You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৭জন দুঃস্থ শিল্পী সাহিত্যিককে আর্থিক সাহায্য দান
সৃজনশীল প্রতিভাকে নষ্ট হয়ে যেতে দেয়া হবে না: কোরবান

তথ্যমন্ত্রী জনাব এম কোরবান আলী বলেছেন, ভবিষ্যতে এদেশে কোন শিল্পী কবি, সাহিত্যিকের প্রতিভাকে কোন অসুবিধার জন্যে নষ্ট হয়ে যেতে দেয়া হবে না। মন্ত্রী বলেন যে ফুল তার সৌরভ নিয়ে ফুটবে তা বনে জঙ্গলেই হােক আর মালীর মালাতেই ফুটুক, আমরা যদি জানতে পারি, তাহলে অসময়ে তাদের ঝরে যেতে দেবাে না। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী মহােদয় প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শােষণহীন সমাজ গঠনের যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে তাকে দেশের শােষণহীন কবি সাহিত্যিকরা তাদের সৃজনশীল কাজের দ্বারা সহায়তা করবেন। নতুন সমাজ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দ্বিতীয় বিপ্লবের এই সংগ্রামে সকলকে শরীক হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
বুধবার সকালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে দেশের ১৬ জন দুঃস্থ কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং একজন পরলােকগত শিল্পীর পরিবারকে অর্থ প্রদান উপলক্ষে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার স্মারক হিসেবে এই টাকা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দীন ঠাকুরও ভাষণ দেন।
ফাউন্ডেশন থেকে দেয়া এ টাকার মােট পরিমাণ ৭০ হাজার। এর মধ্যে কয়েকজনের বেলায় জানানাে হয়েছে যে তাদেরকে এই টাকা ছাড়াও চিকিৎসা খরচের প্রয়ােজনীয় টাকা দেয়া হবে। যে পরলােকগত শিল্পীর পরিবারকে অর্থ সাহায্য করা হলাে সেই শিল্পী হলেন অমর লােকসঙ্গীত শিল্পী জনাব আবদুল আলীম। অনুষ্ঠানে ঘােষণা করা হয় শিল্পীর পরিবারকে আগেও অর্থ সাহায্য করা হয়েছে এবং আগামীতেও করা হবে।
রামপুরায় টেলিভিশন ভবনের তিন নম্বর স্টুডিওতে আয়ােজিত হয়েছিল এই অনুষ্ঠানঅন্তরঙ্গ, প্রাণবন্ত, মনােজ্ঞ। যারা অর্থ সাহায্য পেলেন তাদের মধ্যে ২ জন। অনুষ্ঠানে ছিলেন না। একজন ওস্তাদ গুল মােহাম্মদ খান, আরেকজন জনাব মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। ওস্তাদজী এখন হাসপাতালে রােগশয্যায়। তার পক্ষে চেক গ্রহণ করেন তার ছেলে জনাব মােহাম্মদ ইয়াসিন খান। জনাব মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহর টাকা আগেই দেয়া হয়েছে ওস্তাদ গুল মােহাম্মদ খান এক বাণী পাঠান, তা পাঠ করা হয়। গতকালের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। পরিবেশিত এক মনােজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ ও ইচ্ছানুসারে দুঃস্থ শিল্পী ও তাদের পরিবার পরিজনদের সাহায্যার্থে এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্য এই তহবিল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিককর্মী এবং দেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপােষকতা ও একনিষ্ঠ অনুরাগের নিদর্শন এই ফাউন্ডেশন।
যাদেরকে অর্থ সাহায্য দেয়া হয়েছে তারা হলেন-উপমহাদেশের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ গুল মােহাম্মদ খান, ৫ হাজার টাকা, প্রবীণ কবি ও গীতিকার জনাব আজিজুর রহমান ৫ হাজার টাকা, বাংলাদেশ বেতারের প্রবীণতম শিল্পীদের অন্যতম সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেন ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম নিবাসী নিষ্ঠাবান গবেষক জনাব আবদুল হক চৌধুরী, ৩ হাজার টাকা, নজরুল সঙ্গীতের প্রথিতযশা শিল্পী জনাব জুলহাস উদ্দীন আহমদ ৫ হাজার টাকা, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা বর্তমানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত জনাব মেজবাহউদ্দীন আহমদ, ৫ হাজার টাকা, লেখক জনাব কে এম সালাহউদ্দীন ৩ হাজার টাকা, প্রবীণ শিল্প সাহিত্যিক ও কবি জনাব নুরুল ইসলাম কাব্যবিনােদ, ৩ হাজার টাকা, কবি আবুল হাসান ৫ হাজার টাকা, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রবীণ শিক্ষক মি. পি সি গােমেজ ৫ হাজার টাকা, বাংলাদেশ বেতারের প্রবীণ শিল্পী জনাব আবদুর রশীদ মিয়া, ৫ হাজার টাকা, নিষ্ঠাবান সাহিত্যসেবী শ্রী অজিত কুমার দে, ৩ হাজার টাকা, বাংলাদেশের প্রখ্যাত লােক সঙ্গীত শিল্পী জনাব মােহাম্মদ নাসির, ৬ হাজার টাকা, বিশিষ্ট ঢােল বাদক জনাব আমিন উদ্দীন মিয়া ৩ হাজার টাকা, গ্রামীণ কবি জনাব মােহাম্মদ হানিফ কাজী, ৩ হাজার টাকা, মরহুম আবদুল আলীমের স্ত্রী বেগম জামিলা আলীম, ৩ হাজার টাকা, প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ৩ হাজার টাকা। অনুষ্ঠনে প্রধান অতিথি তথা ও বেতার মন্ত্রী জনাব এম কোরবান আলী শিল্পী কবি সাহিত্যিকদেরকে চেক প্রদান করেন।
জনাব এম কোরবান আলী প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন যে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি যুগে যুগে দিনে দিনে বাঁচিয়ে রেখেছেন এদেশের কবি শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি মনা ব্যক্তিবর্গ। এদের অনেককে আমরা জানি অনেকে আমাদের অজানা। তাদের সঠিক তালিকা আমাদের কাছে। নেই। তাদের কাজের সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে পারিনি।
স্বাধীনতাপপূর্ব ২৫ বছরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিজাতীয় কিছু লােক বাইরে থেকে এসে তাদের সংস্কৃতিকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের ষড়যন্ত্রে এদেশের সংস্কৃতিক শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, শিল্প কবি সাহিত্যিকদের মেরুদণ্ডও দুর্বল হতে দুর্বলতর হচ্ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী বলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দেন। পঠিত হযেছে বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন।
ফাউন্ডেশন থেকে যে অর্থ সাহায্য করা হচ্ছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সম্মানী দুঃস্থ শিল্পী কবি সাহিত্যিকদের দেয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। জাতি যে তাদের ভােলেনি, সম্মান করতে শিখেছে এই অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে এটুকু আমরা দেখাতে পেরেছি।
জনাব তাহেরউদ্দীন ঠাকুর তাঁর ভাষণে জানান যে ফাউন্ডেশনের তহবিলে এ পর্যন্ত ১৯ লাখ টাকা সংগৃহীত হয়েছে। এর দ্বারা সংস্কৃতিসেবীদের সম্মানিত করা হবে।
জনাব ঠাকুর বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু প্রখ্যাত ও অজ্ঞাত কবি শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবী আমাদের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে কাজ করে যাচ্ছেন। পিলসুজের উপর ম্যাটের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার মতাে তারা এদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জনাব ঠাকুর বলেন, সংস্কৃতির দ্বারা সেবা করেন তাদের কাছে জাতি হিসেবে ব্যপ্তি হিসেবে আমরা ঋণী। তাদের এই ঋণ শােধ করা যাবে না। তাদের প্রতি সজাগ থেকে সম্মান জানানাে প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তিনি বলেন, তাদের ঋণ অপরিশােধ্য বটে, তবে তাদেরকে সম্মান জানানাের মাধ্যমে আমরা যেন নিজেদের সম্মানিত করি। অন্তঃসার শূন্যে সহানুভূতি প্রদর্শন করা যার দ্বারা কর্তব্য পালনের চেষ্টা না করে সুস্থ মানসিকতা চেতনা ও অস্তিত্ববােধের মাধ্যমে দেশের নিবেদিতপ্রাণ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিসেবীদের সম্মান জানানাের জন্য জনাব ঠাকুর আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তৃতা দেন তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব শামসুল হক।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৭ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!