You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২রা এপ্রিল, মঙ্গলবার, ১৯শে চৈত্র, ১৩৮০

সমাজ পরিচর্যায় তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রপতি

মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মক্ষম ও উদ্যম সময়ই হচ্ছে তার যৌবন কাল বা তারুণ্য। এজন্যে যে কোন দেশের পক্ষে তরুণ ও যুব সমাজ এক অমূল্য সম্পদ।
ইতিহাস বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, যে দেশ যত সার্থক ও সফলভাবে তার যুবশক্তিকে নানা কল্যাণমূলক কাজে লাগাতে পেরেছে সে দেশ ততোই উন্নতি করেছে। সমস্ত বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের মত যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সদ্য স্বাধীন উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে যুব সমাজের ভূমিকার কথা তো অস্বীকার করা চলে না।
তবে একটি কথা আছে। শুধুমাত্র তরুণ ও যুবক হলেই চলে না। একমাত্র সেই সব তরুণ ও যুবকেরা দেশের প্রকৃত কল্যাণ সাধন করে দেশে সুখ সমৃদ্ধি আনতে পারে যারা সৎ, চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক, স্বার্থত্যাগী, পরোপকারী, কর্মগ্রহী ও মেহেনতী-একমাত্র তারাই দেশের প্রকৃত কল্যাণ আনতে পারে। কিন্তু যারা বিভ্রান্ত, পদথলিত, কর্মবিমুখ, অসৎ, ও স্বার্থভিলাষী কিংবা কুটিল, তারা দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারে না, উপরন্তু এদের দৌরাত্ম্যে দেশকে নানা রকম দুর্যোগ সংকট ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সৎ, উদ্যোগী, ন্যায়নিষ্ঠ ও প্রাণ শপথ তরুণ ও যুব শক্তি সম্পদে বাংলাদেশ যে দীন নয় সে কথা বার বারই যুগে যুগে কল্যাণী ইতিহাসে স্বর্ণোজ্জ্বলে ছাপ পড়েছে। বিশেষ করে বিগত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক অদ্বিতীয় প্রতিবেদন।
কিন্তু এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, স্বাধীনতার মাত্র দু-এক বছর যেতে না যেতেই আমাদের মধ্যে এক হতাশা নেমে এসেছে। শুনতে খারাপ লাগে সত্যিই তবে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কই, আমাদের সুকুমারমনা যুবকদের বিরুদ্ধে আগে তো কোনদিনও এ অপবাদ আসেনি যে তারা জালিম, তারা হাইজ্যাকার, তারা ব্যাংক লুট করা ডাকাত কিংবা তারা পিস্তলধারী ছিনতাইকারী? তবে কেন আজ তাদের এ কলঙ্ক টিকা পড়তে হচ্ছে? কে তাদের এ পথে ঠেলে দিলো? কেন তাদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ?
হ্যাঁ-নিশ্চয়ই এ নিয়ে ভাবনার আছে, ভাবতে হবে। সবাইকে সম্মিলিতভাবে আমাদের এ সম্পদকে আবার কল্যাণের পথে চালিত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, যে পথে তারা হন্যে হয়ে ধাবিত হচ্ছে সে পথ পুণ্য কল্যাণের পথ নয়-সে পথে চললে সে তার নিজের ও নিজের মায়ের বুকে ছুরি চালাবে। সুতরাং মৃত্যুর পথ ছেড়ে তাকে জীবন পথের যাত্রী হতে হবে। একমাত্র তবেই সে তার দেশমাতৃকার প্রতি স্বীয় কর্তব্য পালন করে দেশের যোগ্য সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে।
তাই জাতির বর্তমান সমস্যা সংকুল সময়ে তরুণ সমাজের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত করার জন্য রাষ্ট্রপতি জনাব মুহাম্মদল্লাহ সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গত পরশু পৌরসভা ও অন্যান্য কয়েকটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় পরিচালিত ‘সমাজ পরিচর্যায় তরুণ’ শীর্ষকএক শহর পরিচ্ছন্ন অভিযানের উদ্বোধন কালে এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন যে, যুব সমাজকে দেশের সেবায় উদ্বুদ্ধ ও নিয়োজিত করা এক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্তব্য। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন একতা, নিঃস্বার্থপরতা ও শৃঙ্খলা নিয়ে সামাজিক ও জাতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য তরুণ সমাজকে আকুলভাবে আহ্বান জানান।
এক শ্রেণীর যুবসমাজের আত্মপ্রসাদ ও আত্মবিস্মৃতির জন্য রাষ্ট্রপতি গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তরুণদের মাঝে থেকে এ ধরনের প্রবণতা অবশ্যই সরিয়ে ফেলতে হবে।
যেসব দেশ প্রেমিক উৎসাহী যুবক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ পরিচ্ছন্ন অভিযানে অংশ নিচ্ছে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন যে, এ ধরনের কার্যক্রম দিয়ে বাংলাদেশের নবীন সমাজ জনকল্যাণ ক্ষেত্রে সত্যিই এক অমোঘ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি অভিযানকে সর্বতোভাবে সফল হবার কামনা করেছেন।
আমরাও আমাদের নবীন তরুণ ও যুব সমাজকে আকুলভাবে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা আবার বাংলা মায়ের দুঃখ মোচনের জন্য চিরাচরিত সেবার অমোঘ হাতিয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। ছড়িয়ে পড়ুন গ্রাম-বাংলার গঞ্জে গঞ্জে হাটে-মাঠে সমাজ সেবার মহান ব্রত নিয়ে। পঙ্কি=তার পথ, অন্যায়ের পথ, অবহেলার পথ, নির্যাতনের পথ ও অভিশপ্ত পথ পরিহার করে আবার আপনারা বিশ্বকে জানিয়ে দিন আমরাই বাংলার সেই তরুণ দামাল ছেলে যারা শোষণ-নির্যাতন ও নিস্পেষণের ঔপনিবেশিক বদ্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে মায়ের স্বাধীনতা-উজ্জল রক্ত সূর্য ছিনিয়ে এনেছি। আমরা এখনও সজাগ, সদৃপ্ত, মহান ও অতন্ত্র প্রহরী। আমরা এখনো মরিনি।

বাড়িভাড়া এখন সামাজিক উত্তেজনা

বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ লাভ, বাড়িওয়ালা কর্তৃক ভাড়াটিয়াদের হয়রানি, কোন কোন ক্ষেত্রে মারধর করা টা আজকের দিনের রাজধানী ঢাকা নগরীতে একটি নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা তো বটেই, কোন কোন ক্ষেত্রে তা রীতিমতো সামাজিক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মোটকথা বাড়িয়ালাদের দাপটে রাজধানীর ভাড়াটিয়ারা আজ দিশাহারা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের অনেকেরই বিনিদ্র রজনী যাপনের দশা। ‘ধন নয় মান নয়-এতোটুকু আশা’ ধরণীর এক কোণে কতটুকু বাসার যে বাসনা একদা এক নিরীহ অসহায় কবির মুখ থেকে বেরিয়ে ছিল যে অবস্থার প্রেক্ষিতে আজ সেই অবস্থায় বিরাজিত এই নগরীর সকল শ্রেণীর ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রেই। কি অতি নিম্নবিত্তের বস্তিবাসী বলুন, কি মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত গলির কথাই বলুন অথবা বলুন নির্ধারিত আয়ের লোকদের মাথা গোঁজার মত দু-কামরার একটি টিন-শেডের কথা বা বলুন ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, ইস্কাটন, বা পুরানা পল্টনের অভিজাত এলাকার বনেদী ভাড়াটিয়াদের কথা, সর্বত্র একই অবস্থা হয়। ভাড়া বাড়িও না হয় বাড়ি ছাড়-পথে দাঁড়াও আর ভাড়া বৃদ্ধির হারে কোন রেশিও নেই-বাড়িওয়ালাদের যখন যা খুশি দেড়শো টাকার বাড়ি-বাড়িওয়ালা যদি ভাবেন পাঁচশ টাকা ভাড়া দিতে হবে-কোন উপায় নেই-কোনো যুক্তি নেই, কোনো তর্ক নেই, ওই পাঁচশ টাকাই দিতে হবে, না হয় বাড়ি ছাড়তে হবে। এরমধ্যে আর কোনো বক্তব্য নেই। অবস্থাটা এখন এমনই।
গতকালকের পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে রাজধানী ঢাকা নগরীর বাড়ি ভাড়া সম্পর্কে বেশ একটা চাঞ্চল্যকর ও মারাত্মক অবস্থা সম্পর্কিত একটি খবর বেরিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, বাড়িভাড়া সমস্যা ক্রমশঃই জটিল রূপ নিয়ে বর্তমানে তার সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিরাজ করছে। বাড়িয়ালাদের কাছ থেকে দফায় দফায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি ও বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেয়ে ভাড়াটিয়ারা আজ দিশেহারা। স্বাধীনতার পর থেকেই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে এবং চলতি বছরে তার রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথাও ভাড়া তিন থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর শিকারে পরিণত হয়েছে নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা। বর্তমানে ঢাকা নগরীতে যে কোন এলাকায় সাধারণ দু কামরার টিনের একটি বাড়ির ভাড়া চারশো থেকে পাঁচশ টাকা। অথচ কোনদিনই এর আগে এই ভাড়া একশ থেকে দেড়শ টাকার বেশি ছিল না। বাড়িওয়ালাদের পক্ষ থেকে অবশ্য যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে, বর্তমানে বাড়ি তৈরির সরঞ্জামাদি তথা ইট, বালু, সিমেন্ট, কাঠ, স্যানিটারি ফিটিংস এর ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধিতে তারা বাড়ি ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে এই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি জনিত সমস্যার হাত থেকে জনগণকে রেহাই দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ খুবই সীমিত। ১৯৬৩ সালের এই সম্পর্কিত অর্ডিন্যান্সটি এখন আর ভাড়াটিয়াদের কোন স্বার্থই রক্ষা করতে সক্ষম নয়। তাছাড়া গত বছরের বাংলাদেশ প্রেমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে ভাড়াটিয়াদের অজ্ঞতা আইনের জটিলতা, বাড়িওয়ালাদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন আর এটাকে কার্যকরী করতে পারছেন না। সেজন্যই গতবছর ২২৩টি ও এ বছর যাবত ৮৫টি বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধ তাদের হাতে জমা হলেও সবটারই মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি।
হেন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এখন কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। প্রথমতঃ ভাড়াটিয়াদের রক্ষা করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশ থাকা সত্বেও সেই নির্দেশ কার্যকরী করার ব্যাপারে সকল রকমের বাধা বিপত্তি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসছেন না কেন? এবং তাদের এহেন উদাসীনতায় রাজধানী ভাড়াটিয়ারা কি শেষটায় বাড়িওয়ালাদের লুটের মাল হয়ে ঢাকা নগরী থেকে পলায়ন করতে বাধ্য হবেন? দ্বিতীয়তঃ বাড়িওলা গৃহনির্মাণ সরঞ্জামাদির মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর যুক্তি দেখাচ্ছেন, সেই যুক্তি নতুন নির্মিত বাড়ির ক্ষেত্রে হয়তো বা চলতে পারে কিন্তু পুরনো বাড়ির দেশে যুক্তি কতখানি ধোপে টেকে? এমতাবস্থায় রাজধানীর নিরীহ ভাড়াটিয়াদের রক্ষা করার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হউন-এটাই আমাদের কাম্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!