পরিবর্তন দরকার ছিল- বঙ্গবন্ধু
এক ঘন্টাব্যাপী ভাষণের শুরুতে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রশাসনিক কাঠামাে পরিবর্তন এবং পুনর্গঠনের দরকার ছিল। কারণ কোন স্বাধীন দেশে ঘুণেধরা ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে না। কারণ জনগণের কল্যাণ সাধন নয় এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল শাসন এবং শােষণ করা।
তিনি বলেন, যারা পুরনাে শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাও জানেন, এ ব্যবস্থা জনগণ থেকে কত বিচ্ছিন্ন ছিল। যারাই সরকারী কর্মচারী হয়েছেন, তারাই নিজেদের মনে করেছেন মুরুব্বী। জনগণ শুধু তাদের আদেশ পালন করবে। তিনি বলেন, প্রশাসন ও জনগণের মধ্যকার দীর্ঘদিনের শূন্যতা দূর করার জন্যে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধের মতাে। আমাদের এই পরিবর্তন সফল হলে, অবশ্যই অন্য দেশও এ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবে।
ক্ষমতা অনেক বেশি
রাষ্ট্রপতি পরিষ্কার ভাষায় জানান, সাবেক ডেপুটিকমিশনারদের চেয়ে এখন গবর্নরদের ক্ষমতা অনেক বেশি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসন চালান দুনিয়ায় এমন নতুন পরীক্ষা। গবর্নরদের বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, কারণ তারা স্থানীয় উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার সব দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি বলেন জেলা প্রশাসন কাউন্সিলের সচিব হবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। এছাড়া এসপি এবং অন্যান্য কর্মকর্তা থাকবেন। গবর্নরদের যােগাযােগ থাকবে সরাসরি কেন্দ্রের সঙ্গে।
পার্টি সেক্রেটারীর ক্ষমতাও কম নয়
তিনি জেলা পর্যায়ে পার্টির সেক্রেটারীরও কম ক্ষমতা থাকবে না বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সহযােগিতা ও সম্বন্ধের মাধ্যমে সকলকে কাজ করতে হবে। গবর্নর আহুত প্রশাসন কাউন্সিলের সভার পার্টি সেক্রেটারী এবং সেক্রেটারী আহুত পার্টির সভায় গবর্নর উপস্থিত হবেন।
জনগণের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে হবে
বঙ্গবন্ধু প্রশাসন চালাতে গিয়ে গবর্নরদের জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতে উপদেশ দেন। তিনি বলেন, কাজের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে গবর্নরদের সহনশীল এবং সংযমীও হতে হবে। তিনি গর্বনরদের সকলের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার উপদেশ দেন। তিনি বলেন, গবর্নররা নীতি নির্ধারণ করবেন। তা বাস্তবায়িত হবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে। গবর্নরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের একটা খারাপ কাজ জনগণকে শত ভাল কাজের কথা ভুলিয়ে দেবে। কাজেই সজাগ হয়ে কাজ করতে হবে।
যেসব সংসদ সদস্য গবর্নর হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে তাদের উদ্দেশ্য বলেন, আপনাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ আপনারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। তিনি তাদের সকল প্রকার স্থানীয় কার্যাবলি ও স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বে থাকার উপদেশ দেন। তিনি বলেন, আপনাদের নির্বাচনকালে জনগণ আশা করেছিলাে, আপনাদের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান এবং উন্নয়ন হবে। এবার সে সুযােগ আপনাদের দেয়া হয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে
আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও দুর্নীতি দমনের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এজন্যে গবর্নরদের যে কোনাে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও দুর্নীতি দমনের জন্যে থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক কর্মীদের ডেকে গবর্নরদের কথা বলতে হবে। এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
উন্নয়ন কর্মসূচি তদারকী করবেন
নিজস্ব জেলার জেলা গবর্নরদের উন্নয়ন কর্মসূচি এবং ওয়ার্কশপ প্রােগামের কার্যক্রম তদারকি করার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সুষ্ঠু বাস্তবায়নের প্রতিও সজাগ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকারী কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। জনগণ সংগঠিত না হলে শুধু অর্থ বরাদ্দ করে কাজ করতে হবে না।
হিসাব রাখতে হবে
বঙ্গবন্ধু বলেন, বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহারের জন্যে গবর্নররা দায়ী থাকবেন। জনগণের জ্ঞাতার্থে উন্নয়ন প্রকল্প কম বরাদ্দ খরচের হিসাব নিকাশের চার্ট ঝুলিয়ে দেয়ার জন্যে তিনি গবর্নরদের নির্দেশ দেন।
প্রশাসন ও বৈদেশিক নীতি জানতে হবে
বঙ্গবন্ধু গবর্নরের প্রশাসনের পদ্ধতি ও আইন কানুনে এবং সরকারের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। তিনি বলেন এছাড়া প্রটোকল সম্পর্কেও তাদের ধারণা থাকতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের সহযােগিতা করবেন।
স্ব স্ব জেলায় স্কুলে কলেজ যাতে ঠিকমত চলে সেদিকে লক্ষ্য রাখার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, বিশেষভাবে সরকারী অর্থে পরিচালিত প্রাইমারী স্কুলগুলােতে ছাত্র শিক্ষকের উপস্থিতি ঠিকমতাে হয় কি না তা দেখতে হবে।
কিভাবে পরিকল্পনা দিতে হবে
উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের সময় বঙ্গবন্ধু গবর্নরদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বৃহত্তর জনসংখ্যা লাভবান হয় কি না সেদিক লক্ষ্য রাখতে বলেন। তিনি বলেন, বরাদ্দের টাকা থানায় থানায় ভাগ করে দিলেই উন্নয়ন হয় না। যেসব সরকারী কর্মচারী গবর্নর নিযুক্ত হয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা এখন শুধু সরকারী কর্মচারীই নন পার্টির সদস্যও।
দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, যারা দীর্ঘদিন জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে। সংগ্রাম করেছেন, যারা তার ডাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তারা নতুন ব্যবস্থা সফল করে জনগণের কল্যাণ এবং জাতীয় উন্নয়ন এগিয়ে নিতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী। এ আস্থা তার আছে।।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানের আহ্বান
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নব নিযুক্ত গবর্নরদের প্রতি সমূলে দুর্নীতি উৎখাতের তীব্র অভিযান শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনাদের অবশ্যই স্বজনপ্রীতি পক্ষপাত এবং অন্যান্য ধরনের দুর্নীতির উর্ধ্বে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু কাল সােমবার বঙ্গভবনে প্রশিক্ষণ কোর্স উদ্বোধন করে নবনিযুক্ত গবর্নরদের একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সমাজ থেকে উৎকোচ ও দুর্নীতি উচ্ছেদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রত্যেকের উপরই তার আস্থা আছে। যারা আমার আহ্বান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তারা এই কাজও সমাধা করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সীমিত ও আকারে ছােট প্রশাসনিক এলাকায় আত্মীয়স্বজনের প্রভাব স্থানীয় শত্রুতা এবং বিবাদ বিসম্বাদ হওয়া স্বাভাবিক। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এগুলাে থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং এড়িয়ে চলতে হবে। আপনাদের অবশ্যই এসব থেকে দূরে থাকতে হবে।
সার এবং অন্যান্য সরকারী উপকরণ চুরিকে অনেকটা নিয়মে পরিণত করায় বিস্ময় প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এগুলাে কখনােই সহ্য করা হবে না। তিনি হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন, এরূপ চুরি বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, যে ঘুষ নেয় শুধু সে নয় যারা ঘুষ দেয় যারা দুর্নীতির সহায়তা করে তাদেরও অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তিনি করে নিয়ে বলেন, যারা দুর্নীতি করবে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি গবর্নরদের বলেন, আমার লােকেরা যাতে শান্তিতে থাকতে পারে আপনাদের তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, বৈপ্লবিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে নতুন সমাজ গড়ে তােলার স্বার্থে জাতীয় রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২২ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত