বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৫ই মে, রবিবার, ২১ই বৈশাখ, ১৩৮১
আজ ফ্রান্সে নির্বাচন
কে আসছেন ইলিসি প্রাসাদে? জ্যাকুইস চাবান ডেলমাস, ভ্যালেরি গিসকার্ড এডগার ফর, পিয়েরে মেসমার না ফ্র্যাঙ্কোইস মিত্তেরাঁ। প্রথম চারজনই গলপন্থী, মিত্তেরাঁ সংযুক্ত সমাজতন্ত্রী এবং কমুনিষ্ট প্রার্থী।
এই প্রথম ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থীরা একজোট হয়ে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন, গলপন্থীরা নানা শিবিরে বিভক্ত।
বৎসর আগে মিত্তেরাঁ দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং দ্যগলের বিরুদ্ধে। ভোট পেয়েছিলেন শতকরা পয়তাল্লিশ ভাগ। সেবার গলপন্থীরা একযোগে লড়াইয়ে নেমেছিলেন, বামপন্থীদের মধ্যে ছিল না কোন ঐক্য।
সে নির্বাচনী ব্যর্থতাই বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে থাকবে। বিগত মার্চের পার্লামেন্টারী নির্বাচনের পূর্বেই বামপন্থী তিনটি রাজনৈতিক দল একটা সমঝোতায় আসে। সর্বসম্মত একটা কর্মসুচী গৃহীত হয়। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ভোটারদের সামনে রেখেছে সংযুক্ত বামপন্থী জোট সেই তিন দফা কর্মসূচী। স্থরানুক্রমে বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে তাতে। শ্রমিকদের জন্য মাসে ১২০ পাউণ্ডের সর্বনিম্ন মজুরী থেকে শুরু করে। ন’টি মূল শিল্পের জাতীয়করণ ও আরো চারটি শিল্পে সরকারী নিয়ন্ত্রণ স্থাপন প্রভৃতি ছ’মাস, আঠরো মাস এবং পাঁচ বৎসর মেয়াদী কর্মসুচী অন্তভুক্ত রয়েছে বামপন্থী জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে।
সরকারী সূত্রেই জনমতের যতটুকু জানা গেছে তাতে বামপন্থী জোটের প্রার্থী তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দীর চাইতে অনেক এগিয়ে আছে। মিত্তেরাঁর স্বপক্ষে রয়েছে শতকরা তেতল্লিশ জন ভোটার, গিসকার্ডে’র সমর্থনে পচিশ জন এবং গলপন্থীদের ‘অফিসিয়াল নমিনি’ ডেল মাসের প্রতি আস্থাবান শতকরা তেইশ জন। কিছুটা হেরফের অবশ্যই হতে পারে কিন্তু রাতারাতি বড় রকমের কোন পরিবর্তন হবে বলে কেউই আশা করেন না। যদি তা না হয় তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হবেন সবাই। আবার নির্বাচন হবে। লড়তে হবে আর এক রাউণ্ড।
ফান্সের সংবিধান অনুসারে যদি কেউ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে ব্যর্থ হন তবে সর্বোচ্চ ভোট যে দু’জন পাবেন তাদের মধ্যে আর একবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে প্রথম রাউণ্ডের পনের দিন পর। চুড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে তখনই। আজকের নির্বাচনে যারা মনে করছেন কারো পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হবে না তারা বরং অপেক্ষা করছেন আর এক রাউণ্ড নির্বাচনী লড়াই দেখার জন্য। সে রাউণ্ডে মিত্তেরাঁ তো থাকবেনই, থাকবেন গলপন্থীদের একজন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কে হবেন তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছে। কেউ বলছে অর্থমন্ত্রী গিসকার্ড। আবার কেউ বলছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেলমাসই টিকে থাকবে।
প্রথম রাউণ্ডেই যদি চুড়ান্ত কোন ফলাফল ঘোষিত হয় তবে ধরে নেয়া যায় সংযুক্ত বামপন্থী প্রার্থী ফ্যাঙ্কোইস মিত্তেরাঁই সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি বিজয়ের মাল্য ধারণ করতে সক্ষম হবেন। আর যদি না হয় তবে গলপন্থীরা একাট্টা হয়ে দ্বিতীয় রাউণ্ডে তীব্র আক্রমণ চালাবেন মিত্তেরাঁর উপর। সে আক্রমণে কতটকু সুযোগ করতে পারবেন সমাজতন্ত্রী মিত্তেরাঁ তা ভবিষ্যতই বলতে পারে।
নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, ফ্রান্স আজ যে একটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে তা বলাই বাহুল্য। মিত্তেরাঁর ভাষায় বলতে হয় গণমুখী সংগঠনগুলোর বিভেদের কারণে বহু বৎসর যাবৎ ডানপন্থীরা ফ্রান্স শাসন করেছে। এখন সময় এসেছে সে অবস্থা পরিবর্তনের। ফ্রান্সে যদি আদৌ তেমন কোন পরিবর্তন শুরু হয় তবে তা শুধু সে দেশের চৌহদ্দিতেই বাধা পড়ে থাকবেনা। সমগ্র ইউরোপে সে পরিবর্তনের আঁচ গিয়ে লাগবে। ফ্রান্স এবং ইউরোপের পুজিবাদী ও মনোপলি স্বার্থ কি নীরবে তা অবলোকন করবে?
বিজ্ঞান ভিত্তিক গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির তিন দিন ব্যাপী প্রথম জাতীয় সম্মেলনের আজ তৃতীয় দিবস। গত শুক্রবার ৩রা মে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মন্ত্রী তার উদ্বোধনী ভাষণে দেশের শিক্ষকদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন যে, দেশের দায়িত্বশীল শিক্ষিত ও সচেতন গোষ্ঠি হিসেবে শিক্ষক সমাজ অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। অতঃপর তিনি শিক্ষক সমাজকে উপযুক্ত মন ও মানসিততা নিয়ে আত্মত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে এবং জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার আবেদন জানান।
এই সম্মেলনে বহু দেশী বিদেশী শিক্ষক প্রতিনিধি সহ প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক যোগদান করেন। তাদের মাঝে ভাষণদান প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী আরো বলেন, যে, সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সরকার বিজ্ঞান ভিত্তিক, গণমুখী, বাস্তবধর্মী ও সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এবং এই পরিবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হবে। আপামর জনসাধারণকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করা এবং সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।
মন্ত্রী মহোদয়ের ভাষণের প্রতি পূর্ণ সমর্থন রেখেই আমরা বলতে চাই যে, বাস্তবিক পক্ষে দেশ ও জাতি গঠনের জন্য আজ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন আবশ্যক। কারণ বৃটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশে প্রচুর কেরাণী সৃষ্টি হয়েছে সত্য, কিন্তু মনীষার উদ্বোধন হয়নি। কিম্বা গণমুখী শিক্ষার পরিবেশও সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আজ একটি নতুন জাতি হিসেবে আর শুধু কেরাণী সৃষ্টি করলে চলবে না। শিক্ষাকে সার্বিক জাতীয় উন্নয়নের প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, প্রায় দুই বছর হতে চলল বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত শিক্ষানীতিকে ঢেলে সাজানোর কোন তৎপরতার নমুনা আমরা পাইনি। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করতে হলে কাগুজে পরিকল্পনায় তা সাধন হবে না। শিক্ষানীতি সংস্কারের অঙ্গীভূত বিষয় হিসেবে শিক্ষকছাত্র সমস্যারও সার্বিক মূল্যায়ন করতে হবে।
আমরা জানি এই উপমহাদেশে অদ্যবধি সর্বাপেক্ষা উপেক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষক সম্প্রদায় অন্যতম। বিশেষ করে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা চড়ান্তরকমে অবহেলিত। তাদের সান্মানিক ও শ্রমের সীমার মধ্যে কোন ন্যায়সঙ্গত সঙ্গতি নেই। শ্রমের তুলনায় তারা ন্যূনতম সম্মানীও অনেক ক্ষেত্রে পাননা। ফলে স্বভাবতঃই স্বপেশার প্রতি তারা শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলতে থাকেন। যা শুধু শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের অবনতি বা শিক্ষক-ছাত্র সমস্যাকে বাড়িয়েই তোলে না-এই অবস্থা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপরও স্থায়ী প্রতিক্রিয়ার ছাপ রাখে।
জাতিগঠনে ত্যাগ ও আদর্শের নিষ্ঠা নিয়ে শিক্ষক সমাজকে এগিয়ে আসার জন্য যে আবেদন জানানো হয়েছে, আমরা বিশ্বাস করি তাতে শিক্ষক সমাজ সাড়া দেবেন। কারণ মূলতঃ আদর্শের দোহাই মেনেই এ উপমহাদেশের শিক্ষক সমাজ এ যাবত কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষক সমাজের সম্মানজনকভাবে বেচে থাকার বিষয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার প্রশ্নটিকেও সরকার অগ্রাধিকার দেবার জন্য কৃতসঙ্কল্প। সেজন্য শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবী দাওয়া ও সুখসুবিধার প্রশ্নে সরকার একান্ত সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা রাখবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। শিক্ষকদের ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে হলে যে পটভূমি দরকার তার ইঙ্গিতও রয়েছে মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে। আমরা আশা করবো এবার তার আশু বাস্তবায়ন হবে।
আমরা মনে করি শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী, বিজ্ঞান ভিত্তিক, বাস্তবধর্মী ও সমাজতন্ত্র ভিত্তিক বলতে কি বোঝায়—এ প্রসঙ্গে তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আজ প্রয়োজন। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এই সব ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য এই ব্যাখ্যা খুবই সময়োপযোগী। এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব অপরিসীম। তাদের প্রকাশিতব্য প্রতিবেদনের দিকে আমরা চেয়ে আছি। শোনা যাচ্ছে অতি সত্বর জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। তাই স্বাভাবিক ভাবে আমরা আশা করবো-শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ, শিক্ষক-ছাত্র সমস্যা, শিক্ষকদের দাবী দাওয়া, পরীক্ষা নীতি সহ সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধনের সুস্পষ্ট রূপরেখা তাদের প্রতিবেদনে আমরা পাব। যার মধ্যে গণমুখী শিক্ষার সুদরপ্রসারী ফল লাভের নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক