বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৩ই নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ২৭শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
জাতির জীবনে অমূল্য পাথেয় বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চতুর্দশ জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন। তিনদিনব্যাপী এ মহাসম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দান করেছেন তা গোটা জাতির ভবিষ্যত পথ নির্দেশক বলে আমরা মনে করি। জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শ ব্যক্ত করেছেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও আগামীদিনের মানুষের জন্যে বঙ্গবন্ধুর এ মতাদর্শ নতুন জাতি গঠনের একমাত্র পাথেয় বলে আমাদের বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এতোকালের বিভিন্ন বক্তৃতামালার মধ্যে ঐতিহাসিক ও সুদূরপ্রসারী মতাদর্শের অন্যতম এ বক্তৃতা। সমাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে যে সুস্পষ্ট মূল্যায়ন ভাষণে রয়েছে গোটা জাতিকে তা অনুধাবন করতে হবে। দেশের প্রগতিশীল কর্মীদের মাঝে বহুদিন ধরে নতুন জাতি গঠনের প্রয়োজনে পরিষ্কার কর্মসূচীর অভাব ছিলো। আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে তা অনেকখানি পূরণ হবে।
বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, একশ্রেণী কৃষক ও শ্রমিক এবং অন্য শ্রেণী মধ্যবিত্ত। দেশের সার্বিক জনশক্তির অধিকাংশই কৃষক ও শ্রমিকরাই দেশের মূল উৎপাদক শক্তি। মেহনতি মানুষের কল্যাণের জন্যে যে নতুন দেশের জন্ম হয়েছে তার মূলকথা হলো কৃষক ও শ্রমিকের কল্যাণ। যাঁরা মধ্যবিত্ত তারা সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাবাদী। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘সাদা কাপড়ে’র মানুষ। এরা উন্নাসিক এবং স্বল্পতে তুষ্ট নয়। বিদেশী শাসক শ্রেণীর কর্তৃত্ব অবসান হওয়ার পর বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনে এদের অধিকাংশের কীর্তিকলাপই বেশী দায়ী। বঙ্গবন্ধু উপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক শোষণের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি অপূর্ব উদাহরণ জাতির সামনে উপস্থাপিত করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন যখন বর্তমান থাকে তখন দেশের মূল জনশক্তি কর্তৃক উৎপাদিত জিনিসের সঠিক মূল্যায়ন হয়না। সেক্ষেত্রে বিদেশী শাসক শ্রেণীর মিল-কারখানা থেকে উৎপাদিত জিনিস বাজারে বেশী মুনাফায় বিক্রি করা হয়। যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণী এভাবে একটি দেশের মূল জনশক্তির উপর জগদ্দলের মতো শোষণের হাতিয়ার চাপিয়ে রাখে। শোষণের পাহাড় যখন আকাশচুম্বী হয় তখনই দেখা দেয় অনিবার্য বিপ্লব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তেমনি ঔপনিবেশিক শোষণের পাহাড় ভেঙে দেশে কৃষক শ্রমিকের রাজত্ব কায়েমের জন্যে অনিবার্য হয়ে পড়ছিলো। স্বভাবতঃই তাই আজ দেশের মেহনতি মানুষের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবার দিন এসেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের দরুণ অতীতেও বাংলাদেশের গণমানুষের উৎপাদিত একমাত্র অর্থকরী ফসল পাটের ন্যায্যমূল্য যেমন দেওয়া হয়নি তেমনি বর্তমানেও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্র পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে নারাজ। অথচ বঙ্গবন্ধুর মৌলিক নীতি যা সেদিনের ভাষণে আট টাকা সের মরিচের দামের প্রশ্নে অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাহলো দেশের মেহনতি কৃষক শ্রমিক কর্তৃক যে ফসল উৎপাদিত হবে তার ন্যায্যমূল্য সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। এবং যারা আসল উৎপাদক অর্থাৎ কৃষক শ্রমিক তারাই তার জিনিসের সঠিক মূল্য পাবে। তাতে কৃষকের উৎপাদিত মরিচ আট টাকা সের হলেও যারা উৎপাদন করেন না তাদের তা ক্রয় করতে হবে। ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে উৎপাদিত যে শিল্পজাত দ্রব্য একদিন কৃষকের উৎপাদিত ফসলের উপর দাঁড়িয়ে শাসন করতো আজ তার অবসান হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শের সুদূরপ্রসারিতা এখানেই। এ প্রসঙ্গে তাই বঙ্গবন্ধু প্রত্যেকটি মানুষকে উৎপাদনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মধ্যবিত্তরা যদি কাজ না করে সুযোগ গ্রহণ করতে চান তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রমিকের বিপ্লবও অনিবার্য হয়ে পড়বে।
বস্তুতঃপক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের জন্যে যত বেশী নিবেদিতপ্রাণ আমরা যথার্থ অর্থে ততটুকু নই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বাস্তবতাকে মর্মে মর্মে অনুধাবন করে অনতিবিলম্বে প্রত্যেকটি প্রগতিশীল কর্মীকে যে নতুন সমাজগঠনের কাজে অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত হয়তো এখনও অনেকে তা করছেন না। অথচ সমাজতন্ত্রের দুর্গম পথে পা বাড়িয়ে বিলম্ব করার অবকাশ নেই।
উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় জীবনের আরো বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মতাদর্শ ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন শ্রমিক শ্রেণী দেশ গঠনের জন্যে সকল প্রকার আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। শুধু প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব ও পরিচালনা। যারা আমলা এবং মধ্যবিত্ত সুযোগ সুন্ধানী শুধু তারাই পরিশ্রম বিমুখ। বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে তিনি আবার তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। ‘বিশ্বের সকল মেহনতি মুক্তিকামী মানুষের পাশে আমরা রয়েছি।’ এ প্রসঙ্গে তিনি গিনি বিসাউ ও ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দান ও সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণে আক্রান্ত আরবদের প্রতি সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে জাতির ভবিষ্যত দিক নির্ণয়ের প্রশ্নে যে বাস্তব কথাটি বলেছেন তা আমাদের অনুধাবনের বিষয়। তাঁর ভাষায় ‘ভিক্ষুকের জাত থাকে না।’ যদি এ জাতি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তুলতে না পারে তাহলে তার বৈদেশিক নীতি বিসর্জিত হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে জাতির মৌলিক সমাজতান্ত্রিক নীতি অবদমিত হয়ে যাবে। সে কারণেই তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছেন ভিক্ষুকের জাত থাকে না, তোমার স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলো, ক্ষেতে খামারে, কলে কারখানায় উৎপাদন বাড়াও।’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধু তাঁর মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন। যারা রাতের অন্ধকারে প্রগতিশীল কর্মীদের খুন করে, যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়, যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তারা দুষ্কৃতিকারী। এদের অন্যনামে ডাকার কোনো প্রশ্নই উঠেনা। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাই বলেছেন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতির যারা বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হবে। সর্বোপরি তিনি ছাত্রদেরকে এবং দেশের যুব সমাজকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে চরিত্রবান হয়ে ক্ষেতে খামারে কাজ করার নির্দেশ দেন। সুযোগ সন্ধানীদেরকে তিনি লোভ লালসা ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন—লুন্ঠিত সম্পদের মায়া ত্যাগ করুন। মুসলিম লীগেরাও সম্পদ করেছিলো কিন্তু ভোগ করতে পারেনি। তিনি উদাত্ত কন্ঠে সাদা পোশাকধারী মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের কৃষক শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেশের কাজ করুন।
প্রকৃত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল কর্মীর দেশ গড়ার কাজে পাথেয়স্বরূপ। এই ঐতিহাসিক ভাষণের যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। এবং এই ভাষণের আলোকেই দেশের প্রতিটি প্রগতি শিবির অনতিবিলম্বে তাদের ভবিষ্যত সমাজাতিন্ত্রক কর্মপন্থা গ্রহণ করে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন বলেও আমরা বিশ্বাস পোষণ করি। আমরা আরো মনে করি চিলির আলেন্দের মতো অবস্থা এদেশে কোনোদিনও হবেনা কেননা চিলিতে জাতীয় আন্তর্জাতিক শোষক ছিলো বাংলাদেশে তা নেই। আলেন্দের জনসমর্থন আর বঙ্গবন্ধুর জনসমর্থনও এক নয়।
ছয় দফা শান্তি চুক্তি
অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট অবসান এবং স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ৬ দফা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দীর্ঘ ২৪ বছরের মধ্যে আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে এটাই প্রথম সরাসরি চুক্তি। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের ৫৫তম বার্ষিকীতে এই ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হ’লো।
স্বাক্ষরিত শন্তি চুক্তির শর্তগুলো হচ্ছে এক—যুদ্ধবিরতি পালন, দুই—জাতিসংঘের উদ্যোগে সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার চুক্তির কাঠামোত ২২শে অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি রেখা সম্পর্কে আলোচনা অনুষ্ঠান, তিন—সুয়েজ শহরে খাদ্য, পানি ও ঔষধ-পত্রের সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং আহত বেসামরিক ব্যক্তিদের অপসারণ, চার-সুয়েজের পূর্ব তীরে অবরুদ্ধ মিসরীয় তৃতীয় বাহিনীর নিকট অসামরিক সরবরাহে কোনো বাঁধা সৃষ্টি না করা, পাঁচ—কায়েরো-সুয়েজ সড়কে ইসরাইলী চেকপোস্টের স্থলে জাতিসংঘের চেকপোস্ট বসানো এবং সেখানে ইসরাইলী অফিসারদের সরবরাহ পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ এবং ছয়—চেকপোস্ট বসানোর অব্যবহিত পরেই যুদ্ধবন্দী ও আহতদের বিনিময় শুরু।
মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটিতে স্বাক্ষরদান করে আরব বিশ্বের কেবল মিসর এবং অপর পক্ষে ইসরাইলের প্রতিনিধি। আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়িত সিরিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের একটি পক্ষ হিসেবে অংশ নেয়নি। ইরাকের প্রতিক্রিয়া চুক্তির স্বপক্ষে নয়। সৌদি আরবও বার বার ডঃ কিসিঞ্জারকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে আরব এবং প্যালেস্টাইনী মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আরবদের তেল নীতির কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। অবশ্য এই শান্তি চুক্তির প্রণেতা ডঃ কিসিঞ্জার এই চুক্তিটিকে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থায়ী শন্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান সহায়ক বলে উল্লেখ করেছেন।
রয়টার পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, জনৈক শীর্ষস্থানীয় সোভিয়েত ভাষ্যকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত এই শান্তি চুক্তিকে পরস্পরবিরোধী এবং একে সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করা দরকার বলে উল্লেখ করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব অবশ্য চুক্তিটিকে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধাণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
যুদ্ধবিগ্রহ, অশান্তি কারো কাম্য নয়। আমরাও তা করি না। পৃথিবীর সকল মানুষ নিজেদের অধিকার ও সম্মান নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকুক এটাই আমাদের কাম্য। তবে একথাও সত্য যে, সে চুক্তির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নং প্রস্তাব কার্যকরী করার ভিতরে দিয়েই কেবল এই অঞ্চলে উদ্ভূত সমস্যার সম্মানজনক এবং প্রকৃত সমাধান সম্ভব। আর এই ৬-দফা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব এক্ষণে সম্পূর্ণরূপে বর্তাচ্ছে জাতিসংঘ ও মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ড হেইমের উপর। দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত মধ্যপ্রাধ্য সংকটের স্থায়ী সমাধান শেষ পর্যন্ত সম্ভব হোক এটাই আমরা আশা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক