আসাদের আত্মত্যাগ ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানএমনি করে সচিবালয়ের সামনে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি অভূতপূর্ব ঘেরাও জমায়েত সংঘটিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে এ জমায়েতের সার্বিক সাফল্য থেকে দেশে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়, ফলে আসাদ লক্ষ্যবস্তু হয়। আইয়ুবের হায়েনা বাহিনী আসাদকে লক্ষ্য করে গুলি ছােড়ে, ঘটনাস্থলে আসাদের মত হয়। জনতা আসাদের রক্তমাখা জামা উড়িয়ে গুলি, টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে মিছিল করে রাজপথ উত্তপ্ত করে। আসাদের মৃত্যু সংবাদ শুনে ভাসানী পল্টনে তাৎক্ষণিক এক সভাতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি তােলেন এবং বলেন, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, আসাদের রক্তাক্ত জামার সােপান বেয়ে সমস্ত জুলুমের অবসান ঘটবে। সারা ঢাকা উত্তপ্ত হয়ে গেল। মিছিলে মিছিলে সয়লাব। ছাত্র-কিশাের-শ্রমিক-জনতা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি করে আকাশ-বাতাস উতরােল করে তুলল। জাগাে বাঙালি, জাগাে বাঙালি- চারদিক থেকে গানের সুরে মিছিলের স্লোগানে এক হয়ে সমস্ত ভুবন যেন ‘তাতিয়া মথিয়া’ তাণ্ডবে দুলতে লাগল। সাথে সাথে উচ্চারিত হতে লাগল, জাতির নেতা শেখ মুজিব, জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে বের করে আনব। পুলিশের নিষ্ক্রীয়তার কারণে রাজপথে সেনা মােতায়েন করা হল। সৈন্যদের গুলিতে প্রথমে আসাদ পরে কিশাের মতিউরের বুক ভেদ করে গুলি চলে গেল। তাদের আত্মত্যাগ বৃথা গেল না, গণঅভ্যুত্থান শিখায় শিখায় জ্বলে উঠল।
আইয়ুব খানের জল্লাদ সামরিক বাহিনী বেপরােয়া হয়ে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে তারা পুলিশের ওপর ভরসা না করে রাস্তায় রাস্তায় জনতার জোয়ার থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, পরে একদম বেপরােয়া। যেখানে সেখানে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এক অমানুষিক হত্যাকাণ্ড চালায়। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৪ নম্বর ব্যারাকে বন্দি ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ল্যান্স হাবিলদার মুজিবর রহমান। ভােরবেলা বিছানা থেকে তাদের ডেকে বাইরে আনে। হঠাৎ তারা কি বােঝার আগে গুলি করে। জহুরুল হক গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে, মুজিবর রহমান একটু জন্য বেঁচে যান। পেছন থেকে গুলি করেছিল তাই বােঝা যায় নি কে বা কারা গুলি করেছে। পরে প্রেস বুলেটিনে বলা হল, আসামিরা সকালবেলা নিরাপত্তার ফাকে পাল যাচ্ছিল, তার ভেতর সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হক গুলিতে আহত ” চিকিৎসা চলছে। অথচ তখন জহুরুল হকের লাশ ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে ৮ এসেছে, জনতা সে লাশ নিয়ে মিছিল করেছে। এই বিক্ষোভ উত্তেজনা ও গণজোয়ারের মুখে প্রেসিডেন্টের এক অর্ডিন্যা: আগরতলা মামলার শুনানির স্থান নির্ধারণ করা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে; হাইকোর্ট যথেষ্ট নিরাপত্তার অভাবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অথচ মামলাটি ২৮ মামলাটি হচ্ছে সিভিল হার্টের এক্তিয়ারে, সামরিক কিংবা সামরিক আদালতে বিচার করার কোনও সুযােগ নেই।
তবু ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হল নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। ১। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এসএ রহমান চেয়ারম্যান। ২। মুজিবর রহমান খান- ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, মেম্বার। ৩। মকসুমল হাকিম- ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি মেম্বার। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ট্রাইব্যুনাল শুনানি শুরু করে। সরকার পক্ষের ২২৭ জন। সাক্ষির তালিকা পেশ করা হয়। খুব অল্প সময়ের ভেতর খুব দ্রুত ১২৫ জন সাক্ষির সাক্ষ্য। গ্রহণ করা হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে সেসব জাজ্বল্যমান মিথ্যা, হাস্যকর ও একপেশে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব বিবরণও পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। তা পড়ে মানুষের মনে বিক্ষোভ আরও বেশি করে জেগে উঠল। ফলে এক বিশাল গণঅ্যুত্থানের অনিবার্য। সম্ভাবনা দেখা দেয়। মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য নেতৃবর্গ খাওয়া-দাওয়া, ঘুম-নিদ হারাম। করে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে অভুথান পরিচালনা করতে লাগলেন। অবশেষে বাংলাদেশে পাকিস্তান মুখ থুবড়ে পড়ল । দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে পড়ল। আইয়ুব খানের প্রত্যক্ষ মদদে বিচার বিভাগও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ল। আগরতলা মামলার বাদী পক্ষের প্রধান কৌসুলি ছিলেন মধুর কাদির আর শেখ মুজিবের পক্ষে ছিলেন ব্রিটিশ আইনজীবী উইলিয়ামস টমাস উইলিয়ামস।
আসামি পক্ষের কৌসুলির জেরার চোটে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে ফাঁস হয়ে গেল যে এটা একটা বানােয়াট মামলা। ফলে একদিকে জনতার জোয়ার, অন্য দিকে দুর্বল এই মামলার রঞ্জু ছিড়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ শেখ মুজিব বীরের মতাে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলেন। সেদিনই আইয়ুব খানের পতন হল। রেডিও ঘােষণার মাধ্যমে তিনি প্রেসিডেন্ট ও সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে পদত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বলেন, দীর্ঘ হাজার বছর বাঙালিদের অন্যরা শাসন করেছে তাতে অপরাধ নেই। কেবল আমি দশ বছর তাদের গোলাম করে তাদের ওপর তাবেদারি করেছি এটা তারা মেনে নিতে পারল না। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হল, জনতার আন্দোলন বিজয় লাভ করে। ১৯৬৯ সালের বিখ্যাত গণজাগরণের চরম দিনগুলাে হল ১৯ জানুয়ারি। থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৯ জানুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও অভিযান চলে। ঘেরাও শব্দটার। আগে প্রচলন ছিল না, এভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করে দাবি আদায়ের এই অভিনব পন্থা বাঙালিরা সৃষ্টি করেছে।
ইংরেজি অভিধানে অবিকল শব্দটি স্থান। পেয়েছে। – ২০ জানুয়ারি আসাদ ঘেরাও অভিযানের মিছিলে সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ হারান। গুলতে তার বুক এফোঁড়-ওফোড় হয়ে গেল। অকুস্থলে তার মৃত্যু হয়। তার লাশ নিয়ে। আল হয়। তার রক্তমাখা শার্ট পতাকা করে সগ্রামের নিশান তৈরি হয়। এই শার্ট নিয়ে। মহলে গগনভেদি আওয়াজ উঠে আইয়ুবের গদি নড়বড় করে দিল। আসাদের রক্তমাখা। ” নিয়ে কবি শামসুর রাহমান একটি রক্তশাণিত কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি অমর হয়ে আছে। জনতা সেদিন মােহাম্মদপুরের আইয়ুব গেট থেকে ফলক তুলে গেটটির নাম আসাদ গেট রাখা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি পল্টনে মওলানা ভাসানী স্বাধীন-পূর্ব পাকিস্তানের দাবি করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট ও মিছিলে কিশাের মতিউর সৈন্য, গুলিতে প্রাণ হারান। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জনতা রামপুরা মােড়ে একটি গড়ে তােলে। সেখানে একটা গেট নির্মাণ করে কিন্তু পরের দিন সেটা টিকে থাকে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছাত্র-জনতা জেল থেকে বের করে নিল। লন্তু মানুষের ঢল গুলিস্তান, পল্টন, নবাবপুর, লালবাগ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। শেখ মুজিবকে জেল গেটে প্রথম সংবর্ধনা দেন মওলানা ভাসানী, ফুলে ফুলে ভারাক্রান্ত হয়ে তিনি সহাস্যে হাত নেড়ে জনতাকে উচ্চ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। শেখ মুজিবকে ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত শীর্ণ মনে হচ্ছিল, কিন্তু উজ্জ্বল দীপ্তি তার সারা মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন প্রমাণিত হল শেখ মুজিব সারা বাংলার অবিসংবাদিত নেতা।
সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ