১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সনে
খন্দকার মােশতাকের ভাষণ
“বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম”
আসসালামু আলায়কুম,
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, এক ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকার ও সঠিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দানের পূত দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার উপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতাে অকুতােভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। এরা সবাই একযােগে কাজ করে যাচ্ছেন। ত্রিশ লক্ষ বীর শহীদানের পূতরক্ত এবং দুই লক্ষ মা-বােনের পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী মানুষকে নতুন জীবনের আস্বাদ ও সন্ধান দেবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উচিয়ে দাঁড়াবাে এই ছিল আমাদের লক্ষ্য ও কামনা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বন্ধুদেশের অনেককে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। কিন্তু বিগত দীর্ঘকাল দেশের ভাগ্য উন্নয়নের কোনাে চেষ্টা করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্রের জল। রচনা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র দাবার চাল চালা হয়েছে। এবং দেশবাসীর ভাগ্য উন্নয়নকে উপেক্ষা করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যকে বঞ্চিত করে এক শ্রেণির পৃষ্ঠপােষকদের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করা হয়েছে। কতিপয় ভাগ্যবানের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় জনগণের জীবনে দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান অগ্নিমূল্য অসহনীয় হয়ে পড়ে। দেশের শিল্প বিশেষ করে পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে। অর্থনৈতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌছায়, যেখানে বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষ দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।
একটি বিশেষ শাসনচক্র গড়ে তােলার লােলুপ আকাঙ্ক্ষায় প্রচলিত মূল্যবােধের বিকাশ ও মানুষের অভাব-অভিযোেগ প্রকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়, এই অবস্থায় দেশবাসী একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অব্যক্ত বেদনায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। | দেশের শাসন ব্যবস্থার বিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না। হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সংগে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মােচন করেছেন।
এখন দেশের সকল শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরতম পরিশ্রম করতে হবে। সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মানুষ যাতে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেই জন্য সমাজে মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সর্ব অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ও সম্প্রীতি অটুট রাখতে ইনশাআল্লাহ আমরা সচেষ্ট হবাে। সমাজের প্রতি তার প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে সেই অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। শান্তি ও শৃংখলার সঙ্গে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু রাখতে হবে।
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সমতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবােধ ও প্রত্যেক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও একে অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অব্যাহত থাকবে। সরকার জোট নিরপেক্ষ নীতি সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করতে থাকবেন।
আমাদের সরকার জাতিসংঘ সনদ ও নীতিমালার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণকারী সকল চুক্তি ও দায় সম্পর্কে সরকার মর্যাদাশীল থাকবে। বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ বিরােধী আমাদের নীতি অব্যাহত থাকবে। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ এবং জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযােগিতা ও শরীকানা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযােগিতা দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টাও আমরা অব্যাহত রাখবাে। এখনাে পর্যন্ত যাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়নি সেই দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা ইনশা-আল্লাহ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবাে।
“সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়” এই নীতির রূপরেখার মধ্যে আমরা শান্তি ও প্রগতির পথে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবাে। সরকার বিশেষভাবে উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা নিচ্ছেন। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমূহ, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন এবং বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে এই সরকার ঘনিষ্ঠতর এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। সরকার ইসরাইলের কবল থেকে আরব পুণ্যভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম, ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবে। খােদা হাফেজ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
সূত্র: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত