচন ঘােষণা করেছেন, এই নির্বাচন হবে বাঙালির স্বার্থের জন্য, অধিকারের একে গণ ভােট মনে করতে হবে। এই গণভােটের মাধ্যমে ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ আs করে মীরজাফরদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সাল অকটোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করেন। ১৯৭০ সালের শুরুতে নির্বাচনী তােড়জোড় শুরু হয়ে যায়। কয়েকটি বিধি নিষেধ উঠে যাওয়ার সাথে সাথে টেকনাফ থেকে সীমান্ত প্রদেশে খাইবার পাস পর্যন্ত যেন এটা মৃত শরীর রাজনৈতিক অঙ্গনে নড়েচড়ে উঠল।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ভুট্টোর পিপলস পার্টি সে অঞ্চলে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাদের শ্লোগান ‘রুটি কাপড় মােকাম’ অর্থাৎ অন্ন বস্ত্র বাসস্থান বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে মাথা ঘামাবার তাদের দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ও বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে নির্বাচনের প্রচারে নামলেন। জয় বাংলা ধ্বনি তুলে চারণ কবির মতাে বাংলার গান গেয়ে সারা বাংলাদেশে অগণিত সভা সমাবেশে বক্তৃতা করতে লাগলেন। বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হবার আকুল আবেদন জানিয়ে বলছেন, ভায়েরা, বােনেরা জাগাে, বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার ভর করে চূড়ান্ত সংগ্রামে আমার পাশে এসে দাড়াও। দেখা গেল এমনি করে সারা দেশে একটা গণ ঐক্য সৃষ্টি হয়ে গনজোয়ার অস্তসলিল স্রোতে প্রবাহিত হতে লাগল। বাংলার মানুষ বুঝতে পারল বাংলার প্রকৃত বন্ধু কে? বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ ছিল অকৃত্রিম উদার, এই উদার হৃদয় স্বাধীন চেতা মানুষটিকে এই বার প্রথম দেখতে পেল চিরদিনের পােড় খাওয়া মানুষের আপন মানুষ তিনি। কারণ চিরদিনই তাে তারা প্রতারণা খেয়েছে আর এই ধ্রুব পুরুষ যে কখনই লক্ষ্যচ্যুত হয়নি এবং কখনও আপােস করেন নি করবে না এ দৃঢ় বিশ্বাস। তাদের মনে উদয় হল। এই অবস্থায় হঠাৎ করে ঘূর্ণিঝড় বাংলার নিম্নাঞ্চলে আঘাত করল। কোনও পূর্ব সংকেতও দিতে পারেনি, সতর্কতা অবলম্বন করে মানুষকে সরিয়ে নেবার কোনও ব্যবস্থা করা হয়, ঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের আঘাতে লক্ষ লক্ষ লােক মারা গেলেও পরদিন সে সংবাদও রােভ টিভিতে কিংবা সরকারিভাবে প্রচার করা হয় নি, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্যও ২ বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে সমস্ত নির্বাচনী প্রচার অভিযান ঘেঁটে ফেলে দিয়ে ঘূণি উপ এলাকায় গিয়ে আত্মীয়-স্বজনহারা, গৃহহারা, সহায়-সম্বলহারা মানুষের পাশে দাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যার যেমন সাধ্য দুর্গতদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ যাওয়া অভাগাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করা হল। ক্রমশ ঘূণি উপদ্রুত দুর্গত চেহারা দেশ বিদেশে প্রকাশিত হতে লাগল। লাশের স্তুপ যেখানে সেখানে। পরে সরকার ত্রাণ ব্যবস্থার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। পাকিস্তান সে রাজনৈতিক নেতা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে।” ইয়াহিয়া খান তাে নন-ই। এই আপদকালে একমাত্র শেখ মুজিব ও তার স পর ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে বেঁচে মণ ঘূর্ণি উপদ্রুত দুর্গত এলাকার যেখানে সেখানে। ঘূর্ণিঝড়ের নেয়ান। পাকিস্তান থেকে কোনও কা পরিদর্শন করে নি। প্রেসিডেন্ট আজব ও তার আওয়ামী লীগ,

রাত দিন দুর্গত মানুষের সেবা রত, কোনও নির্বাচনী প্রচারণা করেন নি। মওলানা ভাসানী দৰ্গত এলাকা ঘুরে এসে পল্টনের জনসভায় বললেন, ওরা কেউ আসে নি। বক্তৃতার সময় তিনি যেভাবে হাত তুলেছেন তার পাঞ্জাবির হাতার নিচে শত শত লাশের ছবি পত্রিকাতে ছাপা হল। কবি শামসুর রাহমান কবিতায় প্রকাশ করলেন, মওলানার আস্তিন দিয়ে ঢেকে কেবল লাশগুলাে কাফন দেওয়া হয়েছে। এদিকে ভারত থেকে এই ডিজেস্টারের কথা প্রথম প্রকাশ পায়। ভারতীয় সাহায্য চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ফিরে যায়। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সাহায্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এল সােভিয়েত রাশিয়া থেকে বিমান বােঝাই ত্রাণসামগ্রী। অনেক ধানাই-পানাইয়ের পর সেগুলাে দুর্গত এলাকায় বিতরনের জন্য যায়। ফলে যত লােক ঘূর্ণিঝড়ে মরেছিল তার দ্বিগুণ মরেছে না খেতে পেয়ে এবং সময়মতাে চিকিৎসা না পেয়ে। এক মাস ধরে সারা এলাকায় লাশের গন্ধে বিষময় আবহাওয়াও পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল । বাংলার জনগণ এবার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করল যে জনগণের বন্ধু কে। পাকিস্তান এদেশের জনগণের কোনও স্বার্থ দেখছে না এবং দেখবে না। ইয়াহিয়া খান যে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ঘােষণা করেছেন সেটাও জনগণের আন্দোলনের কারণে। তবু মনে করা হয়েছিল পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র তাই স্বৈরতন্ত্রই এই রাষ্ট্রের কপাল ভাগ্য হিসেবে চিরদিন থাকবে। সামরিক রাজা-বাদশার শাসন চিরদিন এতে চলতে থাকবে। মানুষের মনে ইসলাম যেভাবে আছে নির্বাচন দিলেও যা, না দিলেও হেরফের কিছু হবে তবু ভুল করে পরীক্ষামূলকভাবে ইয়াহিয়া খান নির্বাচন ঘােষণা করে বসলেন। ইসলাম গণতন্ত্র স্বীকার করে না, কোনও ইসলামি দেশে গণতন্ত্র নেই। কিন্তু বাঙালিদের পূর্ব পাকিস্তানে এর ব্যত্যয় হবে না এমন প্রাকৃতিক বিমুখতা হলেও। সারাদেশে নির্বাচন, পূর্ববঙ্গ থেকে আওয়ামী লীগ একক নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে আর অন্য পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলগুলাের পূর্ববঙ্গ শাখা থেকে প্রার্থী দিয়েছে। যেমন মুসলিম লীগের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ থেকে, জামায়াতে ইসলামি থেকে, ওরা কোমর বেঁধে ইসলামের ধুয়া তুলে নামল। মুজিবের আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি নিয়ে নামল। আওয়ামী লীগ পুতদের সেবায় পড়ে রইল, মনে হল যেন তারা নির্বাচনে পরাজিত হবে জেনে নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে এ কাজ করছে। অন্য দলগুলাে এ সুযােগে কেবল ইসলামের দোহাই হাড়তে লাগল আর আওয়ামী লীগ কাফের, তাদের ভােট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে, তাদের ভােট দিলে মসজিদে কেউ আজান দিতে পারবে না, তারা ইন্ডিয়াকে দিয়ে পূর্ব বাংলাকে ইন্ডিয়া বানাবে- দিন-রাত মাঠে-ময়দানে বকতে লাগল। এরই মাঝে হঠাৎ একদন রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধু ইলেকশন-পূর্ব তার দলের পক্ষ থেকে ভাষণ দেবার পেলেন।
প্রত্যেক দলের জন্য এমন সুযােগ ছিল। বঙ্গবন্ধু স্থির-ধীর উদাত্ত কণ্ঠে   পূর্ব বাংলার স্বার্থ ভাষণে প্রকাশ করলেন। ভাষণ শুনে সকলের শিরদাড়া ক হয়ে গেল। কিন্তু এ সময় নির্বাচনের মাঠ থেকে শেখ মুজিবকে সরানাে যায় না। পূবে ছােটখাটো ইসলামি দলগুলােকে সামরিক গােয়েন্দারা মুসলিম লীগ ও “মতের পক্ষে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তারা গােপনে জনমত  ৫টি আসনের বেশি নির্বাচনে ম লীগ ও জামায়াতিরা ভাগ করে যাচাই করে পেয়েছিল যে মুজিব ও আওয়ামী লীগের ৪০-৪৫টি আসনের বেশি বেরিয়ে আসবে না। পূর্ব বাংলায় বাকি আসনগুলাে মুসলিম লীগ ও জামায়াতি নেবে। বিদেশি এক সংস্থা এক্সহিবিট পােলের তথ্য প্রকাশ করেছিল আওয়ামী ৯, বাংলায় ১১০-১১৫ আসন পেতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানে শূন্য। সামরিক সরকার। ভড়কে গেলেও পূর্ব ও পশ্চিম হিসেবে আওয়ামা লীগ ঠাই পাবে না এই ধারণা তাদের মূল ছিল। তাই নাকে খাটি সরষের তেল দিয়ে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিশ্চিন্ত রইল। রে কারচুপি করার দিকে নির্বাচন কর্মকর্তা কিংবা প্রশাসনিক পর্যায়ে কোনও তাগিদ দিল না। ফলে পাকিস্তানের বুকে এই প্রথম আমার ভােট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব’। সত্যযুগের এই বিধি-ব্যবস্থা দেখা গিয়েছিল আর সেদিনই হিসেব করে ফলাফল ঘােষণা। বাংলার মানুষ এমন হয়েছিল সামান্য পােলিং অফিসার থেকে রিটার্নিং অফিসার সকলেই নৌকার পক্ষে ভােট চেয়েছিল; ভােট দিতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে এক জামায়াত সমর্থন বুঝল লাইনের সবাই নৌকার, অন্যরাও তাকে ফিসফিস করে নৌকায় দিতে বলছিল, তাই জামায়াত সমর্থক পােলিং বুথে এসে চিল্কার করে বলল আমি গােপন কক্ষে সিল দিতে যাব না, সর্বসমক্ষে এখানেই দাড়ি-পাল্লায় মারব। পােলিং অফিসার দৃঢ়ভাবে বললেন, তা আপনি করতে পারেন না বলে তার হাত এমনভাবে চেপে ধরলেন সিল পড়ে গেল নৌকায়। জামায়াতি ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইল, পােলিং অফিসার নিজে গিয়ে স্লিপটি নিয়ে বাক্সে ভরে দিলেন। সকাল আটটা থেকে বিরতিহীন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে নখে রঙ লাগিয়ে পােলিং অফিসার থেকে স্লিপ চেয়ে গােপন বাক্সে ফেলে আসাে। পুলিশ লাইন করার সাহায্য করছে, অদূরে ডিউটিরত মিলিটারিরা দাড়িয়ে তামাশা দেখছে, নতুবা তাঁবুতে গিয়ে ঘুমিয়ে থেকেছে, কোনও গ্যাঞ্জাম নেই। ঠিক পাঁচটায় বাক্স খুলে ভােটপত্র দেখে মার্কা ওয়াইজ গণনা শুরু। হল। একচেটিয়া নৌকা, ভুল-ভ্রান্তিতে দু’একটা অন্য মার্কা পেয়েছে। তাতে কী, গণনা করতে দেড়-দুই ঘণ্টার বেশি লাগল না, ওপর থেকে জালিয়াতি করার নির্দেশও নেই, মিলিটারিরাও চড়াও হয়ে ভােট কেন্দ্র দখল করে নিল না। সারাদেশে রাত দশটার ভেতর রেডিও-টিভিতে ফলাফল সম্পূর্ণভাবে ঘােষিত হয়ে গেল। কি সর্বনাশ! পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামা লীগ কেন্দ্রের ১৬৯ আসনের ভেতর ১৬৭টি আসন লাভ করল, পূর্ব পাকিতাল প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের ভেতর ২৮৮টি আসন পেয়ে গেল। পাকিস্তান গণপরিষদ বা কেন্দ্রীয় সংসদের ৩১৩টি আসন, তাই কী হল? সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন আগুন লীগ পেয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নবগঠিত দল পাক পিপলস পার্টি অদ্ভুতভাবে ৮৩টি আসন পেয়ে যায়। যদিও তা আওয়ামী লাগে চাইতেও কম তবু লাফালাফিটা দেখা গেল দ্বিগুণ। মুসলিম লীগ বলতে গেলে ৭ গেল। যে নুরুল আমিনকে ১৯৫৪ সালে খালেক নেওয়াজ কবর দিয়েছিলেন সে আমিন অদ্ভুতভাবে জিতে গেল, অন্য একটি আসন পেল স্বতন্ত্র প্রার্থী ত্রিদিব রায়। আ কবর দিয়েছিলেন সেই নুরুল আওয়ামী লীগের জয় এমনি হয় নি, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান ভেতরে একদম পাশ্চম পাকিস্তানেও কিছুটা পচেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে যারা বাঙালি ছিল তারা সে ভেতরে একদম পচে গেছে, নে যারা বাঙালি ছিল তারা যে কতটা কষ্ট পেয়েছে, চাকরির খাতিরে কিংবা অন্য কারণে সেখানে গিয়েছে, তাদের গাদ্দার, চতিয়া বঙ্গাল বলে তাে গালাগাল দিয়েছে। বাঙালি মেয়েরা শাড়ি পরে রাস্তায় নামলে হিন্দুকা আওরত বলেছে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানে তারা রাজা-বাদশার হালে থাকে।
পাকিস্তানে তারা বাংলা কথা কাউকে বলতেই দেয় না, আর পূর্ব বাংলায় এসে তারা। বাঙালিকে বাধ্য করে উর্দু জবানে কথা বলতে। তাহলে বাঙালিরা বুঝে গেছে পাকিস্তান কী। চিজ  নির্বাচনের পর পরই বিদেশি পত্রিকা মন্তব্য করল, বাংলার মানুষের জয়কার হঠাৎ একটা নাটকীয় সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। আজ না হলে কাল এটা সত্যি হবে যে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে যেতে পারে। ওদের মাঝখানে রয়েছে দেড় হাজার মাইলের ব্যবধান। তাছাড়া ভাষা-সংস্কৃতি-আচরণ ও মানসিক অবস্থা মােটেই এক নয়, ধর্মবােধও তাদের এক নয়। পাকিস্তানিরা যেমন কট্টর, বাঙালিরা উদার। আর তাদের মাঝখানে রয়েছে শত্রুভাবাপন্ন ইন্ডিয়া, বলতে গেলে একটা পরাশক্তি। যদিও ধারণা করা হয়েছিল নির্বাচনে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করবে, শেষ পর্যন্ত করে নি নানা কারণে। সামরিক বাহিনীর ভেতর অন্তর্কোন্দল ছিল, পাঞ্জাবিদের শ্রেষ্ঠতা যা আইয়ুব খান বেশি করে সৃষ্টি করে দিয়েছে। তার ওপর তাদের একটা ফালতু জনমত জরিপ হাতে ছিল, হয়তাে সেটাই সঠিক ছিল কিন্তু এক মাস আগে যে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হয় তাতে তছনছ করে দিয়েছে সব কিছু। এতটাই হবে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু নিজেও আশা করেন নি। তিনি নির্বাচনে বেশিরভাগ কলাগাছ প্রার্থী দিয়েছেন, কলাগাছই জিতে গেছে, অর্থাৎ মানুষ কলাগাছকে ভােট দেয় নি, ভােট দিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। এদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোনও আদর্শ নেই, নির্বাচনী মেনিফেস্টো পর্যন্ত তারা দিতে পারে নি, কেবল আইয়ুবের সঙ্গে ভুট্টোর বিরােধের কারণে এই অঘটন ঘটে গেছে। সিন্ধুর লারকানার নবাবপুত্র ভুট্টো ছিল লন্ডনে, আইয়ুব খান তাঁকে ডেকে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। ভুট্টো যা যা চেয়েছিল আইয়ুব তাকে যােগান দিয়েছিলেন। কিন্তু হাতে চাদ চাইলে তাে তা খসিয়ে এনে দিতে পারে না। যে শিশু খুব দুর্ভাগা সে পিতামাতার কাছে যা চায় তা পায়; একদিন চাদ খসিয়ে এনে দিতে বললে বাপ তা করতে পারে না। ফলে সে বাপকে খুন করে পিতৃহারা হয়। চার বছর ভুট্টো আইয়ুবের পেয়ারি বালক হিসেবে যা ইচ্ছা তাই করেছে, বলতে গেলে বিশ্বক্ষেত্রে আইয়ুবকে ডুবিয়েছে। আইয়ুব একবার লন্ডন গিয়ে কূটনৈতিকভাবে জুততা খেয়ে এসেছেন, সঙ্গে করে পেয়ারি লোককে নিয়ে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে নামলেন বটে, নেমেই এক লাথিতে ভুট্টোকে সরিয়ে দিলেন। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাসাদেও প্রবেশ করতে দিলেন না। ভুট্টো সােজা অমল স্টেশনে চলে গেলেন। ট্রেনে চেপে করাচির উদ্দেশে রওনা হলেন। যদিও এক্সপ্রেস ” জনতার চাপে প্রায় প্রত্যেক স্টেশনে সেই ট্রেনকে থামতে হয়েছিল।
প্রায় তিন দিন পরে যখন ভুট্টো করাচি গিয়ে নামলেন তখন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। করাচি ২ তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নাম ঘােষণা করেন। কেউই ভাবতে পারেনি এই *পিপলস পাটি অবিশ্বাস্যভাবে নির্বাচনে এতগুলাে আসন পেয়ে যাবে। নীতিহীন  কোনওরকম বাছ-বিচার না করে নির্বাচিত হওয়া মাত্র ঘােষণা দিলেন, খুতেই নয়, উঁইফোড় পিপলস পাটি আ দাম্ভিক ভুট্টো কোন ও রকম মুজিবকে কিছুতেই নয়, আমাকেই প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। এই অসম্ভব ও অমার্জনীয়  দাবি শুনে ইয়াহিয়া খানের পেটের নাড়িভুড়ি মােচড়ে উঠল, ঢেকুর তুলে বললেন , বেশক বেটা! জুলফিকার আলী ভুট্টো কিছুতেই শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তা পাকিস্তানের নেতা বলতে রাজি হলেন না। বাঙালিরা চিরদিন চাকরবাকর, কী করে তা হুকুমে পাকিস্তান চলতে পারে? দেখা গেল কোনও পাকিস্তানি চায় না যে মন্দিত. বেতমিজ’ লােক পাকওয়াতানের উজিরে আজম হােক। ইচ্ছা থাকলেও ইয়াহিয়া, পাকিস্তানিদের চাপে পড়ে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হলেন না। নির্বাচনের পর পরই ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা কিন্তু এক মাস, দুমাস, আড়াই মাস হয়ে গেলেও সমস্যার কোনও সুরাহা হল না। ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীরা ভেবেছিল নির্বাচন দিয়ে পাকিস্তানে শত্রু বিচ্ছিন্নতাবাদী শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে চিরদিনের জন্য পাকিস্তান থেকে মুছে ফেলবে; পাকিস্তানি শাসক শােষকদের তল্পিবাহক কয়েকটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতারা বাংলাদেশে শােচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করে। ভােটের বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধিকারকামী বাঙালি গােপনে দেশের ভাগ্য শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেয়, এটা ভােট গণনা শেষ হওয়ার আগে কেউ ধারণা করেনি। এমনকি ইয়াহিয়া ভুট্টো ও অন্যান্য হােমড়া চোমড়া সকলেই একটা হিসেব করে রেখেছিল, বড়। জোর শেখ মুজিব কয়েকটি আসন পাবে ইলেকসানের আগে বিদেশি একটা জনমত সমীক্ষা প্রকাশিত হলে ইয়াহিয়া খান পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অনেক দেরিতে। তবে পাকিস্তানে কেবল তিনি একটা মহৎ কাজ করে গেছেন, তা হল মিলিটারি ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের চাপ সত্ত্বেও নির্বাচন ওলট পালট করে দেওয়ার জন্য। নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেন নি। আর যিনি বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় নির্বাচিত করে দিলেন, এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বলতে গেলে তারই অবদান, সে কথা ভেবে মনে হয় ইয়াহিয়ার দানব, কার্টুন চেহারা কামরুল হাসান না। আঁকলে পারতেন।

সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!