You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঙালিরা রুখিয়া দাঁড়াও যে কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে পাকিস্তানি শাসকচক্র সহজে যে পন্থা বেছে নেয় তা হল দেশের ভেতর দাঙ্গা সৃষ্টি করে দেওয়া। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে কাবু করতে কেন্দ্রীয় সরকার বিহারিদের দিয়ে প্রথম আদমজি জুট মিলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা লাগায়। তার দায়-দায়িত্ব রাখে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ওপর। তার সাফাই দিয়ে ৯২ক ধারা প্রয়ােগ করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় । আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনগণ ক্রমে বিরূপ হয়ে উঠছে দেখে এক রকম গণতন্ত্রের উদ্ভাবন করলেন, যার নাম তিনি দিলেন মৌলিক গণতন্ত্র। ইউনিয়ন ভিত্তিক মৌলিক গণতন্ত্রীরা নির্বাচিত হবে, তারা অবশেষে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করবে। প্রেসিডেন্ট তার পছন্দমতাে লােক নিয়ে একটা পার্লামেন্ট সৃষ্টি করবেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি রাজনীতিবিদদের কারাগার থেকে মুক্ত করে তার মৌলিক গণতন্ত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সুযােগ দিলেন। কিন্তু রাজনীতিবিদরা পুরানাে কোনও রাজনৈতিক দলের নামে রাজনীতি করলে চলবে না, নতুন রাজনৈতিক দলের নাম রেজিস্টারিভুক্ত করতে হবে। আইয়ুব খান নিজে একটা কনভেনশান ডাকলেন, তাঁর দলের নাম হল কনভেশন মুসলিম লীগ। সম্পূর্ণভাবে না হােক তবু দেশের রাজনীতির একটা রন্ধ্রপথ দেখা দিল। শহীদ সােহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগ ছেড়ে এনডিপি করলেন তাঁর পুরানাে মুসলিম লীগার বন্ধুদের নিয়ে। আওয়ামী লীগে বিশাল শূন্যতা দেখা দিল। সােহরাওয়ার্দী শূন্য আওয়ামী লীগ মানে মাস্টারহীন ক্লাস। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ ছাড়লেন না। কার্যত আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পার্টিতে পরিণত হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানে তবুও পীরজাদা নসুরুল্লাহ খান পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখেন। এ কথা ঠিক নয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য না জায়েজ তা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য জায়েজ, অর্থাৎ নসুলুল্লাহ খানকে দিয়ে আওয়ামী লীগের ভাঙন ধরানাে হল, এটা আইয়ুবের কারসাজি। এই দুঃসময়ে হঠাৎ করে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বৈরুতের এক হােটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশবাসী গভীর শােকে নিমজ্জিত হলেও আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। শেখ মুজিব নিমজ্জমান আওয়ামী লীগ ধরে রাখলেন, তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এ কারণেও তাকে কিছুদিনের জন্য জেলে পােরা হয় । শেখ মুজিব কত বার কত বছর যে জেল খেটেছেন তার হিসাব-নিকাশ নেই। বলতে গেলে জেলখানাই ছিল তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ের বাসস্থান। এভাবে শেখ মুজিবকে জেলে নেওয়ায় একটা অসন্তোষ দেখা দিল। আইয়ুব খান সেটা ধামাচাপা দেবার জন্য ফন্দি আঁটতে লাগলেন, মুজিবকে মুক্তি দিলেন বটে কিন্তু নতুন করে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিলেন বিহারিদের দিয়ে। ঢাকার হিন্দু প্রধান এলাকা তাঁতিবাজার, শাঁখারি বাজার, সূত্রাপুর, ওয়ারী, নবাবপুর সব জায়গায় অকস্মাৎ রাতের বেলা ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ল লুটপাট, নারী ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড চালাল। সারারাত চিকার-হানাহানি, ঢাকা মহােৎসব। সচেতন বাঙালিরা আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না।

সকল আমির হােসেন চৌধুরী এবং আরও অনেকে যারা বিহারিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন করেছিলেন তারা ঘরের বের হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঙ্গা থামাতে তৎপর। বিহারিরা নিজেদের চেহারা সম্পূর্ণভাবে যেন পাল্টে ফেলল। পরদিন দশটায় নবাবপুর-ঠাটারিবাজার ঘুরে বিহারি আর দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত করতে চাইলেন। পর্যায়ে বংশাল মােড়ে কয়েকজন দুবৃত্ত এদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। সর্বজন সম্মানিত আমির হােসেন চৌধুরী ছুরিকাঘাতে দিনদুপুরে প্রকাশ্য রাস্তার ওপর ঢলে পড়লেন। হাসপাতালে নেবার পথে প্রাণ হারান। শেখ মুজিব ও তাঁর নেতাকর্মীরা মুখ বুজে সহ্য করতে পারলেন না। তারা ব্যানারে বাঙালিরা রুখিয়া দাঁড়াও’ নিয়ে রাস্তায় মিছিলে নামলেন। সে মিছিল প্রেসক্লাব অতিক্রমকালে মােনায়েম খান ও তার গুণ্ডা বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। স্বয়ং মােনায়েম হুকুম দেন, ‘মারাে হারাজাদাকো’। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভয় পাওয়ার লােক নয়, ‘আইয়ুব খান মুরদাবাদ মােনায়েম খান নিপাত যাক’ স্লোগান দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। আশ্চর্য যে স্বয়ং মােনায়েম গাড়ি করে সে পথ অতিক্রম করছিলেন। শেখ মুজিব উদাত্ত স্বরে ‘ধর ধর দালাল ধর বাঙালিরা রুখিয়া দাঁড়াও’ বলে অগ্রসর হলে মােনায়েম খান অকুস্থল থেকে দ্রুত পালিয়ে যায়। সে মিছিল নিয়ে গুলিস্তান হয়ে নওয়াবপুর রেল ক্রসিংয়ের সামনে যখন অগ্রসর হলে গভর্নর হাউসের গেটে জটলা দেখা গেল, নবাবপুরের দিকে এগিয়ে যাবার কথা দাঙ্গা কবলিত জায়গায় পাশে ছিলেন একজন তাঁকে এক বিহারি জিজ্ঞেস করল, “তােমােক ক্যায়া চাহাতা হাে?’ তিনি তাকে বুঝিয়ে বলতে গেল, আমরা শান্তি মিছিল করছি, হিন্দুকো মৎ মারাে।  ক্যায়া হিন্দু কো মৎ মারাে? তােমভি হিন্দু, একথা বলে তার পাঁজরে এক হােম বসিয়ে দিল, ভাগ্যিস ঘা তেমন লাগেনি। নবাবপুরের দিকে বেশিদূর অগ্রসর হতে পায় গেল না। দুটো বাজে। তখনও চিকার, কালাে ধোঁয়া আকাশে কুণ্ডলী দিচ্ছে এমন  বাঙালিরা সচেতন হয়েছে, দাঙ্গা রুখতে হিন্দুর জন্য মুসলমান ভাই এই হ দিলেন। বাঙালির ইতিহাসে একথা লেখা হয়ে রইল।

আইয়ুব খান ১৯৩ গােড়াতে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার ঘােষণা দিনে বিরােধী দলের পক্ষ থেকে ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম হল। বস্তাপচা মৌলিক গণতন্ত্রী হােক তবু সারাদেশে নির্বাচনের জোয়ার দেখা মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় সে জোয়ার এমনই তুঙ্গে পৌছল যে প্রত্যেক ছেলে-বুড়াে নারী-পুরুষ যেন নতুন জীবনের জন্য মাতােয়ারা। ফাতেমা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছােট বােন। আজীবন জিন্নার সাহচর্যে থেকেছেন পুখােশ মুহুতে দেশকে রক্ষা করার জন্য বৃদ্ধ বয়সে তিনি মাঠে নামলে” আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের করার ঘােষণা দিলেন। সমস্ত র বিরুদ্ধে সমর্থন দেওয়া শর জোয়ার দেখা দিল। শেখ হল যে প্রত্যেক গ্রাম-মহল্লার ‘। ফাতেমা জিন্নাহ হলেন

থেকেছেন। দেশের এই ৩ নামলেন। নির্বাচন হল,
দেশের মানুষ যে পরিমাণে আইয়ুববিরােধী মনােভাব দেখিয়েছে ফলাফলে তার কিছুই পাওয়া গেল না। স্বাভাবিক, ভােটার তাে জনসাধারণ নয়, প্রত্যেক গ্রাম-মহল্লার মৌলিক গণতন্ত্রী কয়েকজন ভােটার, পাতানাে ভােটে কিংবা তাদের কিনে নিতে আইয়ুব খানের বেশি বেগ পেতে হয় নি। ভােটের কারচুপি । নির্বাচনে জিতেও আইয়ুব খানের হার হল । এই নির্বাচনের কারণে দেশবাসী জেগে গেছে। প্রকাশ্যে আইয়ুব বিরােধী তৎপরতা এবং তাঁর শাসন আমলের কুকীর্তি লিখিত আকারে জনগণের কাছে পৌঁছে গেছে। আইয়ুব এখন আগের মতাে মােচ খাড়া করে হাসতে পারেন না। তাঁর চিন্তা এই জঞ্জাল কী করে দূর করা যায়?

সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!