বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৩শে এপ্রিল, বুধবার, ১০ই বৈশাখ, ১৩৮১
ভেজালের বিরুদ্ধে কিছু একটা করুন
বেঁচে থাকার শর্তে খাদ্য গ্রহণ করতে হয় এবং আমরা তাই করি। আর দেহভারস্ত যন্ত্রগুলি খাদ্যের জ্বালানি না পেলে কাজ করতে পারেনা বলেই যে করে হোক দুটো অন্যের জোগাড় করে তাই আমরা দেহকে সচল ও কর্মক্ষম রাখতে চেষ্টা করি। এখানেই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, উদ্বৃত্ত শক্তি ও দেহের ক্রমবিকাশ সাধন করে থাকে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন নিত্য নিয়ত খাদ্যের নামে আমরা চা খাচ্ছি তা কি খাদ্য, অখাদ্য না কুখাদ্য?
আমরা জানি দেশ আজ ভেজাল দ্রব্যে ছেয়ে গেছে। খাদ্যে ভেজাল, প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল, সর্বত্রই ভেজাল। কোন ক্ষেত্রের ভেজালেই উপক্ষেণীয় নয়। তবে খাদ্যদ্রব্যের ভেজালটা জাতীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক। এই ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করে আজ আমাদের দেশে শিশু, বৃদ্ধ, যুবা নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা অবস্থাদৃষ্টে মন্তব্য করেন যে ‘আল্লাহ জানেন এখন আমরা কি খাচ্ছি’।
বিভিন্ন সময়ে পত্রিকান্তরে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের নানা দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। এমন সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে যে, ভোজ্য তেল বা আটায় ভেজাল মিশ্রিত হওয়ায় একই পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছে। আর শিশু খাদ্যে ভেজালের খবর তো হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে এবং সংবাদেও আমরা পড়ছি। বন্ধ টিনের মধ্যে দুধের বিকল্প ভেজাল দ্রব্য থাকে ইত্যাদিও সত্য ঘটনা। ঘি এর নামে যে তৈলাক্ত পদার্থটি অত্যন্ত চড়াদামে বিক্রি করা হয়-তা যে কর্তৃপক্ষের কোন ধরনের খাদ্য দ্রব্য বা কতটা খাদ্যপ্রাণে তা সমৃদ্ধ তা বোধকরি এখন কেউ বলতে পারবেন না।
এরই প্রেক্ষিতে দেখা যায়-তবু আমরা সবই খাই। কারণ কাজ করতে হবে এবং বাঁচতে হবে। খাদ্য পুষ্টির কথা নিয়ে বা খাঁটি খাদ্যদ্রব্য পাওয়ার চিন্তা করা এখন প্রায় ধৃষ্টার সামিল। দুর্নীতির বাজারে নীতির অস্তিত্ব যেমন অশোভন, অখাদ্য ও ভেজাল মিশ্রিত কুখাদ্য তথা ভেজালের বাজারে আসল খাদ্য বা বস্তুর প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাচীন পন্থীরা বলতেন-জাতীয় স্বাস্থ্য গৃহিণীদের পাকশালে। কথাটা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন পাক সালে যে খাদ্য প্রস্তুত হয় তাদের মূল খাদ্য নয় তার কি উপায়?
স্বাধীনতা-উত্তরকালে অস্থিতিস্থাপক অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য মূলত সব জিনিসের দাম বেড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাধ্য হয়ে খাদ্য তালিকা থেকে অনেক তৃপ্তিদায়ক এখন বাদ দিতে হয়েছে। শুধু জীবনধারণের জন্য যেটুকু না খেলে নয় তাই জোটাতে প্রাণান্ত। সেখানে ওই প্রাণ রক্ষাকারী খাদ্য পুষ্টি বা গুন না থাকে তাহলে অবশ্যই জীবন বিপন্ন হবে। আমরা জানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনস্বাস্থ্যের খাতিরে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া একটা মারাত্মক অপরাধ বলে স্বীকৃত। কারণ এক প্রকার গণ হত্যার সামিল। অর্থাৎ এটুকুই যে, অস্ত্র দিয়ে হত্যা করার রুদ্র তান্ডব এতে থাকে না কিন্তু সুপরিকল্পিত উপায়ে জনসাস্থ তথা তাদের দেহের ওপর ধীর প্রক্রিয়ায় বিষ অনুপ্রবিষ্ট করানো হয় যার অবধারিত পরিণতি সেই অকাল মৃত্যু।
ভেজালের ব্যাপারে সরকারের ‘স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউট’ খাদ্য সহ বিভিন্ন সামগ্রিক মান নির্ণয় করেন এবং সরকারের টেস্টিং ল্যাবরেটরি নির্ণিত মান পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দিলে খাদ্য সামগ্রী সহ বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু সার্টিফিকেট দেওয়ার পর নির্ধারিত মান অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে কিনা তা অনুসন্ধান করার কোন ব্যবস্থা নেই। স্বভাবতঃ প্রশ্ন জাগে তাহলে এই প্রহসনের কি প্রয়োজন? আবার যদিও বা কখনও ভেজালকারী হাতেনাতে ধরা পড়ে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়না। হয়তো বা সামান্য জরিমানা করা হয়। যারা ভেজালের বদৌলতে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে সামান্য পরিমাণে তাদের কিছুই যায় আসেনা। বরং তারা আরও শক্তিশালী হয় লৌহ প্রাপ্ত শাস্তির প্রহসন দর্শনে। লাভের অঙ্ক থেকে শাস্তির দণ্ডটা অতি সহজে ছেঁটে ফেলে দিয়ে তারা আবার মেরুদন্ড সোজা করে। এই সুবেশধারী জনস্বাস্থ্য হস্তারা অবাধে সমাজে চলাফেরা করে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায়-ভেজাল প্রতিরোধের জন্য বর্তমান চালু ব্যবস্থা। মূলতঃ পৌর এলাকা গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ মাঝে মাঝে তাদের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত অফিসারের আকস্মিকভাবে দু’চারটে ভেজাল সম্পর্কে ধরেন তারপর তার পরীক্ষাগারে পাঠান রিপোর্টের জন্য। বলাবাহুল্য রিপোর্ট আসতে আসতে ভেজালকারী হাওয়া। অর্থাৎ ভেজাল ধরে লাভ নেই।
এরই প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হল-ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে এবং ভেজাল ধরে তার শাস্তি বিধানের পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হবে। শুধু পৌরসভার এলাকায় নয় ভেজাল বিরোধী অভিযান এর এলাকা প্রসারিত করতে হবে এবং ‘স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউট ও টেস্টিং ল্যাবরেটরি’ কে সার্টিফিকেট প্রদান করলে চলবেনা অহরহ উৎপাদিত দ্রব্য পরীক্ষার তৎপরতা রাখতে হবে। ভেজাল বিরোধী অভিযানের গুরুত্ব বর্ধিত করে সে সম্পর্কিত অফিসার ইত্যাদির সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন। যদিও ভেজাল প্রতিরোধ দূরূহ কাজ তবু অসাধ্য নয়। সুস্থ চেতনা ও কর্ম প্রবণতা থাকলে সংশ্লিষ্ট মহল অনেক দূর অগ্রসর হতে পারেন। তার দৃষ্টান্তই এখন আমরা দেখতে চাই।
অপচয় রোধের ব্যবস্থা চাই
একথা অবিশ্যি ঠিক যে, প্রত্যেক জিনিসের ব্যবহার প্রক্রিয়ায় কিংবা উপভোগ প্রক্রিয়ায় কিছু না কিছু পরিমাণ আপনাকে স্বীকার করতেই হয় তা না হলে যথোপযুক্তভাবে জিনিসকে ব্যবহার বা উপভোগ করা চলে না।
যেমন, যে কোন কাঁচামালকে ফিনিশড প্রডাক্ট তৈরি করতে কিংবা ফিনিশড প্রডাক্টকে প্রকৃত ব্যবহারকারী ব্যবহারে আনতে সব জিনিসের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ওয়েসটেজ বা অপচয় থাকেই। এই অপচয়ের কমবেশি নির্ভর করে ওই বিশেষ বস্তুটির নির্মাণ প্রক্রিয়া ব্যবহার প্রক্রিয়ার জটিলতা বা আরো কিছু আনুষঙ্গিক অবস্থা ইত্যাদির ওপর। এবং অপচয়কে অপচয় না বলে ব্যবহার সৃষ্টির একটি অঙ্গ হিসেবে ধরা যায়।
কিন্তু যখন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয় কিংবা সৃষ্টির চেয়ে ধ্বংসই বেশি হয়, তখন তাকে কিভাবে সৃষ্টির একটি অঙ্গ হিসেবে মনে করা যায়? এ ক্ষেত্রে অপচয়কে অপচয় বলতেই হবে।
একটু লক্ষ্য করে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে মুখে দেশ গড়ার শপথ এর বুলি আওড়ে আমরা প্রায় অধিকাংশ মানুষই বলতে গেলে আদা নুন খেয়েই দেশের সম্পদ অপচয়ের এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় নেমেছি। এ অপচয় শুধু যে সবাই ইচ্ছে করেই করছি তাও নয়। অনেক সময় আমাদের অবহেলা, আলিস্যি, খামখেয়ালী, অদূরদর্শিতা, অনভিজ্ঞতা জনপ্রিয়তা, দুর্নীতি ভুলনীতি ও আরও হাজার কারনে হচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু কিংবা কোনো না কোনোভাবে একটা-না-একটা সম্পদ অপচয়ে ব্যস্ত আছি। অথচ এসব কিছুর মোট পরিমাণ সমগ্র জাতির মাথায় এসে কি বিরাট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে তা আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। হয়তো বুঝতে চাচ্ছি না। প্রত্যেক অপচয় প্রতিরোধের পেছনে আমরা শুধুমাত্র ‘আহ উহ’ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি।
তাইতো প্রায় রোজই খবরের কাগজের পাতা ভরে আমাদের চোখের সামনে কিছু না কিছু দৈত্যাকার অপচয়ের মোটা মোটা অক্ষরের সংবাদ আসে।
গতকালই একটি সহযোগী দৈনিকের ভেতরের পৃষ্ঠায় বলতে গেলে অনেকটা অপাংক্তেয়
ভাবেই একটা প্রতিবেদন বেরিয়েছে যার শীর্ষনাম “ওয়াগণের অভাবে তিন লক্ষাদিক মণ পাট পচিতেছে।”
বিস্তারিত খবরে বলা হয়েছে যে, ডোমার, দেবিগঞ্জ এবং চিলাহাটিতে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন, ট্রেডিং কর্পোরেশন এবং পাঠ মূল্য স্তিতিকরণ কর্পোরেশনের প্রায় তিন লক্ষ মণের ওপর পাট ওয়াগণের অভাবে ‘ডেসপাচ’ হতে পারছে না। অথচ, যেখানে পাট গুলি রাখা আছে সেখানে আগুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। তাই সর্ব নিকটস্থ অঞ্চল থেকে যদি দমকল আনতে হয়, তবুও নাকি লক্ষ লক্ষ টাকার পাট পুড়ে যাবে।
সংবাদটি খুবই ছোট তবে একটু খেয়াল করলেই বুঝা যাবে এর পরিণাম কত গুরুত্বপূর্ণ। পাট আমাদের দেশের একমাত্র শস্য যা আদুরের নাম ‘সোনালী আঁশ’ এবং যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার এক সিংহভাগ অর্জন করে। আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে অহরহই পুড়ছে আজ দীর্ঘদিন ধরেই এবং সেইসঙ্গে পুড়ছে বাঙালির সুখের কপালও।
আরো সংবাদ আছে গত শনিবার চট্টগ্রামে সুলতানিয়া পাটকলে প্রায় ১৩ লাখ টাকার পাট পুড়েছে।
এই সেদিনও কাগজে বেরিয়েছিল যে চালায় একটি বিদেশি জাহাজ পচা পাট শিপমেন্ট নিতে অস্বীকার করেছে।
সত্যিই তো, পচা জিনিস কেইবা নিতে চায়? তবে কথা হচ্ছে পাট পচলো কেন? কিংবা পচা পাট বিদেশিদের দেয়াইবা হোল কেন? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অবহেলা ও অযত্নে দরুন আমাদের এই সোনালী আঁশ পচতে পেরেছে এবং বিদেশে আমাদের সুনাম ব্যাহত করার জন্য এসব পাট বিদেশগামী জাহাজে বোঝাই করা হয়েছে। কারা এসব করছে করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তবে, সবচেয়ে যেটা বেশী প্রয়োজন তা হচ্ছে এই অহেতুক অপচয় রোধের একটা স্থায়ী বাস্তব ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে শুধু মুখে আস্ফালনে দেশের প্রকৃত উন্নতি হবেনা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক