You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৯ই মে, বৃহস্পতিবার, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৫০

চির নূতনের দিল ডাক

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একশত তেরতম জন্মবার্ষিকী। যার লিখিত বাণী গান হয়ে দেশের মাটিকে বন্দনা জানিয়েছে, রূপসী বাংলার ষড়রিপুর সৌন্দর্য বর্ণনায় অকৃপণ অলংকার প্রয়োগে উচ্ছ্বসিত হয়েছে, এই দিনে তাকেই আমরা স্মরণ করি। স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান–‘আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের কাছে ছিল মন্ত্রের মতো।
বাংলাদেশের ২৫শে বৈশাখ এক বিশেষ মর্যাদায় উদযাপিত হয়। কারণ বাঙালির জাতীয়তাবাদ স্বকীয়তা স্বাধীনতাবাঞ্ছ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে কবিগুরুর নামটি বিশেষ ভাবে সম্পৃক্ত। সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ অবধি আমাদের জাতীয় জীবনের নানা ক্রান্তিলগ্নে কবিগুরুর অমৃত বাণী প্রেরণা জুগিয়ে এসেছে। আমরা জানি, আমাদের জাতীয়তা বোধের উদ্বোধন হয়েছিল সেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই। পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের মুখের ভাষাকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল।
আর ভাষার উপর আঘাত হানার অর্থই ছিল রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র সাহিত্যের উপর আঘাত হানা। কারণ বাংলাভাষাকে শুধু বাঙালির কাছেই নয় -বিশ্বের দরবারে ভাষাকে একটা সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি।
অতঃপর এসেছিল প্রত্যক্ষ অবদমন। রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা নিষিদ্ধ হল। বেতার অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার করা বন্ধ হল, রবীন্দ্রকাব্যের ভাষার বিকল্প শব্দ প্রয়োগের অবমাননাকর প্রচেষ্টাও চলছিল। পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে লেখা বন্ধ হয়েছিল। রবীন্দ্র সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িকতায় চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু জাগ্রত বাঙালিসত্ত্বা সেদিন কোনো অবদমনের সামনেই মাথা নত করেনি। বাঙালিসত্ত্বার কেন্দ্রীভূত আবেগ ও প্রেরণা হিসেবে সেদিন রবীনাথকেই তারা বরণ করেছিল। সরকারি পর্যায়ে রবীন্দ্র বার্ষিকী উপেক্ষিত হলেও বাংলার সাধারন মানুষ যেদিন স্বতস্ফূর্ত উদ্যম নিয়ে তা পালন করে গেছে।
আমাদের সেই সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। বহু সাধনা ও বেদনামথিত সংগ্রামের বিনিময়েই আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হতে পেরেছি। কত গ্রাম বন্দর জন জনপদ হয়েছে নিশ্চিহ্ন, কত ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য হয়েছে ধূলিস্যাৎ, কত আত্মীয়-পরিজন হয়েছে নিঃসঙ্গ, ছিন্নমূল কৃষ্ণচূড়া, পলাশ আর শিমুল এসে মিশেছে বীর শহীদদের শোণিত ধারার স্রোতে। তবু দেশমাতার মুক্তিতে শ্মশানে বসেই সবাই লাল সূর্যটা দীপ্ত-আলো কণায় অবগাহন করেছি। আবার হেসেছি, দেশ গড়ার শপথ নিয়ে।
স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় আড়াই বছর হতে চলল। এরই মধ্যে এই নিয়ে তিনবার ২৫শে বৈশাখ উদযাপন করার অবকাশ ও পেয়েছি। কিন্তু আজ যদি প্রশ্ন রাখি-যে বাণী মূর্তির মহতী প্রেরণা নিয়ে একদা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তরুণ-যুবকরা আন্দোলনের কঠিন পাথরে মাথা কুটেছিল–তাদের আদর্শ আজ কোথায়? দানবের সাথে এসে সংগ্রামের তরে ঘরে ঘরে যে অমৃতের সন্তানরা প্রস্তুত হয়েছিল এবং অবশেষে শান্তির ললিত বাণীকে মানবতার জন্য নিবেদন করার সফলতা দান করেছিল আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি?
যখন দেখি স্বাধীনতা-উত্তরকালের স্বাভাবিক বিশৃঙ্খলাকে মূলধন করে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী নরপশুরা নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের সার্বিক সমস্যাকে জটিলতার নিক্ষেপ করছে তখন সান্তনা পাইনা আমরা। পাপ চক্রের সক্রিয় অংশীদার না হয়েও বিবেকের দংশন এরাতে পারিনা। কারণ কবিগুরু অতন্ত্য স্পষ্টভাবে বলেছেন–‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।’ আত্মরক্ষার স্বার্থপর চেষ্টায় সত্যিই আজ আমরা অধিকাংশ লোকই অন্যায় কে সয়ে গিয়ে পাপীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়েছি। আজ জলমগ্ন ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে ‘প্রতিদিন সূর্যোদয় পানে’ আপনার নতুন অস্তিত্ব সন্ধানের ব্যর্থ চেষ্টা করছি।
যুগে যুগে জাতীয় জীবনে দুর্যোগ আছে একথা ইতিহাসেই বলে। আর জাতীয় জীবনে দুর্যোগ দেখে আনার মূলে যারা থাকে তাদের নির্মম হাতে দমন করা ও হয়ে দাঁড়ায় অত্যাবশ্যকীয়। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার ধর্ম। কার্পা পুনঃবিচারের ক্ষমাহীন ন্যায়দণ্ড বড় নির্মম। সে কথা স্মরণ করে কবি তাই বলেছেন–
‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
তুমি কি বেসেছ ভালো।’
তার বাণীতে সামনে রেখে তাই আজ আমাদেরও শপথ নেওয়া উচিত–যারা এদেশের বায়ুকে দূষিত করছে অসহায় অসংখ্য জীবনের করুণ আর্তি লাল সূর্যটা অকৃপণ আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, লুট, ইত্যাকার কাজে সমাজের আবহাওয়াকে কদর্য করে দিচ্ছে, ভেজাল ও মুনাফার দৌরাত্ম্যে জনজীবন বিপর্যস্ত করে রাখছে–তাদের আমরা ক্ষমা করব না। ন্যায়বিচারের নির্মম দণ্ডস্পর্শে কৃতকর্মের পুরো ফল ভোগ তারা করুক। দেশের স্বার্থে, মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রীয় চার স্তম্ভের প্রতিষ্ঠা স্থাপনার একনিষ্ঠ কর্মপ্রবাহে–দেশের শত্রুদের ক্ষমাহীন বিচার হোক। ২৫ শে বৈশাখের ‘চির নূতনের ডাক’ তবেই সার্থক হবে। এবং তবে সত্য ও সুন্দরের প্রতিভূ হিসেবে জন্মবার্ষিকী উদযাপনও হবে প্রেরণার আকর।
পরিশেষে, কবিগুরুর বাণী স্মরণ করেই বলতে চাই–‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তাই আজ দেশে যত বিশৃংখলা, অরাজকতা ও নৈরাজ্যের উৎপাত হোক না কেন–আমরা বিশ্বাস করি এর মধ্য থেকেই অমৃতের সন্তান বেরিয়ে আসবে এবং সার্থক সোনার বাংলা গড়ে তুলবে। আমরা সেই দিনের স্বপ্ন দেখছি এবং দেখব।

কাগজের মূল্য বৃদ্ধি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি

বই বেরুচ্ছে না। সাময়িকী প্রকাশনাও আপাতত বন্ধ। মুদ্রণ খরচ বেড়ে গেছে আগের চাইতে অনেক বেশি-পাশাপাশি কাগজের দাম। কোন একটা স্তরে গিয়ে তারা থেমে থাকছে না। বাড়ছে তো বাড়ছেই। সরকার বাড়াচ্ছেন কাগজের দাম যত ভাগ, তার সাথে যোগ হয়েছে ব্যবসায়ীদের বর্ধিত মুনাফার পরিমাণ। সব ভার গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের উপর।
কাগজের এই মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রণ খরচের ক্রমবর্ধমান হার শুধু সৃজনশীল সাহিত্য কর্মেই যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তাই নয়, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খরচ এর উপর বাড়তি বোঝা সৃষ্টি করছে। পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ সরকার ২১শে মার্চ থেকে সকল প্রকার কর্ণফুলী কাগজের মূল্য শতকরা ৬৫ ভাগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।। বর্ধিত মূল্য অনুযায়ী বাজারে এখন প্রতি রিম ডবল ক্রাউন ৮১ টাকা ৭৯ পয়সা এবং ডবল ফুলস্কেপ কাগজ ৬০ টাকা ৩৭ পয়সা করে বিক্রি হচ্ছে। সংবাদপত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যে নিউজপ্রিন্ট ব্যবহৃত হয় থাকে তার ও দাম ২ হাজার তিনশত চুয়ান্ন টাকা থেকে তিন হাজার আটশ’ চুয়ান্ন টাকায় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রের ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সংবাদপত্রশিল্প যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট সম্পদ আহরণের কোন পথ সংবাদপত্রের সামনে খোলা নেই। এখন অন্যান্য কাগজের মূল্য যে গতিতে বেড়ে চলেছে তাতে সার্বিকভাবে প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। বর্তমান মূল্য বৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই পাঠ্যপুস্তক এর মূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করবে। এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও অন্যান্য নানাবিধ সমস্যায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেশবাসীর সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষার বন্ধ হবার উপক্রম হবে।
কর্তৃপক্ষ সূত্রে প্রকাশ, ফার্নেস অয়েল, মণ্ড, খুচরা যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলেই কাগজের মূল্য বৃদ্ধি করতে তারা বাধ্য হয়েছেন। তাদের ‘যুক্তিকে’ উড়িয়ে না দিয়েও বলা যায় মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোন উপায় না থাকলে তা অবশ্য করতেই হবে কিন্তু সেই মূল্যবৃদ্ধি জাতীয় শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রকাশনা বন্ধ করে না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে উৎপাদন ব্যাহত পুষিয়ে যায় আবার অতি প্রয়োজনীয় দিকগুলিও অবহেলিত না হয়। একটা ‘সাবসিডাইজড রেটে’ একান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহে রেশনিং এর মাধ্যমে সরবরাহ করা যেতে পারে। এর অপচয় রোধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
সত্যিকার অর্থেই সৃজনশীল সাহিত্য কর্ম, পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কাগজ সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কাগজের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!