You dont have javascript enabled! Please enable it!

অর্থনীতির প্রধান প্রবণতাসমূহ: ১৯৭৪-৭৫

যুগ যুগের ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক শাসন শােষণ ও রাজনৈতিক অযৌক্তিক অদ্ভুত ভৌগলিক পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পত্তন। এদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মকে করেছে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ ও বিভ্রান্ত। বাঙালীর লালিত দীর্ঘ দিনের স্বনির্ভর অর্থনীতির স্বপ্নকে বার বার বিদেশী শক্তিসমূহ করেছে পরাভূত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পূর্বৰ্শত বাঙালী জাতি সমাজ বিকাশের এই ধারাবাহিকতা উপলব্ধি করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলন, সংঘবদ্ধ সংগ্রাম করে চূড়ান্ত পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী শাসকচক্র এদেশের অর্থনীতির অবকাঠামাে ধ্বংস করেই শুধু ক্ষান্ত হয় নাই, এদেশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদসহ মানব সম্পদ ধ্বংস করে দেয় যতে অল্প সময়ের মধ্যে এদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে।
যুদ্ধের ক্ষতি ছাড়াও ১৯৭০ সালে ডিসেম্বর মাসে এক সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাসে উপকূলের বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয় যর পরিমাণ ছিল ১২২০ মিলিয়ন টাকা যা আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩.৮% ভাগ প্রায়। সূত্রঃ
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে ১.২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার মূল্যের সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। সাধারণ হিসাবে এই সম্পদ ছিলেনা ১৯৭৪-৭৫ সালের এদেশের মােট প্রকৃত আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ২৩%। এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা থেকেই বঙ্গবন্ধু সরকারকে স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য কর্মসূচী প্রণয়ন করে কাজ করতে হয়। এদেশের দীর্ঘ দিনের আশা আকাঙ্খকে সামনে রেখে অল্প সময়ের মধ্যেই যাতে এদেশের দুঃখী মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় তার লক্ষ্যে জুলাই ১৯৭২ সালে ১৯৭২-৭৩ সালের বাৎসরিক পরিকল্পনা প্রধান দুইটি উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে প্রণীত হয়য়। (ক) যুদ্ধে ক্ষতিগস্ত সম্পদের পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও (খ) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উৎপাদন ক্ষমতার উন্নয়ণ। উন্নয়নের জন্য ৩১৫৪ মিলিয়ন টাকা এবং পুনর্গঠনের জন্য ১১৬৭ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হয়।
উৎপাদনের ব্যবস্থা ধ্বংসসহ অর্থনৈতিক অবকাঠামাে ধ্বংস হয়। এদেশের দুটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে যায় পাকিস্তানী পরাজিত শক্তি। পাকশী রেলসেতু, ২৯৯টি রেলসেতু, ২৭৪টি রােড সেতুন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৮% রেল ইঞ্জিন যা মােট সংখ্যার ১৪০টি ধ্বংস করে দেয়। ১০% ভাগ রেল লাইন উপড়ানাে ছিলাে। ৬৬টি রােড ফেরী, ৮০% ভাগ ট্রাক যা সংখ্যার ৫০০০টি, ২৫০০টি বাস যা মােট বাস সংখ্যার ৬৪% ধ্বংস করা হয়। আরও ধ্বংস করা হয় ২.৫ মিলিয়ন বাড়ী ঘর যা মােট বাড়ী ঘরের ২৫ ভাগ। প্রায় এককোটি শরণার্থী যুদ্ধে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল এবং ২ কোটি লােক দেশের মধ্যেই বাড়ী ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলাে। এই তিন কোটি ছিন্নমূল জনগণকে পুনর্বাসন করা এক কঠিক ও কঠোর কাজ। বঙ্গবন্ধুর যােগ্য নেতৃত্বে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করার সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া ৭২ সালে খরা ও ৭৪ সালে ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে হয়।
১৯৭৩ সালে তেলের মূল্য বৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতিতে এনে দেয় এক মন্থর অবস্থা এবং ব্যাপক মুদ্রাস্ফীত যার প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য তেল আমদানী উন্নয়নশীল দেশেল মত বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বেশ প্রভাব ফেলে। বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশের জিডিপ প্রায় ১০ % ক্ষতিগ্রস্ত করে
তেল মূল্য বৃদ্ধির জন্য।

দ্রব্য মূল্য পরিস্থিতি:
১৯৭৪ সালে বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করে। যার প্রভাবে উন্নত বিশ্বসহ সকল দেশের দ্রব্যমূল্য অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৫ সালে আর্জেন্টিনায় সকল ভােগ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় ১১ গুন, চিলিতে ২৬ গুন, কোরিয়াতে দ্বিগুন, বৃটেনে দ্বিগুন। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পায় আর্জেন্টিনায় ১০ গুন, চিলিতে ৩০ গুন, কোরিয়াতে দ্বিগুন, বৃটেনে দ্বিগুন। ১৯৭৪ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে বিশ্ববাজারে গমের দাম ১৯৭২ সালের তুলনায় চারশ গুন বৃদ্ধি পায়। থাইল্যান্ড ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চাউল বিক্রয় করতাে ১৩০ ডলার প্রতি টন, তা ১৪৯৭৪ সালে মার্চ মাসে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬০০ ডলার। স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত আমদানীকারক দেশ হিসাবে ১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশেও ভােগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় ১৯৭৪ সালের জুন হইতে ১৯৭৫ সালে জানুয়ারী পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি পায়। জানুয়ারীর পর। থেকে মূল্য হ্রাস পায়। ঢাকায় ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে মােট সিদ্ধ চাউলের প্রতি সের মুল্যে ছিল ৪ টাকা। ইহা অক্টোবরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ টাকা এবং ১৯৭৫ সালে জানুয়ারীতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে ৮ টাকা দাঁড়ায়। তবে ফেব্রুয়ারী, জুন মাসে এই মূল্য কমিয়ে সের প্রতি ৬ টাকায় নামিয়ে আসে। আগস্ট ৭৫৮ এসে দাঁড়ায় ৩.৭৫ পয়সা। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত এই সময়ে ঢাকা শহরে চাউল সহ সকল প্রয়ােজনীয় ভােগ্যপণ্যের দাম ক্রমেই হ্রাসের দিকে দেখা যায়। চাউলের দাম ২৫%, আটা ২৩%, মসুরের ডাল ৭%, গরুর মাংস ১০%, খাবার তেল ২৮%, শুকনাে মরিচ ৮৮%, গরুর দুধ ১১২%, শাড়ী ৫%, লংক্লথ কাপড় ১২%, নারিকেলে তেল ২৩৬%, লবন ৬৮% ভাগ, হ্রাস পায়, চিনির দাম অপরিবর্তিত থাকে। ১২টি পণ্যের গড় মূল্য পর্যালােচনা করলে দেখা যায় গড় মূল্য ৪০% হ্রাস পেয়েছে ৬ মাসে। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনায় দ্রব্যমূল্য হ্রাস প্রবণতা অক্ষুন্ন থাকে।

শ্রমের মজুরী পরিস্থিতি:
১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসের পর থেকেই নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের দাম কমাতে থাকে। সেই দিক থেকে শ্রমের মজুরী জানুয়ারী মাস এর পর থেকে হ্রাসের কোন প্রবণতা লক্ষ করা যায় না বরং ক্রমন্বয়ে বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসের তুলনায় জুন মাসের শ্রমের মজুরীর পর্যালােচনা করলে দেখা যায় ঢাকায় দক্ষ ও অদক্ষ উভয় শ্রমের মজুরীই কৃষি। মৎস্য ও শিল্প উভয়ই ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা অঞ্চলে কষি ক্ষেত্রে নিযুক্ত দক্ষ শ্রমিক মজুরী ব্যয় ১০% অদক্ষ ১৫%। মৎস্য ক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিক দক্ষ ৭৩% অদক্ষ ১০% শিল্প ক্ষেত্রে দক্ষ ১১% অদক্ষ ১০% বৃদ্ধি পায়। শুধু ঢাকা নয়, রাজশাহী অঞ্চলেও কৃষি ক্ষেত্রে দক্ষ শ্রমের মজুরী ৩১% অদক্ষ ৩২% ভাগ বৃদ্ধি পায়।
অর্থনীতির সূত্র অনুসারে মজুরী বৃদ্ধির এই প্রবণতা থেকে প্রতীমান হয় যে, দেশে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্মসংস্থানে সুযােগ সৃষ্টির ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের কৌশল ছিলাে সারা দেশের সুষম উন্নয়ন। তাই দেখা যায়, শুধু ঢাকা নয় দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও শ্রমের চাহিদা ও মজুরী উল্লেখিত সময়ে বৃদ্ধি পায়। যেহেতু ফেব্রুয়ারী থেকে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায় তা হতে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় শুধু চলতি মজুরীই উল্লেখিত সময়ে বৃদ্ধি পায়নি, সাথে সাথে প্রকৃত মজুরীও বৃদ্ধি পেয়েছে।

শিল্পোৎপাদনের প্রবণতাসমূহ:
পাকিস্তান আমলে শিল্পায়নের কৌশল ছিল পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নোয়ন কর্পোরেশন মাধ্যমে সরকারী সহায়তায় শিল্প গড়ে তুলে তা নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এদেশে মৌলিক ও বৃহদাকার শিল্প গড়ে না তুলে শুধু সস্তা কাঁচা ও শ্রম, নির্ভর শিল্প গড়ে তুলে এদেশের সম্পদ পাচারের প্রচেষ্টার কৌশল নির্মিত হয়। বেসরকারী খাতের মােট শিল্পের মােট সম্পদের ৬০% ভাগের মালিকানা ছিল অবাঙ্গালীদের। সরকারের তথা ইপিআইডিসির অধীনস্ত শিল্প কারখানাগুলাের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রিত শিল্প অধিকাংশই ছিলাে অবাঙ্গালীদের হাতে। তাই এদেশে শিল্প বিকাশের সুষ্ঠু ধারা সেই সময় গড়ে ওঠে নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী, অবাঙ্গালী শিল্পপতি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে শিল্পে নিয়ােজিত চলতি মুলধন এদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। একই সাথে স্থায়ী সম্পদ যেমন অনেক মেশিন পত্র অকেজো কিম্বা ধ্বংস করে রেখে যায়। আর তাছাড়া এই সব শিল্পের কারখানায় অবাঙ্গালীদের বেশী চাকুরী দিয়ে রেখেছিলাে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সার্বিক অথেই সঙযুগটে পড়ে এই সব শিল্প কারখানা অচল হয়ে পড়ে। এই অবস্থার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই বিধ্বংস অচল শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারের তত্ত্বাবধানে এর উৎপাদনে প্রক্রিয়া শুধু হয়। ৭৩ সনের তুলনায় চিনি সুতা বস্ত্র এবং ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদির উৎপাদন যে উল্লেখ্যযােগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সনে সেই প্রবণতা বজায় থাকে, গত বছরের তুলনায় উৎপাদন বাড়ে শতকরা ১২ ভাগ। মিলে তৈয়ারী সুতা ও বস্ত্র বৃদ্ধি হয় প্রথম ৯ মাসে ১১ এবং ৩ শতাংশ। এছাড়া কতিপয় দ্রব্যের উৎপাদন উৎসাহজনকভাবে বৃদ্ধি পায়, ইহার মধ্যে আছে নিউজপ্রিন্ট, চা, সাইকেল, বৈদ্যুতিক কেবলস ও তামার তার ইত্যাদি।
সারণী ৩ থেকে প্রাপ্ত ১৯৬৯-৭০ ও ১৯৭৪-৭৫ সালের উৎপাদনের তুলনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাট শিল্পের উৎপাদন স্বাধীনতা পূর্ব অবস্থার ৫৬০ হাজার টন থেকে হ্রাস পেয়ে ৪৪৪ হাজার টন পেঁৗছে। করণ বিশ্ব বাজারে পাটের তৈয়ারী পণ্যের চাহিদা কিছু হ্রাস পাওয়ার জন্য এটা হয়েছে। সুতা উৎপন্ন ১০৬ মিলিয়ন পাউন্ড থেকে কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১০১ মিলিয়ন পাউন্ডে পৌছে। কাপড় ৬০ মিলিয়ন গজ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৬ মিলিয়নে পৌছে। কাগজ ৯১ হাজার টন। থেকে হ্রাস পেয়ে ৭৩ হাজার টনে পৌঁছে। সিমেন্টের উৎপাদন ৫৩ হাজার টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪৩ হাজার টন পৌছে। ইউরিয়া ৯৬ হজার টন থেকে হ্রাস পেয়ে ৬৯ হাজার টনে পৌছে। ইউরিয়া সারের উৎপাদন হ্রাসের কারণ ঘােড়াশাল সার কারখানাটি দুস্কৃতিকারীরা শক্তিশালী বিস্ফোরক দ্বারা ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে, উৎপাদন বন্ধ থাকে। স্টীলের উৎপন্ন, চিনির উৎপন্ন কিছুটা বৃদ্ধি পায়। চা এর উৎপাদন একই পর্যায়ে পৌছে। উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টার সাথে সাথে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিরও পদক্ষেপ নেয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, বিগত ১০ বছরেও কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদন ৬৯ এর পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালােচনা করলে দেখা যায় পাটকলের সংখ্যা ১৯৬৯-৭০ সালে ৫৫ থেকে ১৯৭২-৭৩ সনে ৭৩টিতে উন্নতি হয়। মােট ২১,৪৫৩টি তাঁত থেকে ২৪,১৮৬টি এবং ৩১৭ হাজার থেকে ৩৬৯ হাজার টাকুতে উন্নতী হয়। বস্ত্র শিল্পে ১৯৬৯-৭০ সাল ৪৪টি মিল থেকে ১৯৭৫ সালে ফেব্রুয়ারীতে ৪৭টিতে উন্নীত হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে উৎপাদন পর্যালােচনা করলে দেখা যায় উৎপাদন ক্রমেই বৃদ্ধিই পেয়েছে। কাগজ ৮৮%, ষ্টীল ৫২%, ইউরিয়া সার ৪০০% এমােনিয়া সালফেট ২২০%, কষ্টিক সােডা ৪৯%, ক্লোরিন ৩২%, চা ১১০০%, পানীয় ২২০% ভছাগ বৃদ্ধি পায়। সিমেন্টের উৎপাদন শুধু মাত্র হাস পায়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে শিল্পে নিয়ােজিত শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পায় দ্বিগুন।

কৃষি উৎপাদন ও উন্নয়ন কার্যক্রম
বিগত পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের সময় এদের কৃষি উন্নয়নের বাস্তব সম্মত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্য কৃষি উন্নয়নের গতি ছিলাে খুব মন্থর। তার ফলে এদেশের কৃষিতে এক স্থবিরতা দেখা দেয়। প্রয়ােজনী প্রকৌশল ও কারিগরী ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কৃষি ক্ষেত্রে নিমানের বিনিয়ােগ, উৎপাদনক্ষম উপকরণের অপব্যবহার, কর্মসূচীর নিস্ফল ব্যবস্থা, প্রাকৃ মােকাবেলায় অব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, ভূমিতে মালিকনা ক্ষেত্রে অরাজকতা ইত্যাদি বিরাজ করছিল। সরকারী পর্যায়ে সেচ উন্নয়ণ কর্মসূচী তেমন গুরুত্ব দেয়নি। পঞ্চাশ এর দশকের শেষ ভাগ থেকে দেশব্যাপী খাদ্য সমস্যা দেখা দেয়। বছরের পর বছর এই অবস্থা তীব্র হয়ে উঠে। ১৯৬৯ সনে ঘাটতির পরিমান দাঁড়ায় ২০ লক্ষ টন। একর প্রতি কৃষি উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায়নি। ১৯৫০ ও ১৯৭০ সালের ভারত ও বাংলাদেশেল একর প্রতি ফলনের তুলনা করল দেখা যায় ১৯৫০ সালে ভারতের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের একর প্রতি উৎপাদনের হার বেশী ছিল কিন্তু ১৯৭০ সালে দেখা যায় ভারতের একর প্রতি উৎপাদনের হার পূর্ব পাকিস্তানের থেকে বেশী।
বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এদেশের কৃষি ও কৃষকের সমস্যা সমাধানকল্পে অতি দ্রুত পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং গ্রাম ভিত্তিক কর্মসূচী ঘােষণা করে।
১৯৭৪-৭৫ সালে কৃষি ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্যসমূহের মধ্যে ছিল খাদ্য শস্য উৎপাদন ত্বরান্তিতকরণ এবং পাট উৎপাদন প্রাক স্বাধীনতা পর্যায়ে উন্নীতকরণ। স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য উভয় লক্ষ্যই ছিলাে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বাজেট সংশােধিত করে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়ে দেয়া হয়। ম।
১৯৭৪-৭৫ সনে দেশে খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ১১৭ লক্ষ টন। ১৯৭৩-৭৪ সর্বনাশা বন্যা আউশ ও আমন ফসলের বিপুল ক্ষতি সাধন করে। মে মাসের প্রবল বর্ষণ জলবদ্ধতা সৃষ্টি করে আউশ উৎপাদনকে ব্যাহত করে। গম উৎপন্ন সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পায়, যাহা ১৯৬৯-৭০ সনের উৎপাদন থেকে প্রায় ৪৩ শতাংশ বেশী। পাকিস্তানী শাসনের আওতায় ১৯৬৯-৭০ সালের কৃষি উৎপাদনের মাত্র ছিলাে অনেক উচুতে। সারণী ৬ থেকে দেখা যায়, অনেক প্রতিকূলতার সত্ত্বেও চাউল, গম, ডাল, তৈলবীজ, আলু, আখ ইত্যাদির উৎপাদন ১৯৭৪-৭৫ সালেই ১৯৬৯৭০ সালের পর্যায়ে প্রায় পৌঁছায়। বিশ্ব বাজারে মন্দার জন্য পাটের চাষ কমে যায়। চা এর উৎপাদান অনেক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ, সেচ ব্যবস্থার প্রসারের এক বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়। এই কর্মসূচী বাস্তাবায়নের জন্য ব্যাপকভাবে ভর্তুকির ব্যবস্থা গৃহীত হয়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ণ সংস্থার অধীনে তিন ধরনের সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। (১) শক্তি চালিত পাম্প, (২) গভীর নলকূপ, (৩) অগভীর নলকূপ সেচ প্রকল্প। দেশে এই শক্তি চালিত পাম্প প্রকল্পের দ্রুত উন্নতি হয়। ১৯৬৮-৬৯ সনে যেখানে পাম্পের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সনে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ১৯৭০ সনে ২৬ লক্ষ একর ১৯৭৫ সনে ৩৬ লক্ষ একরে উন্নীত হয়।
সারণী-৭ পর্যালােচনা করলে দেখা যায় কৃষি উপকরণের বিতরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬৯-৭০ সালে তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সালে রাসায়নিক সার ৭৪ ভাগ, পােকার ঔষধ ৪০ ভাগ, উন্নত বীজ ব্যবহার ২৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সারণী-৮ থেকে পরিদৃষ্ট হয় যে একর প্রতি ধানের উৎপাদন ১৯৭৩-৭৪ সালে ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমাগত আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯-৭০ সনে একর প্রতি ধানের উৎপাদন ছিলাে ১২.৬০ মণ। ১৯৭৩-৭৪ সনে একর প্রতি ১৩.০০ মণ। মােট আবাদী জমির পরিমাণ ১৯৬৯-৭০ সনে ২৫৪.৮৪ লক্ষ একর। ৭১-৭২ সনে তা হ্রাস পায়, কিন্তু পরবর্তীতে ক্রমেই বৃদ্ধি পায়।
সারণী- ৯ এ সারের দামের পরিসংখ্যা দেয়া হয়েছে। বিশ্ব বাজারে রাসায়নিক সারের দাম বহুগুনে বৃদ্ধি পেলেও সে অনুসরে বাংলাদেশে সারের দাম বৃদ্ধি পায়নি। ১৯৭২ সালে ইউরিয়া পটাশ, টি এসপি, সারের দাম মণ প্রতি ২০ টাকা, ১৫ টাকা ১০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৫ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫০ টাকা, ৪০ টাকা, ৩০ টাকা কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে এসে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৬০ টাকা, ১৫৪ টাকা, ১২১ টাকা।
বৈদেশিক সাহায্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এদেশের স্বাধীনতার সাথে জনগণের প্রত্যাশা ছিলাে শর্তযুক্ত কোন বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ না করা। দেশে স্বাধীনতাকে বিক্রি করে কোন বিদেশী দেশে কাছে মাথা নত না করা। তাই স্বাধীনতার পর তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীতাকারী দেশসমূহ থেকে কোন সাহায্য নেওয়া হবে না। বিশ্ব পরিস্থিতি ও দেশে প্রয়ােজনীয়তার কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নমনীয় করে বলা হয় শর্তযুক্ত কোন বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করা হবে না এবং এই ধারা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিলাে।

বিদেশী সাহায্যের
প্রবাহ বৎসরের পর ক্রমাগত বৃদ্ধিই পেয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে বিদেশী অনুদান ও ঋণ এসেছে ২৭০.৮০ মিলিয়ন ডলার সেখানে ১৯৮০-৮১ সালে এসেছে ১১৪৬-৪৫ মিলিয়ন ডলার। ১৯৯০-৯১ সালে এসেছে ১৭৩২.৫২ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৩-৭৪ সালে ঋণজনিত দায়দেনা পরিশােধ আমাদের রপ্তানী আয়ের ৪.৭ শতাংশ এবং মােট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৪.২ শতাংশ ব্যয় করতে হয়েছে। ১৯৭৯-৮০ সালের জন্য যথাক্রমে ১৪.৯ ও ৮.৮। শতাংশ ব্যয় করতে হয়েছে। সারণী ১০ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের মােট জাতীয় উৎপাদানের তুলনায় বৈদেশিক দায়-দেনার শতকরা হার ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিলাে ৫.৬ শতাংশ যাহা ১৯৮০-৮১ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৪.১ শতাংশ। দেশকে ক্রামগত বিদেশী করার দিকেই এগিয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী সরকারগুলাে। বাংলাদেশের টাকা মূল্যমান ক্রমান্বয়েই হ্রাস পেয়েছে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!