You dont have javascript enabled! Please enable it! ছয় দফা দাবি পেশ - সংগ্রামের নোটবুক

ছয় দফা দাবি পেশ

পূর্ব বাংলার ওপর শােষণ-নির্যাতন, প্রকারান্তরে পূর্ব বাংলাকে অরক্ষিত রেখে আইয়ুব খান সারা পাকিস্তানে একটা ভয়াবহ বৈষম্য অবস্থা সৃষ্টি করলেন। বলতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও কর্মকাণ্ড পূর্ববঙ্গে নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক বাজার রয়েছে এখানে। জীবনযাপন ব্যয় নির্বাহের উপায় পূর্ব বাংলায় ক্রমশ সীমিত হতে লাগল। চাকরি বা অন্য কোনও দিকে একেবারে কোণঠাসা হয়ে গেল। গরিব ক্রমশ গরিব আর ধনী কেবল ধনী। হতে লাগল। ধনীর সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানে বৃদ্ধি পেতে লাগল। এ পরিস্থিতিতেও দূরদর্শী শেখ মুজিবুর রহমান সােনার বাংলা শ্মশান কেন’ এক পােস্টার ছাড়লেন সারাদেশে। তারপর ঐতিহাসিক ছয় দফার দাবি উত্থাপন করলেন। ১৯৬৬ সালের ১৭ মার্চ ঢাকার বুকে মিছিল চলাকালে পুলিশের গুলিতে এগার জন দেশপ্রেমিক বাঙালি নিহত হয়। এ রক্তপাতে মিছিল থেমে যায় নি, আন্দোলনও মুষড়ে পড়ে নি। বরং সােনার বাংলা শ্মশান কেন—এ প্রশ্ন সকল বাঙালির প্রাণের ভেতর তােলপাড় সৃষ্টি করেছিল।

ছয় দফা ও তার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ

১। শাসনতন্ত্রে ফেডারেশনের ব্যাখ্যা থাকতে হবে, তা প্রকৃত অর্থে ফেডারেশন হবে, তার ভিত্তি হবে লাহাের প্রস্তাব এবং পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার। তাতে বিধান পরিষদ (জেন প্রতিনিধি)-এর প্রাধান্য থাকবে। পরিষদ বয়স্কদের ভােটাধিকার নিশ্চিত করবে এবং তার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচন হবে।

২। ফেডারেশন সরকার দুটি বিষয়ে কেবল কর্তৃত্ব করবে; এক, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়। অবশিষ্ট সব বিষয়ে ফেডারেশনে যােগদানকারী রাত কর্তৃত্ব থাকবে। ফেডারেশন যে ধরনের হােক তাতে এমন অপরিহাণ পূরণ করতে হবে। সেটা হল জাতীয় ঐক্য। তার সংস্থাপক হবে ফলে সরকার। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, অর্থনৈতিক বিষয়াদি ও শাে অধিকার একই নীতিতে বজায় থাকবে। (লক্ষ্যতব্য যে ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্টের দাবি ছিল কেন্দ্রের হাতে থাকবে মুদ্রা, প্রতিরক্ষা ও বিষয়।)

৩. (ক) পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে ভাঙানাে যায় এমন মুদ্রা প্রবর্তন করতে হবে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক অথচ অবাধে পরস্পর

(খ) সারাদেশের জন্য একই মুদ্রা হবে। এ ক্ষেত্রে কার্যকরী শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে পূর্ব হতে পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজি অপসারণ না হতে পারে। ‘পৃথক রিজার্ভ ব্যাংকিং প্রথা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ও আর্থিক নীতি প্রবর্তন করতে হবে। দেশের বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকলে অব্যাহত শােষণ চলতে থাকবে। তাই সমগ্র দেশে ক্রমান্বয়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, তাতে করে শোষণ প্রক্রিয়া আপনাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। ৪। ফেডারেশন সরকারের কোন প্রকার ট্যাক্স বসাবার কর্তৃত্ব থাকবে না।

প্রযােজ্য ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারের সুপারিশে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা প্রয়ােজন হলেই কেবল চলতে পারে। (ক) দেশের দুই অঞ্চলের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের দুটো পৃথক হিসাব থাকতে হবে। (খ) পূর্ব পাকিস্তান সরকারের উপার্জন এই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে, সেরূপ পশ্চিম পাকিস্তানেরও। ফেডারেশন সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন দুই ডানা সমভাবে পূরণ করবে। সমান সম্ভব না হলে একটা নির্দিষ্ট হারে তা দিতে হবে। (ঘ) দেশজ উৎপন্ন ও উৎপাদন উভয় অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে যাতায়াত করতে পারবে। শাসনতন্ত্রে ইউনিট সরকার (ফেডারেশন সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হবে। | তা যে কোনও বিদেশের রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, ট্রেড ইউনিয়ন স্থাপন এবং চুক্তিপত্র সম্পাদন করতে পারবে। ফেডারেশনের প্রত্যেক রাজ্যে আধা মিলিটারি বা আঞ্চলিক বাহিনী রাখবার অধিকার শাসনতন্ত্রে বজায় থাকবে। ঐতিহাসিক দাবি প্রকাশিত হবার পর পূর্ব পাকিস্তান যেমন জেগে উঠল, আইয়ুব খানের মিলিটারি সরকার ভীষণ রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণি এটা রুখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। তাদের দালাল পত্রিকাগুলােতে বারবার প্রচার করতে লাগল যে শেখ মুজিব ছয় দফা দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে পৃথক করে নেবার জন্য, ছয় দফা মূলত পাকিস্তানকে দুই টুকরা করে দেবার ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রজু করেন। হয় দফার আদায়ে যে ঐতিহাসিক পােস্টার সারাদেশে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল তারাতি তা ছিড়ে ফেলা হয়। কিন্তু দেশের মানুষের মন থেকে সে দলিল কখনও উপড়াতে পারে নি।

সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ