ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন
ক্ষুব্ধ ভাসানী ১৯৫৭ সালের ২ জুলাই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পুনরায় এক সমাবেশের আহ্বান করলেন। সমাবেশস্থল হল ঢাকার সদরঘাট রূপমহল সিনেমা হল। তার অনুগতরা এবং বামপন্থিরা এ সমাবেশে যােগ দেয়। ভাসানী দুঃখ করে বললেন, আওয়াম লীগের ভেতর সুবিধাবাদী কায়েমি শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাই নয়, তারাই এখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে দখল করে নিয়েছে। আমি এ প্রতিষ্ঠানে থাকা ছেঁড়া জুতা মতাে, আমি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাই। সমাবেশে তার দীর্ঘদিনের সহচর মােজাফফর আহমদ ও শেখ মুজিব উপস্থিত ছিলেন। মােজাফফর আহমদ তাকে এ অবস্থায় নতুন দল করার জন্য সমর্থন জানান। সমাবেশে যেহেতু মােজাফফরের মতো বামপন্থি নেতাকর্মীরাই বেশি উপস্থিত হয়েছে, সকলেই এই মতের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেন, তারা আওয়ামী লীগের চরিত্রের সঙ্গে আর খাপ খাওয়াতে পারছেন না এমন ক্ষোভের কথা বারবার উঠে এসেছে। শেখ মুজিব ভাসানীর স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব আগে থেকেই সমর্থন দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তাঁর মনে দ্বিধাগ্রস্থতা রয়েছে, ভাসানিকে সমর্থন করলে সােহরওয়াদীও ওয়ার্কিং কমিটির সমর্থন হারাবেন। তা তিনি ভাসানীকে অনুরােধ করেন আওয়ামী লীগ ভাগ না করতে কারণ এটা তাে তার হাতের সৃষ্টি সংগঠন আর আওয়ামী লীগ ভাগ হলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি দুর্বল হয়ে যাবে, কেন্দ্রিয় সরকারের কুচক্রী মহল বাংলার ওপর আঘাত হানতে পারে। তাঁর কথা পরে সত্য হল।
এ প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলন লেনিন গেট, মাও সেতুং গেট বানানােকে সাংঘাতিকভাবে আক্রমণ করলেন। তিনি আওয়ামী লীগের এক কর্মী সভায় এ প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, গেট যদি করতে বাংলাদেশ গেট হচ্ছে আসল গেট। কিন্তু মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের অনুরােধ রাখতে পারলেন না, তবে তার প্রিয় আওয়ামী শব্দ নতুন দল করতে বাদ দিতে রাজি ছিলে ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের পাখতুন নেতা খান আবদুল গাফফার সঙ্গে মতবিনিময় হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সােহরাওয়ার্দীর পকেটে পরিণত হয়েছে। মাহমুদুল হক খান ওসমানির মারফত ভাসানী গাফফার খান নিয়ে সংযােগ স্থাপন করেন। গাফফার খানকে সীমান্ত গান্ধী বলা হত, অহিংস মন্ত্রের অনুসারী এবং পাকিস্তান সৃষ্টির বিরােধিতাকারী। উত্তর প্রদেশে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা, দেশ বিভক্তির আগে থেকে কংগ্রেসের লালকুর্তা সংগঠন সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তাকে লালকুর্তা নেতা বলা হত। ২ সৃষ্টির পর গান্ধী-নেহেরু তাকে ভারতে আসতে অনুরােধ করেন। পকিস্তান সৃষ্টির পর গান্ধী-নেহেুরু তাঁকে ভারতে আসতে অনুরোধ করেন। কিন্তু গাফফার খান পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন সহ্য করেও মাতৃভূমিতে থাকেন, কারা ভোগ করেন, তবু
দেশ ছেড়ে যান নি। অবশেষে তিনি ন্যাশনাল পার্টি গঠন করেন। মওলানা ভাসানীর। অনুরােধে তিনি ঢাকায় আসেন এবং মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর ন্যাশনাল পার্টিকে মিশিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সৃষ্টি করতে সম্মত হন। সেই তাগিদে ৩১ জুলাই ১৯৫৭ সালে সেই রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। সেই সম্মেলনে মিয়া ইফতেখার উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। তিনিও নিজের খােদাই। খেদমতগার পাটি বিলুপ্ত করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করেন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা ভাসানী, সহ-সভাপতি খান আব্দুল গাফফার খান, তিনি গান্ধীর সমসাময়িক প্রবীণ নেতা, তবু নেতৃত্বের প্রতি তার কোনও লােভ নেই কত সহজে এ ত্যাগ তিনি স্বীকার করতে পারলেন! আর সম্পাদক হন। মাহমুদুল হক খান ওসমানি। সংক্ষেপে ন্যাপ, বামপন্থিরা সকলেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপে যােগ দিল। সম্মেলন শেষে পরদিন ভাসানী পল্টনে জনসভা আহ্বান করেন। কিন্তু পটকাঘাতে সেই জনসভা পণ্ড হয়ে যায়।
বলা হয়ে থাকে মওলানার রাজনীতির নীতির কোনও স্থিরতা নেই। এটা সর্বাংশে সত্য নয়। তিনি আসামের নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, বাংলাদেশে এসে দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। কোনও স্বার্থ বা পদের জন্য তিনি লালায়িত। ছিলেন না। মানুষের ভেতর গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং দাবি আদায়ের সংগ্রামকে বীর্যবান। করার দিকে নিজের সমস্ত ধ্যান-ধারণাকে নিযুক্ত রেখেছিলেন। মাদ্রাসায় পড়য়া অন্য মােল্লা মৌলভির চাইতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। অথচ তার বক্তৃতার ভাষা ছিল ওয়াজ নসিয়তের মতাে, মুসলমান বাঙালিদের শিক্ষা-দীক্ষা মূলত মাদ্রাসা পর্যন্ত, হেফজ করা কেতাব কোরআন চষে জীবনের সুন্দর কিছু তাে তারা লাভ করে না। চৌদ্দশ বছর আগের জগতে থাকতে ভালােবাসে। ওয়াজ-নসিয়ত করে অন্যের অনুগ্রহে ভরণ-পােষণ নির্বাহ করে থাকে। কূপমণ্ডুকতার আঁধার এবং সেই স্বল্পজ্ঞান নিয়ে কেউ আধুনিক জীবনধারা কিংবা বাস্তবতা বােধের সমস্যা সগ্রামে প্রবেশ করতে সাধারণত পারে না। দৈনিক পাঁচ বার ধর্মীয় বন্ধন থেকে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিচরণ যেমন কষ্টকর, রাজনীতির সূক্ষ্ম আচার-বুদ্ধি বিবেচনা অর্থাৎ রাজার মতাে আচরণীয় কূটকৌশল-ক্ষমতা জ্ঞান সকলে আয়ত্ত করতে পারে না, বিশেষত মাদ্রাসা ফেরৎ কেউ পরবর্তী কালে যারা ধর্মীয় আচার পসরা করে রাজনীতি করে তাদের স্বার্থবুদ্ধি আলাদা, দেশ ও গণমানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ তাদের উপলব্ধিতে থাকে না। মওলানা ভাসানী যে যুগের মানুষ এবং তিনি যে ধরনের সহজ সরল ভাবের মাওলানা তখন তার পক্ষে বামপন্থি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কথা নয়। তিনি এসেছেন সমাজ বাস্তবতার ভেতর থেকে, অভিজ্ঞতার সােপান পেরিয়ে, সুবিধাবাদী রাজনীতির মুখােশ উন্মোচন করতে । বুঝতে পারলেন যারা সত্যিকারে দরিদ্র জনগােষ্ঠীর মান উন্নয়নে আন্তরিক, তিনি হৃদয়ের উদারতা থেকে সে দিকেই মােড় নিলেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী ও তাঁর সৃষ্ট ন্যাপের ভেতরেও অচিরে অস্থিরতা দেখা দিল। ওলানার সাধ্যে আন্দোলন উত্তেজনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়া যতটা সহজ সিদ্ধ হয়। তান তার নিয়ন্ত্রণ কিংবা তার পক্ষে সে আন্দোলনকে নেতৃত্বে বাগিয়ে রাখা দুনিরীক্ষ্য হয়ে
সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ