তদানীন্তন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল
সফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার
পনেরই আগস্টের অভ্যুত্থান সম্পর্কে জিয়াউর রহমান সবই জানতেন
মেজর জেনারেল কে, এম, সফিউল্লাহ বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি এস ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনিই হয়েছিলেন এ দেশের প্রথম সেনাধিনায়ক। ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার সময় তিনি ছিলেন সেনাপতি।
মহিবুল : আপনাকে কেন চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হলাে?
কে, এম, সফিউল্লাহ : তা আমি বলতে পারবাে না। তবে আমাকে যেদিন নাকি জেনারেল ওসমানী দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য ডেকেছিলেন সেদিন আমি বলেছিলাম, “আমি কেন? অন্যরা কোথায়?” তখন তিনি আমাকে বললেন, “অন্যরা কারা?” আমি বললাম, কর্নেল রেজা কোথায়? তিনি বললেন, “কর্নেল রেজা রিজাইন করেছে। তারপর বললাম দত্তর কথা। তিনি বললেন “ডু ইউ থিংক হি ইজ কেপেবল?” এর কোনাে উত্তর না দিয়ে আমি জিয়ার কথা বললাম। তখন উনি রেগে গিয়ে আমাকে বললেন, “ইউ আর আরগুইং। গেট আউট ফ্রম মাই অফিস”। আমি তখন অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে জেনারেল রবের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করি। তখন তিনি আমাকে বললেন, “এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ওসমানী সাহেবের কোনাে সিদ্ধান্ত নয়।” তখন আমি বললাম, তিনিতাে নিজেও থাকতে পারেন। জেনারেল রব বললেন, ৭ই এপ্রিল ওসমানী সাহেব সামরিক বাহিনী ছেড়ে জাতীয় সংসদে যােগ দিচ্ছেন।
মহিবুল : আপনি কতদিন পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন? কে, এম, সফিউল্লাহ : ২৪শে আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত। মহিবুল : আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক নাকি ততটা ভালাে ছিল । ঐ সরকারের নাকি সামরিক বাহিনীর উপর তেমন আস্থা ছিল না, কথাটা কি সত্যি বলে আপনি মনে করেন?
কে, এম, সফিউল্লাহ : আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যক্তিগতভাবে আমার উপর আস্থা ছিল, কিন্তু পুরাে সামরিক বাহিনীর উপর তাদের আস্থা ছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে।
মহিবুল : রক্ষীবাহিনী কেন গঠন করা হয়? কে, এম, সফিউল্লাহ : তা আওয়ামী লীগ সরকারই বলতে পারবেন।।
মহিবুল : রক্ষীবাহিনী গঠন করার আগে আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে কি আপনাদের সঙ্গে কোনাে আলাপ-আলােচনা করেছিলেন?
কে, এম, সফিউল্লাহ : না। তবে গঠন করার পরবর্তীসময় আমাকে বলা হয়েছিল যে, রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে পুলিশ বাহিনীর সহযােগী শক্তি হিসেবে। তাহলে আর আর্ম ফোর্সকে খােলাখুলি ব্যবহারের প্রয়ােজন হবে না। যেখানে পুলিশ দুর্বল সেখানে রক্ষীবাহিনীর সহযােগিতা থাকবে। তবে লােকমুখে আমি শুনেছি যে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হচ্ছে আর্ম ফোর্সের জায়গা পূরণের জন্য, কিন্তু এ সকল কথার কোনাে বাস্তবতা ছিল বলে আমি মনে করি না।
মহিবুল : সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সম্পর্ক কেমন ছিল?।
কে, এম, সফিউল্লাহ : সম্পর্ক ভালাে ছিল না। তার কতকগুলাে কারণ ছিল। তখন গুজব বেরিয়েছিল যে, রক্ষীবাহিনীকে আর্মির জায়গায় বসানাে হবে। নতুন বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনীকে তখন সব কিছুই নতুন জিনিসপত্র দিয়ে সাজানাে হচ্ছিল। এদিকে আর্মি দেখছে তাদের সেই পুরান অবস্থা। এগুলাে দেখে আর্ম ফোর্সের অনেকের মনে আঘাত লাগে এবং এই ব্যাপারগুলােকে কিছু লােক বড় করে তুলে ধরে কাজে লাগানাের চেষ্টা করে। যার ফলে সম্পর্কটা খারাপ রূপ নেয়। তবে এ ব্যাপারে একটা ভুল আমার মনে হয় সরকার করেছিলেন তাহলে রক্ষীবাহিনীকে পাওয়ার অফ এরেস্ট এন্ড সার্স” দেওয়া। এতে সামরিক বাহিনীর অনেকে ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত হন এবং শুধু তাই নয় রক্ষীবাহিনী এই সময় সেনাবাহিনীর অনেক অফিসারকে লাঞ্ছনা পর্যন্ত করে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল রক্ষীবাহিনীর ক্ষমতা সেনাবাহিনীর থেকেও বেশি।
মহিবুল : শেখ মুজিবর রহমান সামরিক বাহিনীর উন্নতির পক্ষে ছিলেন না এ কথা কি সত্য?
কে, এম, সফিউল্লা : হ্যা আমি বলবাে এ কথা সত্য। আমি এক সময় পাঁচ ডিভিশন সেনাবাহিনীর একটি পরিকল্পনা উনার কাছে অনুমােদনের জন্য দিয়েছিলাম, কিন্তু শেখ মুজিব কেন তা গ্রহণ করলেন না তা বলতে পারি না। আমি যখন আমার পরিকল্পনা দেই তখন প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারী রুহুল কুদুস তা গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনের অপেক্ষায় তা থাকে। পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে বললেন, “এই মুহূর্তে এদিকে নয়” আমি যতটুকু জানি যে, আমার এই প্রস্তাবের ঘাের বিরােধীদের মধ্যে একজন ছিলেন জিয়াউর রহমান।
মহিবুল : আপনি বাকশালে যােগদান করেছিলেন?
কে, এম, সফিউল্লাহ : বাকশালে আমাকে যােগদান করার জন্য বলা হয়নি। তবে আমি। আমার নাম খবরের কাগজে দেখি। আমাকে জিজ্ঞাসা না করেই আমার। নাম প্রকাশ করা হয়।
মহিবুল : গাজী গােলাম মােস্তফা ও মেজর ডালিমের সঙ্গে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর উপর মনঃক্ষুন্ন হন। এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?
কে, এম, সফিউল্লাহ : আমি এতটুকু জানি যে মেজর ডালিম তার বউ নিয়ে এক বিয়েতে যায়। সেখানে তার বউকে নাকি অপমান করা হয় এবং তুলে নেওয়ার চেষ্টাও করা হয়। এখানে গাজী গােলাম মােস্তফা ডালিমকে বেশ অপমানও নাকি করেন।
মহিবুল : মেজর ডালিমের সাথে এই ঘটনার পর সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ হিসেবে কি কোনাে কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন?
কে, এম, সফিউল্লাহ : যখন গােলমালের খবর আমি জানতে পারি তখন। ডালিমের পক্ষ হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই এর একটা বিচারের জন্য। বঙ্গবন্ধু আমার উপর রেগে গেলেন। তখন আমি বললাম, “বঙ্গবন্ধু আমি যদি আমার অফিসারদের জন্য না বলি তাহলে কে বলবে? গাজী গােলাম মােস্তফার এই ঘটনা আপনি অনুসন্ধানের মাধ্যমে তদন্ত করে দেখুন। আপনি যদি এই ব্যাপারে সাহায্য চান তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।” যেহেতু ওরা গাজীর বিরুদ্ধে। এবং আমিও তাদের পক্ষে তাই গাজীরই বিরুদ্ধে বলেছি। তাই তিনি খুব খুশি হননি।
তিনি শুধু বললেন, “সফিউল্লাহ আপনি জানেন কি যে, আপনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছেন” (ইংরেজি ভাষায়) আমি বললাম, “আমি জানি স্যার। আমি আমার জন্য কথা বলছি না, আমি কথা বলছি আপনার জন্য স্যার। মানুষ আপনাকে। আসল সত্য বলেনি।” ঐ সময় জিয়া ও সাফায়াত জামিলও ঐখানে ছিলেন।
মহিবুল : তারপর কি হলাে?
কে, এম, সফিউল্লাহ : তারপর আমরা ওখান থেকে কোনাে বিচার না পেয়ে মনঃক্ষুন্ন হয়ে চলে আসি। পরে দেখা গেল সরকার মেজর ডালিমকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করলেন।
মহিবুল : ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের সময় আপনি কি করেছিলেন এবং কোথায় ছিলেন?
কে, এম, সফিউল্লাহ : ১৫ই আগস্টের কথা বলতে গেলে আমাকে আগে দুই একটা কথা বলতে হয়। ১৫ই আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবং উনার অনুষ্ঠানের জন্য যে মঞ্চ হয় সেখানে ১৪ আগস্ট কিছু বিস্ফোরণ ঘটে। এ ব্যাপারে আমার কাছে সাহায্য চাইলে আমি কিছু লােক পাঠাই। ঐ দিন আরেকটা ঘটনা ঘটে। ইন্ডিয়ান আর্মির একটি হেলিকপ্টার (আমাদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল) যা নাকি চিটাগাং ডিভিশনে ছিল সেটা নরমালি সার্ভিসের জন্য কলকাতা যাচ্ছিল। ঐ হেলিকপ্টার যখন যাচ্ছিল তখন নােয়াখালীর উপর কয়েকটা পাখির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়। তাই ঐখানকার লােকদের নিয়েও আমরা ব্যস্ত ছিলাম। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ্ডগােল অন্যদিকে নােয়াখালীতে দুর্ঘটনা। তবে ঐ সময় কখনাে ভাবতে পারিনি যে এমন ধরনের একটা কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু ১৫ই আগস্ট সকাল ৫-৩০ মিনিটের দিকে। আমার ডি, এন, আই, সালাউদ্দিন আমার কাছে এসে বললেন, “স্যার আপনি কি ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারীকে শহরে মুভ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন?” আমি বললাম না। তখন তিনি বললেন, “কিন্তু তারা ইতােমধ্যে রেডিও স্টেশন ও শেখ মুজিবের বাসভবন-এর দিকে অগ্রসর হয়েছে।” আমি বললাম, “স্টপ দেম, শাফায়াত জামিল কোথায়?” তিনি কি ঘরে? এই বলে আমি সাথে সাথে ফোন করি শাফায়াত জামিলকে। কারণ তিনি ছিলেন ঢাকার বিগ্রেড কমান্ডার। তাকে বললাম, “আপনি কি জানেন কি হচ্ছে? তিনি বললেন কি ব্যাপার স্যার?” আমি বললাম, “আর্টিলারী নাকি মুভ করেছে।” তিনি বললেন, “আমি জানি না স্যার?” আমি বললাম, “আপনি যখন জানেন না তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে বন্ধ করুন। ফাস্ট, সেকেন্ড এবং ফোর্থ বেঙ্গলকে যাওয়ার জন্য বলুন।” তারপর আমি বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। উনার টেলিফোন এনগেজ পাই। এই সময় আমি নাভাল চিফ খান ও এয়ার চিফ খন্দকার (বর্তমানে মন্ত্রী) সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। উনারা এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না। বললেন। তারপর জিয়াকে ফোন করি। “আপনি জানেন কি কিছু?” তিনি আমার কথা শুনে বললেন, “তাই নাকি?” আমি উনাকে আমার এখানে আসার জন্য বললাম। এর পরই আমি খালেদ মােশাররফকে ফোন করাতে তিনি বললেন, তিনিও কিছু জানেন না। এই সময় আমি আবার শাফায়েত জামিলকে ফোন করলাম, কিন্তু কোনাে জবাব পাইনি। এমন করতে করতে বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোন লাইন পাই। তিনি আমাকে বললেন, “সফিউল্লাহ, আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে কামালকে মনে হয় মেরেই ফেলেছে। তুমি ফোর্স পাঠাও।” আমি তখন উনাকে শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছি “স্যার ক্যান উই গেট আউট, আই এ্যাম ডুইঙ সামথিং।” বাস তখন শুনতে পেলাম। টেলিফোনে গুলির আওয়াজ। আর এটাই ছিল উনার সঙ্গে আমার শেষ কথা।
মহিবুল : তারপর কি হলাে?
কে, এম, সফিউল্লাহ : পরে আমি রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখি ঘরের ডান দিকে একটি চেয়ারে খন্দকার মােস্তাক আহমদ বসা এবং তার সামনে একটা মাইক্রোফোন। উনার বামপার্শ্বে দাঁড়ানাে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। আমি ঢুকতেই তিনি আমাকে বললেন, “সফিউল্লাহ, কনগ্রাচুলেশন, ইওর টুপ হ্যাজ ডান ওয়ান্ডারফুল যব এ্যান্ড ডু দ্যা রেস্ট।” আমি বললাম হােয়াট রেস্ট। ইন দ্যাট কেইস লিভ ইট টু মি।” তিনি তখন বললেন, “উই সুড নাে ইট বেটার।” এই সময় যখন আমি বের হয়ে আসছিলাম তখন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বললেন, “স্যার উনাকে দিয়ে রেডিওতে একটা ঘােষণা করাতে হবে।” পরে আমরা তিন প্রধান একটি লিখিত ঘােষণা রেডিওতে বলি। পরবর্তীসময় আমার চাকরি সামরিক বাহিনী থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয়।*
______________
* সাক্ষাৎকার প্রয়ােজনীয় অংশই এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাঁচ মিশালীর জন্য সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ
করেছিলেন মহিবুল ইজদানী খান।
সূত্র: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত