শেখ মুজিবের উত্থান-পতন এনায়েতউল্লা খান
শেখ মুজিবের অকাল পতন আমাকে অবাক করেছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তাে বা আপাত বিস্ময়ে চমকিত হয়েছি। বৈরিতা সত্ত্বেও বেদনার অঙ্কুরে বিদ্ধ হয়েছিল, দূরদূর ভবিষ্যৎ চিন্তায় অকারণে উদ্বেলিত হয়েছি। কিন্তু এ সবই নিছক রাজনৈতিক ভাবনা, মধ্যবিত্ত মানসের স্বভাবগত প্রক্রিয়া। এই মুহূর্তের বিমূঢ়তা পরক্ষণে স্বস্তির আশ্বাসে উচ্চকিত হয়েছে; কালান্তরের ঘন্টাধ্বনি শৃঙ্খলিত চেতনাকে উজ্জীবিত করেছে। কথাগুলাে অপ্রিয় এবং প্রকারান্তরে নিষ্ঠুর,। কিন্তু নিদারুণ সত্যও বটে। যেমন সত্য নিয়তির অমােঘ বিধান কিংবা ইতিহাসের নির্মম বিচার। এ দুই এর তফাৎ মৌল। প্রথমটি সংস্কার, দ্বিতীয়টি বিজ্ঞান। কেউ বলে ভবিতব্য কেউ বলে ডায়ালেকটিস। কিন্তু উভয়েরই পরিণাম অবশ্যম্ভাবিতায়। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তার অধিষ্ঠান এবং পরিশেষে ‘স্বর্গ হতে বিদায়এই অবশ্যম্ভাবিতারই বিয়ােগান্ত আলেখ্য। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একদিকে নাটকীয়তায় চমকপ্রদ অন্যদিকে দ্বৈততায় খণ্ডিত। তার ক্ষমতারােহণের অভিযাত্রা বিগত এক দশকে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল। অগণিত আত্মদান এবং এক ঝুড়ি রূপকথা মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল তার স্বর্গের সিঁড়ি। ব্যক্তিত্বের অপরিমিত শৌর্য ও অনুকূল ইতিহাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর রাজকাহিনী। তিনি ছিলেন রূপকের রাজা। সত্যিকারের মুকুটের ভার তাই তিনি বইতে পারেননি বরং মুকুটের ভারে তিনি ন্যুজ হয়েছেন। রক্ত করবীর’ আত্মবিমােহিত রাজার মতাে দুঃশাসনের অচলায়তন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। যারা প্রাণ দিল, ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে পদাঘাত করে নির্দ্বিধায় অস্ত্র তুলে নিল, যারা দেশপ্রেমের সুমহান অঙ্গীকারের রক্ত দিয়ে মাতৃভূমির ঋণ শােধ করলাে তাদেরই রক্ত-মাংস হাড়ের বিনিময়ে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন এক অলৌকিক ক্ষমতার দেউল। সেখানে দেবতা একক, কিন্তু পূজারী নেই। মানুষকে বাদ দিয়ে শুরু হলাে বিগ্রহের রাজনীতি পুতুলের খেলা। পরদেশী পটুয়ার হাতে সৃষ্টি হলাে পুতুলের রাজা শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা এ কথা নিষ্করুণ জানি, কিন্তু ইতিহাস আরাে বেশি নির্মম এবং তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ ১৫ই আগস্ট। হঠাৎ দ্রিম দ্রিম শব্দে বিদীর্ণ হলাে নিস্তব্ধ প্রভাত। এক ঝাক আগ্নেয় শীসের লক্ষ কোটি মানুষের সীমাহীন রােষের আকস্মিক বিস্ফোরণের মতাে নিপাত করলাে পুতুলের রাজত্ব। এই পুতুল নাচের ইতিকথা রাজনীতি বা ইতিহাস বিযুক্ত নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গােত্রীয় ক্ষমতার অভিলাষ এবং সাম্রাজ্যবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার ইতিবৃত্ত। সে এক বিচিত্র কাহিনী। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন একাত্তরে চরমতম জাতিগত নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখনও পর্দার আড়ালে চলছিল আপােষের জুয়াখেলা। উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের ও একাত্তরের গণপ্রতিরােধকে নিবৃত্ত করবার জন্য শুরু হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। কিন্তু ইতিহাস স্থবির নয় যে, জাতকের ইচ্ছের উপর তার গতিধারা নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই জাতীয় মুক্তির বিভ্রম সৃষ্টির হীন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও স্ফুর্ত হয়েছিল গণবিদ্রোহ। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ সেই আত্মদান বাংলার মানুষের ব্যক্তির নয়। দলমত নির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর দেশপ্রেমিকদের, গােষ্ঠীর নয়। পক্ষান্তরে সেই ব্যক্তি কিংবা গােষ্ঠীর ক্ষমতার রাজনীতি যুপকাঠে লক্ষ আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে বলি দিয়েছে, পলাতক রাজনীতির প্রচ্ছায়ায় গণবিপ্লব ও প্রতিরােধকে ঠেকাতে চেয়েছে। সেবারও চট্টগ্রামের অবরােধ, জয়দেবপুরের সেনা বিদ্রোহ, পাবনার বৈপ্লবিক। সমাবেশ, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ঐতিহাসিক প্রতিরােধ, তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ভবনের গােপন আলাপনীকে নস্যাৎ করে গণ-বিদ্রোহের প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আপােষকারী নেতৃত্ব জনগণের বীরােচিত রক্তদানকে অস্বীকার করে গােল টেবিলে দেশ বিভাজনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান পঁচিশে মার্চ সন্ধ্যায়ও তাই মনস্থির করতে পারেননি। তাঁর শেষ আহবান ছিল সাতাশে মার্চের হরতাল, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়, সেই সংকটকালেও এগিয়ে এসেছিল সামরিক বাহিনী এবং বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ ও যুবকদের দল। তবুও সেই যুদ্ধ গণযুদ্ধে। রূপায়িত হতে পারেনি। কেননা বৈদেশিক চক্র এই সংগ্রামকে নিজ খাতে প্রবাহিত করবার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। মুক্তি বাহিনীর প্রতি চরম অবিশ্বাস হেতু সৃষ্টি হলাে তথাকথিত মুজিব বাহিনী। জনযুদ্ধ অভিযাত্রাকে রুখবার জন্য হলাে সামরিক হস্তক্ষেপ। এই চক্রান্তের ইতিহাস সুদীর্ঘ। যখন মুক্তি বাহিনী বীর সেনানীরা, গেরিলা বাহিনীর তরুণেরা এবং দেশের অভ্যন্তরের বিপ্লবী যােদ্ধারা জন-যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে জাতীয় মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছবার জন্যে যুদ্ধ করছিল তখনই মুজিবনগরের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এই চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠে। এই চক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ন্ত্রিত করবার চক্রান্ত, পরাভূত নেতৃত্বকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করবার চক্রান্ত। যারাই তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাদেরই কপালে জুটেছে অপপ্রচারণা ও রাজনৈতিক নিগ্রহ। পরলােকগত দুর্গা প্রসাদধর (ডি. পি. ধর) অংগুলী হেলনে পরিচালিত মুজিবনগর সরকারের বশংবদ নেতৃত্ব ও প্রশাসন এবং সম্প্রসারণবাদের সৃষ্ট মুজিব বাহিনীর প্রতিবিপ্লবী কার্যক্রম একাত্তরের সংগ্রামের সবচাইতে মসীলিপ্ত অধ্যায়। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেবে জাতীয় মুক্তির প্রত্যাশী এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরােধী লক্ষ কোটি দেশপ্রেমিক জনগণ। এরই ফলে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও আকাক্ষিত জাতীয় মুক্তির পরিবর্তে দেশবাসী পেল এক পুতুল সরকার এবং সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে পুতুল নাচের ইতিকথা। শেখ মুজিবুর রহমান এই ইতিকথার নেপথ্য নায়ক। আগরতলার কুখ্যাত ষড়যন্ত্রের মামলা এবং একাত্তরে মুজিববাহিনীর অভ্যুদয় কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের পর্যায়ক্রমিক ঘটনাপঞ্জী। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং সম্প্রসারণবাদ বিরােধী সংগ্রামের সঙ্গে এর মৌলিক তফাৎ রয়েছে। প্রথমটি বাঙালি বুর্জোয়ার সব চাইতে ঘৃণ্য ও মেরুদণ্ডবিহীন অংশের ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি বাঙালি জাতীয় বুর্জোয়ার অংশসহ সকল শ্রেণীর মানুষের জাতীয় ও অর্থনৈতিক মুক্তির চূড়ান্ত সংগ্রাম। আমার বেদনাবােধ হয় এই জন্য যে, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সমগ্র দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও তার সংকীর্ণ শ্রেণী-চেতনা বিদেশি প্রভুর দায়বদ্ধ রাজনীতির শৃংখল মােচন করতে পারেনি। বরং পুতুলের মতাে হয়তবা অনিচ্ছুক। পুতুলের মতাে প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে তার দ্বৈত ভূমিকা পালন করে গেছেন।
তিনি ছিলেন দক্ষ নট। অভিনয়ের চাতুর্যে প্রতিটি নাটকীয় মুহূর্তে দর্শকবৃন্দের। তুমুল করতালি কুড়িয়েছেন, বাগ্মিতার সম্মােহন ও বিভ্রমের মায়াজাল রচনা করেছেন। জাতীয় স্বাধীনতার মহানায়কের শিরােপা পরিধান করেছেন। কিন্তু বারবার ষড়যন্ত্রের ঋণ শুধতে গিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সেখানেই তার ট্রাজেডি।
শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেও এ কাহিনিতে ছেদ পড়েনি। সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট প্রতিবিপ্লবী মুজিব বাহিনী একাত্তর সালে তার পক্ষ হয়ে প্রতিনায়কের ভূমিকা পালন করেছে, এই বিকল্প বাহিনীর সেই ষড়যন্ত্রী রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার মুজিববাদের তথাকথিত ভাবদর্শন, তত্ত্ব, ভাষা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস নির্লজ্জ বিকৃতি এই একই পরিকল্পনার অংশ বিশেষ।
মুজিববাদ ও মুজিব বাহিনীর কাহিনি আজো ইতিহাসে অনুল্লিখিত। এই প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব ও সংগঠন শুধুমাত্র ব্যক্তি শাসন কায়েম করবার জন্যই সৃষ্টি করা হয়নি, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট সম্প্রসারণবাদী আধিপত্যকে নিরংকুশ করবার জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের রক্ষীবাহিনী। মুজিববাদ ও মুজিব বাহিনীরই সাংগঠনিক রূপ।
মুজিববাদ ও মুজিব বাহিনীর সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ছিল ত্রিবিধ (ক)
মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি ও আধিপত্যকে খর্ব করা, (খ) গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট দেশপ্রেমিক বিপ্লবী সামাজিক শক্তির মােকাবেলা করা এবং (গ) প্রয়ােজনবােধে শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। প্রথম দুটো কারণের জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর তীব্র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল এবং তৃতীয় কারণের জন্য সম্প্রসারণবাদের বশংবদ মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সঙ্গেও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল।
একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত ‘এলিট ফোর্স’ সৃষ্টির ইতিহাস আরও বিচিত্র। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের স্বহস্তে লিখিত পত্রের উপর ভিত্তি করে এবং তাঁরই নির্বাচিত উত্তরাধিকারীদের (?) নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক বাহিনী গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, দেরাদুনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই বিশেষ প্রতিবিপ্লবী সংগঠন জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী, এমনকি তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারেরও নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল না। জনৈক ভারতীয় সেনাপতির প্রত্যক্ষ পরিচালনায় সাংগঠিত তথ্যকথিত মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক কাঠামাে এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এ কথাই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে এই বাহিনীর মৌলিক বিরােধ ছিল। বিরােধের সম্ভাব্য কারণ আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
যদি শেখ মুজিবুর রহমানের পত্রের কথা সত্যি হয়ে থাকে তবে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ উদ্দেশ্যের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর গভীর যােগসূত্র রয়েছে। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, শেখ মুজিবুর রহমানের পর্দান্তরালের ভূমিকা পূর্ব নির্ধারিত ছিল। মঞ্চ-সফল নায়কের মতাে তিনি নেপথ্যের কুশলী পরিচালকের ইংগিত প্রতি পদে পালন করে গেছেন। তিনি ছিলেন ভাগ্যের বরপুত্র। কিন্তু এচিলিসের গােড়ালীর মতাে তার অজেয় ভাগ্য ১৫ই আগস্ট মুহুর্তের যন্ত্রণায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মুজিবনগর সরকার ও প্রশাসন মুজিব বাহিনী এবং তথাকথিত কাদেরীয়া বাহিনীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের সঙ্গে বাঙালির জাতীয় দ্বন্দ্বের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। এই দ্বন্দ্বের আন্তঃস্বার্থের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ক্ষমতার প্রসাদ প্রাপ্তির লড়াই। একাত্তরের যুদ্ধের অনিশ্চিয়তা, দীর্ঘসূত্রিতার আশংকা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ উপরােক্ত দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তােলে। কিন্তু তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। কেননা সব পুতুলের মাঝে তিনি পুতুলের রাজা। রূপকের মাধ্যমে সৃষ্ট তার ভাবমূর্তি দুচারণার স্পর্শমণিতে উদ্দীপ্ত। তাঁর আত্মদানের রূপকাহিনী এবং সর্বোপরি তাঁর ব্যক্তিতের অপরিমিত শৌর্য ও ঐতিহাসিক নির্বন্ধ জাতীয় স্বাধীনতার বিভ্রম সৃষ্টিতে অনেক বেশি কার্যকর। জনগণের বিমূর্ত ভালােবাসার বর্ণচ্ছটায় আলােকিত ভাবমূর্তি তার শ্রেণী চরিত্রের রঙ্গীন প্রচ্ছদ মাত্র। বাঙ্গালি বুর্জোয়ার নিকৃষ্টতম ও মেরুদণ্ডবিহীন মুৎসুদ্দী শ্রেণীর তিনি ছিলেন। যােগ্যতম, শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি।
পুতুল নাচের ইতিকথার পরের কথা তাই বিচিত্রতর। এই উৎপাদন বিমুখ, লুণ্ঠনপ্রিয়, পরাভূত শ্রেণী স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের উপর নির্ভরশীল হবে। ঐতিহাসিক কারণে এবং উপমহাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে উপরােক্ত শক্তিত্রয়ের সমন্বয় ও দ্বন্দ্ব পৌনঃপুনিকভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মুৎসুদ্দী বুর্জোয়ার আন্তর্জাতিক নির্ভরতার নিক্তিতে প্রভাবিত করেছে। বিগত সাড়ে তিন বছর এই পরানুখতার মূল স্তম্ভ ছিল সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তাদেরই নির্দেশে নির্ণীত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক গণচেতনাকে পায়ে মাড়িয়ে, সার্বভৌমত্বের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে, জাতীয় অর্থনীতি উন্নয়নের স্বার্থকে ধ্বংস করে, সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে এই শক্তিজোটের স্বার্থে অবদমিত করে শুরু হয়েছিল পরিকল্পনার দ্বিতীয় অধ্যায়। এরই শক্তিজোটের স্বার্থে অবদমিত করে শুরু হয়েছিল পরিকল্পনার দ্বিতীয় অধ্যায়। এরই ফলে একদল, একনেতা, একদেশ। এরই পরিণাম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য। এরই অবশেষ লুণ্ঠিত, লাঞ্ছিত, মৃত্যুকীর্ণ বাংলাদেশ।
শেখ মুজিবুর রহমান এই নাটকের নিরুপায় ক্রীড়নক। তার অসহায়তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি, দেখেছি দায়বদ্ধ মানুষের নিষ্ফল ইচ্ছের বিলাপ। এখানেই ছিল তার দ্বৈততা, তিনি ছিলেন কিংবদন্তীর নায়ক। তার রাজনীতির প্রক্রিয়া দ্বিচারণে অতুল্য। কিন্তু ঋণগ্রস্ততার দায় পরিশােধ করতে গিয়ে বারবার চক্রবৃদ্ধি হারে তিনি মূল্যের কড়ি গুণছিলেন। তার প্রাপ্য ছিল শুধুমাত্র ক্ষমতার ময়ূর সিংহাসন।
আমি প্রসঙ্গের দীর্ঘ অবতারণা করেছি শুধুমাত্র এ কথা বলবার জন্য যে, বাংলাদেশের সমাজ বিন্যাস, সামাজিক স্তর এবং ঐতিহাসিক পটভূমির প্রেক্ষিতে ব্যক্তিদৌর্বল্য কিংবা ব্যক্তি-দুঃশাসন, ব্যক্তি ও গােষ্ঠী দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক স্থবিরতা শেখ মুজিবুর রহমানের অকাল পতনের প্রধান কারণ হতে পারে না। কেননা রাজনীতি ও ইতিহাস নিজস্ব গতিবেগে এগিয়ে চলে। সেখানে ব্যক্তি গৌণ, মুখ্য শুধু ঘটনাপ্রবাহের ডায়নামিক্স। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উত্থান এবং পতন এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নিহিত ছিল। তাঁর সম্রাটের স্বপ্ন উপজাতীয় গােষ্ঠী-প্রিয়তা, আকাশচুম্বী অহম এবং আত্মবিমােহন তারই দায়বদ্ধ আত্ম ও শ্ৰেণীসঞ্জাত অপূর্তির আগ্রাসী অভিব্যক্তি। যতই তিনি হাজারাে সুতাের বাঁধনে জড়িয়ে গেছেন ততই বৃদ্ধি পেয়েছে তার বিভ্রম। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পারা নাইয়া।
আমার কারামুক্তির পর ২৯শে জুলাই তার সাথে দেখা হয়েছিল। বিক্ষিপ্ত পদচারণায় অস্থির শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “I am sorry for what happened to you, But my hands were tied.”
তার রাজনীতির দ্বিচারণ সত্ত্বেও আমি তার অসহায়তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। কেননা, আমি জানি পুতুলের রাজনীতি কতাে নিষ্করুণ যে সেখানে। রাজা সাজা যায়, কিন্তু ইচ্ছামতাে রাজ্য শাসন করা যায় না। নিপুণ ক্রীড়া তাকে গরিমা দিয়েছিল, কিন্তু প্রাণ দেয়নি, পােশাক বৈভবে বিভূষিত করেছিল, কিন্তু স্বাধীনতা দেয়নি। একনেতা, একদল ? এই প্যান্টোমাইম প্রদর্শনীর সর্বশেষ পর্ব।
বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের দুঃখী জনগণ এই অবাক প্রদর্শনীর মৌন দর্শক ছিলেন। তাদের নিঃশব্দ আর্তিতে ধ্বনিত হচ্ছিল কতিপয় লুটেরার অট্টরােল। আর তাকে ইন্ধন যুগিয়েছে। একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র যারা সমাজতন্ত্রের ছলে, মৈত্রীর ছদ্মবেশে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের আবডালে। বাংলাদেশকে বৈদেশিক স্বার্থের অবারিত লীলাক্ষেত্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বাঙালি বুর্জোয়ারা নিকৃষ্টতম মেরুদণ্ডবিহীন মুৎসুদ্দীকূল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিকে ধ্বংসকল্পে পরদেশী বাণিজ্যকে পুঁজির সেবাদাসের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। এই ঐক্যজোটের নীল নকশা পরিশেষে একদলীয় শাসন। প্রবর্তনের মাধ্যমে রূপায়িত হয়।
ফলত বাংলাদেশ এক দিকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয়ে আপতিত হয় এবং অন্যদিকে, পূর্ব ভারতের ধ্বংসােনুখ শিল্পকেন্দ্রের প্রায় ঔপনিবেশিক পশ্চাভূমিতে পরিণত হয়। দেশের উৎপাদিকা শক্তিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করবার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীতে বিরল। অষ্টাদশ শতকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের লুটেরা বাণিজ্যিক পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
এই দ্বৈতচক্র কখনাে এককভাবে, কখনাে যুগ্মভাবে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কায়েম করবার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিধারা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় স্বাধীনতাকে বৈদেশিক প্রভুদের স্বার্থে নস্যাৎ করবার জন্য এই চক্র জোট পৌত্তলিকতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। মুজিববাদের ফ্যাসিবাদী দর্শনকে নিপীড়নমূলক পৌত্তলিক রাজনীতির তত্ত্বগত ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আর তার যােগান দিয়েছে দেশপ্রেমিকদের ঐকজোটের অপর দুটো রাজনীতি ও বৈদেশিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক দল।
একনেতা, একদল শেখ মুজিবুর রহমানের একক আত্মচিন্তা নয়। বিগত সাড়ে তিন বছরের দেশপ্রেম বিরহিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলত। আর সে জন্যই তার পতন শুধুমাত্র অবাধ দুর্নীতি, লুণ্ঠন, দুঃশাসন, গােষ্ঠীপ্রিয়তা ও পারিবারিক শাসন প্রতিষ্ঠার কারণজনিত নয়। এর মৌল কারণ পূর্বে উল্লিখিত রাজনীত ও ইতিহাসের মধ্যে নিহিত।
আমি বারবার একই কথায় ফিরে আসছি। কারণ আমার দৃষ্টিতে রাজনীতিই মুখ্য, ব্যক্তি নয়, ইতিহাস প্রধান, ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। শেখ মুজিবুর রহমান জুড়াসের সিংহ নন অথবা দেব বংশােদ্ভব কুলনায়ক নন। তিনি বাংলাদেশের সমাজ বিন্যাস ও পরিমণ্ডলে লালিত একজন নশ্বর মানুষ।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশ্লেষণই অরাজনৈতিক এবং ভ্রমাত্মক বলে আমি মনে করি। তিনি ছিলেন মাধ্যম এবং তারই নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল আসল মুৎসুদ্দী শ্রেণীর অসার রাজত্ব। সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তি সর্বদাই এই ধরনের মেরুদণ্ডহীন শ্রেণীর উপর ভিত্তি করে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করে। আর সে জন্যেই তারা বংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অভিষিক্ত হয়েছিল আলােচ্য ব্যক্তির মাধ্যমে। বাঙ্গালি বুর্জোয়াদের হীনতম অংশ প্রশাসন যন্ত্রে প্রধান ছিল আর ছিল বাঙালি বুরােক্রেসির সবচাইতে দুর্নীতিপরায়ণ ও তাবেদার অংশ এবং অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান ছিল পরদেশী লুটেরা পুঁজির দেশীয় সেবাদাস। একদলীয় শাসন সেই ঘূণ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জোটকে কায়েম করবার জন্যই প্রবর্তন করা হয়েছিল।
এই চক্রজোটের এক বছরের প্রতিভূ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তার ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের ঋণ শােধ করেছিলেন। গণতন্ত্র হরণ, নির্মম নিপীড়ন, কণ্ঠরােধ এবং হত্যা এই প্রক্রিয়ারই। অন্যতম পর্যায়। আজও ৫২ হাজার রাজনৈতিক কর্মী বিপ্লবী ও মুক্তিযােদ্ধা শেখ মুজিব কর্তৃক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় দিন গুণছেন। আর সেই প্রক্রিয়াকে পরমােল্লাসে উস্কানি দিয়েছে কুনিস্ট নামধেয় একদল স্খলিত পরজীবী। কেননা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তিকে নির্মুল না করা পর্যন্ত তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারত না।
শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের দুঃশাসন সহস্র জননীর বুক ভেঙ্গে দিয়েছে, শত শত বীর দেশপ্রেমিকের রক্ত রঞ্জিত হয়েছে, দেশীয় সম্পদ পাচারের নয়া ইতিহাস রচনা করেছে, মনন ও সংস্কৃতিকে হত্যা করেছে এবং সর্বোপরি সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়েছে। অর্থনীতির আর কানাকড়িও অবশিষ্ট নেই। অতএব কালান্তরের এই সন্ধিক্ষণে যদি আমরা সেই রাজনীতিকে পরাস্ত না করতে পারি, শেকল ভাঙ্গার সংগ্রামে অবতীর্ণ না হতে পারি এবং দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও কৃষক শ্রমিকের ঐক্যজোট না গড়তে পারি তবে আবার পুতুলরাজা কায়েম হবে। পুতুল রাজাকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায় তবে আবার পরদেশী পটুয়া নতুন আদলে পুতুল গড়বে। পরিশেষে তবুও বলব শেখ মুজিবুর রহমান আমার চোখে গ্রিক ট্রাজেডীর করুণ চরিত্রশ্ৰেণী চেতনার সংকীর্ণ ঈর্ষার বিদ্বিষ্ট, ভালােবাসায় অকৃত্রিম, কিন্তু দুর্বলতায় আকীর্ণ একজন নশ্বর মানুষ। ক্ষমতার অংগনে তার সদম্ভ পদচারণা কখনাে করুণার সৃষ্টি করেছে। সত্য ভাষণে তিনি জটি করেছেন, প্রতিবাদীকে রােষানলে ভস্ম করতে চেয়েছেন। দেশকে ভালােবাসতে গিয়েও তিনি দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জীবন দিয়ে তাকে সেই মূল্য শশাধ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ অমর হােক, স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হােক।*
______________
*পরিসংখ্যান মতে এটি হলাে একটি ডাহা মিথ্যা অপপ্রচার। যেমন- তথাকথিত আত্রাইযুদ্ধের পূর্বে যেখানে প্রচার করা হয়েছিল হাজার হাজার ক্যাডার মারা গেছেন সম্প্রতি সে যুদ্ধের নায়ক এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন মাত্র কয়েকজন, সে যুদ্ধে (!) প্রাণ দিয়েছেন। হলিডে চক্রের প্রকাশ্য নায়ক এনায়েতুল্লাহ খান বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চৈনিকপন্থী সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় এই নিবন্ধটি প্রকাশ করেন-যা বিতর্কিত, বিভ্রান্তিমূলক মিথ্যাচারে উচ্চকণ্ঠ।
সূত্র: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত