You dont have javascript enabled! Please enable it! 1948 | আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র - সংগ্রামের নোটবুক

আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র

পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ ঘােষণা করেন, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । একথা কেবল জিন্নাহর ছিল না, বাংলাদেশ বা মুসলমান বাঙালিদের অনেকেই এ মত পােষণ করতেন। নাজিমুদ্দিন নুরুল আমিন তাে করতেনই পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের। সকল সদস্যও এ মত পােষণ করতেন। একবার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেছেন। তাছাড়া শেরে বাংলা এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে সমর্থন দিয়ে গেছেন। কয়েকজন ছাত্র ১৯৬৩ সালে নুরুল আমিনের সঙ্গে তার বাসভবনে একবার দেখা করতে গিয়েছিল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার জন্য। তিনি আইয়ুব বিরােধী মাের্চা এন ডি এফ সমর্থণ করেছিলেন তরু। তাদের থামিয়ে বলেছিলেন, ‘শের কো পিঞ্জিরা সে মৎ নিকাল না অর্থাৎ আন্দোলন হল বাঘ, তাকে খাঁচা থেকে বের করে দিলে ফের খাঁচায় বন্দি করা সম্ভব হয় না। তিনি আইয়ুব বিরােধী ছিলেন বটে কিন্তু কোনও প্রকার আন্দোলনের বিরােধী ছিলেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা মূলত উর্দুই ছিল, বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন মৃত্যুর আগেও বরদাস্ত করতে পারেন নি নুরল আমিন। তবে জিন্নাহ যখন ১৯৪৮ সালে উর্দুর জন্য ওকালতি করছিলেন তখন ঢাকায় শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্র-যুবকরা তাঁর এই বক্তব্যকে ‘নাে নাে প্রতিবাদ দিয়ে জব্দ করেন। কিন্তু তবু উর্দু চাপিয়ে দেবার চক্রান্ত জোরদার চলতে থাকে। উর্দু লেখা হয় আরবি হরফে, তাই কেউ কেউ বলতে থাকে আল্লাহর কালামের হরফে লেখা বড় পবিত্র ভাষা উর্দু। বাংলা যদি আল্লার কালামের হরফে লেখা হয় সংশয়-দ্বিধা থাকবে না, কায়েদে আগস্ট প্রতিশ্রুতিও রক্ষা পায়, আরবি হরফে বাংলা লেখা হলে সেটাই হবে উর্দু। উর্দু মানে সেশ, আকবরের সময় থেকে এই রেখতা বা মিশ্র ভাষার উদ্ভব ঘটে। উর্দু মূলত ২ জবান, অর্থাৎ হিন্দি ভাষার নামান্তর। হিন্দুস্থানে যে কোনও লােক এই ভাষা শুনলে পারে কিংবা কম-বেশি বলতে পারে। উর্দুতে কেবল কয়েকটা ফার্সি শপে রয়েছে। বাংলা ভাষাতেও অজস্র আরবি-ফার্সি শব্দের সম্ভার রয়েছে। বিশেষত মুসলম মুখে আধা-বাংলা আধা-ফার্সি ব্যবহার করে থাকে। তবে উর্দু ভাষাতে মুল শরাফতি উজ্জ্বল হয়।  যারা আরবি হরফে বাংলা চালু করতে চান তাদের আরও দাবি যে বই লেখা হয় আরবি হরফ দিয়ে, ইরানের ফার্সি, আফগানিস্তানের পশতু অনেকগুলাে ভাষা, মধ্যপ্রাচ্য ও বলকানি ভাষা। উর্দু ছাড়াও উপমহালে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি ইত্যাদি ১৮টি ভাষা আরবি হরফে লেখা হয়।

কে “কে নিজস্ব করে, অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রে কিছু বর্ণমালা বাড়ি দু ভাষাতে মুসলমানদের যে বহু দেশের ভাষা •শর পশতু, আফ্রিকার পমহাদেশের কাশ্মীরি, হয়। সেসব ক্ষেত্রে তার মালা বাড়িয়ে কিংবা  সংকচিত করে নিয়েছে। যেমন ফার্সি বর্ণমালায় সাতটি অতিরিক্ত বর্ণ যুক্ত হয়েছে, উর্দুতেও তাই । আফ্রিকান ভাষাতে কোনও কোনওটাতে সতেরটি পর্যন্ত অতিরিক্ত বর্ণ যুক্ত হয়েছে। তাহলে বাংলা প্রকাশ করতে আরবি বর্ণমালাতে না কুলালে অতিরিক্ত বর্ণ যুক্ত করা যুক্তিসঙ্গত।  কেন বাংলা ভাষা আরবি হরফে লিখতে হবে। বাংলা ভাষার তাে উন্নত বর্ণমালা রয়েছে। উত্তর হল, বাংলা বর্ণমালা সংস্কৃত বর্ণমালার নামান্তর। বাঙালি মুসলমান শিশুদের জন্য খুব কষ্টকর। পক্ষান্তরে প্রত্যেক মুসলমানকে শৈশবে কিংবা সব সময় অতি অবশ্য কোরআন পড়া শিখতে হয়। চার-পাঁচ বয়সেই তাদের হরফুল কোরআন তাে আয়ত্তে এসে যায়। তার ওপর মনে থাকে পবিত্রতা, বিশুদ্ধ উচ্চারণে ও আন্তরিকতায় কোরআনের বর্ণমালা শেখা হয়ে যায়। তখন মুসলমানদের মুখের জবান যাই হােক কোরআন প্রকাশ। যাতে তা চর্চা করতে বেশি আর পরিশ্রম করতে হয় না। কোরআনীয় বই ব্যবহার ও প্রচার করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। বিজাতীয় সংস্কৃত জাত বাংলা বর্ণ ব্যবহার করা গুনাহর সামিল। বহু আগে বাংলাদেশে যখন মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল রাষ্ট্রভাষা ছিল আরবি ও ফার্সি। দলিল-দস্তাবেজ লেখাজোখা হত ফার্সিতে। অনেকে বাংলা ভাষায় লিখলেও সে সব দলিল আরবি হরফে লেখা হত। তখন মুখের ভাষা বাংলা হলেও লেখার ভাষা কদাচিৎ বাংলা ছিল। কেবল কবিরা তাদের কাব্য লেখার জন্য বাংলা হরফ ব্যবহার করতেন। কিন্তু মুসলমান কবিদের অনেকেই আরবি হরফে তাদের কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করতেন। এ রকম কমপক্ষে ৭২টি কাব্য বা পুঁথি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে, যা আরবি হরফে লেখা। তাহলেও গােটা মুসলমান শাসন আমলে সার্বিকভাবে বাংলা ভাষাকে আরবি বর্ণমালা গ্রাস করতে পারে নি। এর কারণ হিসেবে পণ্ডিতরা বলেন, বাংলা ভাষার প্রতিভাই এমন যে বিদেশিরা এখানে এসে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। স্বয়ং সুলতান আলাউদ্দিন হােসেন শাহ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপােষক হয়েছিলেন। তিনি আরবি হরফে লেখার জন্য নির্দেশ দেন নি।

তা ছাড়া বাংলা ভাষার গঠন এমন যে, এই ভাষাকে আরবি ভাষা ও বর্ণমালা দিয়ে সুষ্ঠুভাবে লেখা যায় না। একজন আরব কিছুতেই বিশুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারে না। তাদের পাকিস্তানকে বাকিস্তান বলতে হয়। দেখা গেছে একজন আরব আরবি হরফে হলেও তখন। কিছুতেই বাংলা পড়তে পারে না, অশুদ্ধ উচ্চারণ, তার ওপর দুঃসাধ্য পাঠ। তৃতীয়ত মুসলমান রাজত্বকালে ইংরেজরা বাংলার প্রকৃত গােড়াপত্তন করে তারা ফেকটরি ভাষা। হিসেবে ফার্সি বা আরবি হরফে বাংলা না নিয়ে বাংলা হরফে বাংলা গ্রহণ করেছেন। ক্রমে বাংলার প্রসার ঘটেছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের এবং বিদ্যাসাগরের প্রভাবে। আর কোনও আরবি হরফে বাংলা লেখার অভ্যাস বর্তে থাকে নি। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক তথ্য না জেনে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে বিনষ্ট করার জন্য এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে কয়েকজন ভাড়াটে লােক বুদ্ধিজীবী হিসেবে এর পক্ষে দাঁড়ায়। বাংলা হরফকে হিন্দুদের মূর্তি প্রতিকৃতি বলে উল্লেখ করেন লেখেন এবং “” সাহিত্য থেকে হিন্দু লেখকদের রচনা বই থেকে বাদ দেবার জন্য সুপারিশ করে। সেয়দ আলী আহসান, সাজ্জাদ হােসেন এবং আরাে অনেক বশংবদ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে  পাকিস্তানে বাংলা চর্চার দাবি করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত পাকিস্তান রেডিও টিভিতে পা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমান, । কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হন; তিনি ১৯৪৮ সালে করাচিতে প্রথম বাংলা ভাষার জন্য আরবি হয় প্রচলনের যুক্তি দেখান । ১৯৪৯ সালে সরকারিভাবে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।  এরপর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান পাকিস্তানকে ইসলামি মতাদর্শে গড়তে হলে বাংলা ভাষাকে আরবি হরফে লেখার জন্য সুপারিশ করেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে চেয়ারম্যান করে একটি বাের্ড গঠন করা হয়। এ বাের্ডে মাওলানা আকরাম খান জুলফিকার আলী প্রমুখ ছিলেন। বাের্ডের সকল সদস্য সরকারিভাবে সিদ্ধান্তকে অনুমােদন করলেও শহীদুল্লাহর একার প্রয়াসে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় নি। এর পর পূর্ব পাকিস্তান। ভাষা কমিটি’ গঠিত হয়। তাতে বিরাট অঙ্কের টাকা মঞ্জুর করা হয়। সে কমিটির গৃহীত টাকা কেউ ফেরৎ দেওয়া হয় নি। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে ফের বাংলাকে আরবি হরফে চালুর জন্য জোর তাগিদ দেন।

তিনি কড়াকড়িভাবে সর্বক্ষেত্রে রবীন্দ্র বর্জনের হুকুম দেন। মােনায়েম খান তাই মুসলমান লেখক-শিল্পীদের নতুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও কবিতা লিখতে নির্দেশ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়। আরবি (উর্দু) বাংলা ও রােমান হরফের তুলনামূলক বিচার করলে প্রমাণ করা যায় যে বাংলার জন্য আরবি হরফ মােটেই সমীচীন নয়। জের, জবর, পেশ ইত্যাদি স্বরচিহ্ন না বসালেও উর্দুর লিখন পদ্ধতি বাংলার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। উর্দুতে সাধারণত স্বরচিহ্ন বসানাে হয় না কিন্তু উর্দু হরফ বাংলাতে লিখতে গেলে স্বরচিহ্ন ব্যবহারের প্রয়ােজন হয়, তাতে লিখন দ্রুতির সুবিধা আর থাকে না। কিন্তু পঠন দ্রুতি বাংলা হরফে অনেক বেশি ও শ্রেয়। আরবি হরফের সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে এর নােকতা বা বিন্দু বাহুল্য। এ সব নােকতা অক্ষরের প্রধান অংশ থেকে বিযুক্ত করা সম্ভব নয়। কোনও কারণে এ নােকতায় হেরফের হলে অর্থ একেবারে বিনষ্ট হয়ে যায় । কিন্তু রােমান হরফের লিখন। পঠন দ্রুতি অনেক বেশি যে কোনও হরফের চেয়ে, তবু বাংলা ও রােমান হরফের চাই উন্নত দ্রুতি নিশ্চিত করতে পারে। বাংলা ভাষার ওপর পাকিস্তানি এ সব বলৎকারের কারণে বাংলার সাধারণ মাপু বুদ্ধিজীবীরা ক্রমেই বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ল। publication
1. A comparative study of three Scripts Pakistan 2. হরফ সমস্যা : বাংলা একাডেমী পত্রিকা ১৩৬৪।

 

সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ