You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৭ই মে, মঙ্গলবার, ২৩শে বৈশাখ, ১৩৮১

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

যেখানে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য রয়েছে, সেখানে কোনদিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কারণ, এর সুযোগ নিয়ে সাহায্যের ছদ্মাবরণে সাম্রাজ্যবাদ আসে। এজন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ অপরাপর সমস্যার সাথে এগুলো দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে শান্তির সংগ্রামে প্রথম সারিতে স্থান দিয়েছে।
রোববার কারিগরি মিলনায়তনে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের আয়োজিত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব শ্রী রমেশ চন্দ্র উল্লেখিত বক্তব্য রাখেন। তিনি তার ভাষণে বাংলাদেশ সহ সকল উন্নয়নশীল দেশে মানবতার শত্রু সাম্রাজ্যবাদের নয়া উপনিবেশবাদ অন্তর্ঘাত ও চক্রান্ত সম্পর্কে সদা-সতর্ক দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। শ্রী রমেশচন্দ্র আরো বলেন, বিশ্বে শান্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়েছে। এই যুগে শান্তির স্বপক্ষে বহু সাফল্য আর বিজয় অর্জিত হয়ে্ছে। তবুও চিলির ঘটনা স্মরণ করে সকলের শত্রু সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শান্তি পরিষদের মহাসচিব শ্রী রমেশ চন্দ্র স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতার উল্লেখ করেছেন তা গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।
একথা নতুন করে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ একটা রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদকে উচ্ছেদ করার মহান ব্রত পালনের ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। শ্রী রমেশ চন্দ্রের ভাষায় ‘সেইসব লাল গোলাপদের কথা’ আমরা কোনদিনও ভুলতে পারবো না।
দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বাংলাদেশ সুশীল সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অথচ এই কথা কারো অজানা নয় যে, বাংলাদেশে আজ সমস্যা ও সংকটের অন্ত নেই। এখনো এদেশের মানুষের জন্য মোটা ভাত আর মোটা কাপড়ের সংস্থান করা সম্ভব হয়নি। এজন্য প্রয়োজন সময়ের। প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাহায্য ও সহযোগিতা। প্রয়োজন সদা সতর্ক দৃষ্টি ও সচেতনতা। কেননা একাত্তর সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের মাটিতে পরাজয় বরণ করার পর হাত পা গুটিয়ে বসে নেই। সময় ও সুযোগের জন্য ওৎ পেতে আছে মাত্র। কাজেই সাম্রাজ্যবাদের বিষাক্ত থাবা থেকে পরিত্রান পাবার একমাত্র উপায় হল ক্ষুধা ও দারিদ্র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। কেননা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকেই নতুন নতুন সমস্যার উৎপত্তি। আর এই সমস্যা ও সংকটের পথ বেয়েই সাম্রাজ্যবাদ অনুপ্রবেশ করে নানান ছল-ছুতায়। সাহায্যদানের নামে আস্তে আস্তে চক্রান্ত জাল বিস্তারের কাজটি চালিয়ে যায়। শুধু তাই নয় দেশের ভেতরে সাম্রাজ্যবাদী চররা তৎপর হয়ে উঠে। নানা রকমের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালায়। বাংলাদেশের এমন ঘটনাও যে ঘটছে না এমন নয়। সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে এ সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে, শান্তির শিবিরে যেমন আমরা থাকবো তেমনি আমরা শান্তির জন্যই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আর তা করতে গেলে আজকের দিনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধি। বিশেষ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতেই হবে আমাদের। খাদ্য সমস্যাই অনুন্নত দেশগুলোর প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার উৎপাদন বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম হলো দেশ গড়ার সংগ্রামে।’ এ সংগ্ৰামে শরিক হতে হবে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তিকামী সূর্য সৈনিকদের। দুর্জয় শপথে দীপ্ত হতে হবে সকলকে। স্মরণ রাখতে হবে ক্ষুধা ও দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে আসে। সুতরাং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অর্থই হলো শান্তির সংগ্ৰামকে জোরদার করা।

মর্মান্তিক এ লঞ্চ দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে

পহেলা ফেব্রুয়ারি মেঘনায় লঞ্চডুবি হয়েছিল তা উদ্ধারের কাজ গত পরশুদিন পর্যন্ত চলেছে। ঢাকা থেকে পঁচিশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মেঘনার চর ইসমানির সন্নিকটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এম, এল, বেতকা নামক এক্সপ্রেস লঞ্চ ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়ার পথে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে নিমজ্জিত হয়। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রথমেই আশঙ্কা করেছিল–এই লঞ্চডুবিতে বহুলোকের প্রাণ বিনষ্ট হয়েছে বলে। সরকারের পক্ষ থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা কম করে বলা হলেও আসলে যে অভাবিত সংখ্যক মানুষের প্রাণ বিনষ্ট হয়ে গেছে–তা গতকালের সংবাদপত্র গুলোর খবর থেকে প্রমাণিত। মৃত্যুর তাণ্ডব লীলা সংঘটিত হয়েছে। এমন, এল, বেতকা উদ্ধার করার পর যে সত্য প্রকাশিত হয়েছে তা হলো এ পর্যন্ত ১১৫ জন যাত্রীর লাশ পাওয়া গেছে। এবং কিছু সংখ্যক ভেসে গেছে–যার সন্ধান মেলেনি এটাও সত্য। লঞ্চটি উদ্ধার করার পর লঞ্চের মধ্যে বহু লাশ পাওয়া গেছে। লঞ্চের দরজা-জানালা বন্ধ থাকার কারণে এটা হয়েছে। তবু কিছু মৃতদেহ ইতোপূর্বে বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু লাশ ভেসে যেতে পারে –যার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি। এমন অনুমান করা অমূলক নয়। উল্লেখিত এই লঞ্চডুবিটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও ভয়াবহ ঘটনা। গতকালের সংবাদপত্রগুলোতে লাশের যেসকল ছবি প্রকাশিত হয়েছে অত্যন্ত মর্মবিদারক। উদ্ধারকৃত লাশের সংখ্যা ১৭৯ । সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছে তা অমূলক নয়। এরা সবাই অসহায়ের মতো মৃত্যুবরণ করেছে। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার লঞ্চডুবি হয়েছে। তখন মৃতদেহ উদ্ধারের সংখ্যা অত্যন্ত কম দেখা গেছে। বেশি করে আশঙ্কা করা হলেও মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক। আসলে লঞ্চডুবিতে যে বহু প্রাণের বিনষ্ট ঘটে তা এবারের এম, এর, বেতকা ডুবির মাধ্যমে প্রমাণিত হলো। প্রতিটি লঞ্চ ডুবিতেই যে বহু প্রাণের বিনষ্টি ঘটে তা যথাযথ অনুসন্ধান বা উদ্ধারকাজ পরিচালনা করলে প্রমাণিত হবে। আমরা বিভিন্ন লঞ্চডুবির সময় যথার্থ উদ্ধারকাজ চালাবার অনুরোধ করে এসেছি। এম, এল, বেতকা ডুবির বেলায়ও আমরা সে অনুরোধ রেখেছিলাম। এবার কর্তৃপক্ষ নিমজ্জিত লঞ্চটির উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং কৃতকার্য হয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক সরেজমিনে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এবং তারা যা দেখেছেন তা প্রকাশ করেছেন। একজন মহিলা ছাড়া এই বিরাট সংখ্যক মৃতের কাউকেই সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে সংবাদ প্রকাশ। মৃতদেহগুলোর হাত থেকে ঘড়ি, আংটি খুলে নেওয়ার সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মৃতদের জিনিসপত্র লুট হওয়ার মতো সংবাদও আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনা কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে কেমন করে ঘটতে পারে তা আমরা বুঝতে পারি না। অসহায় মৃত মানুষের জিনিস কর্তৃপক্ষের সামনে লুট হবে আর কর্তৃপক্ষ তা নীরবে সহ্য করবে-এটা কোন সভ্য সমাজের প্রশাসন ব্যবস্থা হতে পারেনা। এ ঘটনা যদি সত্য হয় তবে আমরা তার নিন্দা করি এবং কর্তৃপক্ষকে ব্যাপারটির তদন্ত করার আহ্বান জানাই।
দেশের বিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থা স্বাধীনতার পর সরকার যতদূর সম্ভব ভালো করার চেষ্টা করেছেন এবং আজও করছেন। নদী পথে যাতায়াতে লঞ্চের ঘাটতি রয়েছে। ফলে যাত্রীরা অসম্ভব ভিড় করে থাকে। লঞ্চের মালিক যারা তারাও অধিক মুনাফার লোভে ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দ্বিধা করেন না। বিপদাশংকা জেনেও তারা এটা করে। তাছাড়া অধিকাংশ লঞ্চই স্বাধীনতার পর মেরামত করা চালানো হচ্ছে। লঞ্চের যন্ত্রাংশের অভাবও রয়েছে। লঞ্চ ডুবির পেছনে এসকল কারণ সক্রিয় বলে আমাদের ধারণা, আর একটি বিষয় লক্ষণীয় তাহলো আবহাওয়া খারাপ বা ঝড়ের বিপদ সংকেত রেডিও মারফত ঘোষণা করা সত্ত্বেও নদীপথের যানবাহনগুলো যাতায়াত বন্ধ করে না। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরো লক্ষ্য করেছি -বিপদাশঙ্কা জেনেও যাত্রীরা ঠাসাঠাসি করে আরোহণ করে থাকে। আমরা সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরোধ করব যত অসুবিধাই হোক না কেন-এ ধরনের জীবন ঝুঁকি নিয়ে নদীপথে যাতায়াত না করতে। এম, এল, বেতকার এই দুর্ঘটনার যে মর্ম বিদারক কাহিনীর সৃষ্টি তা থেকে সবাইকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। যারা আজ অসহায়ের মত মৃত্যুবরণ করেছে, যারা তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে ঘরে ফিরছিল অথবা যারা সামান্য রোজগার থেকে কিছু বাঁচিয়ে দুটো প্যান্ট, শার্ট বা একটা শাড়ি নিয়ে ঘরে যাচ্ছিল তাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু শুধু নিদারুণ বেদনারই নয়-জাতীয় শোক প্রকাশের মতো ঘটনাও বটে। এদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ দানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমরা জানা-অজানা এই অসংখ্য মৃতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!