বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩রা মে, শুক্রবার, ১৯ই বৈশাখ, ১৩৮১
খাদ্য পরিবহণে সমন্বয়ের অভাব
টন, দু’টন না লক্ষাধিক টন খাদ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই পরিমাণ খাদ্য দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্নাঞ্চলে সরবরাহ করা যাচ্ছেনা। ফলে দ্রুত সুষ্ঠু খাদ্য সরবরাহে বিরাট প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তর ভাগ থেকে স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাগিদটাই প্রধান এবং জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। বিভিন্নাঞ্চল থেকে নিত্যনতুন খবর আসছে। চালের অভাব এবং চালের দাম এর খবরও আমরা পাচ্ছি। শহর এবং গ্রাম এলাকায় খাদ্য সরবরাহ তাই আশানুরূপ নয়। কারণ, সমম্বয়ের অভাব। তাই বন্ঠণ ব্যবস্থায় বিঘ্ন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, খাদ্য বিভাগ, পরিবহণ, ঢাকার কমিটি এবং রেলওয়ের কর্মকান্ডের নাকি কোনরকম সময় নেই। গত এক খবরে বলা হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার খাদ্য শস্যাগারে ১৮১৩২ টন গম মওজুত রয়েছে জেটিতে অপেক্ষমান জাহাজে ৫৯২৫১৪৮০২ টন গম পড়ে আছে। জাহাজের তীরে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য পড়ে আছে তার সর্বমোট হিসেব হচ্ছে ৮২১৮৫ টন। তাছাড়া বর্তমান সপ্তাহে ৮৬৮৪৭ টন গম তিনটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে নোঙ্গর করবে। কিন্তু ইতিমধ্যেও যদি সমন্বয়ের অভাবে খাদ্য পরিবহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তা হলে তা অচিরেই মারত্মক আকার ধারণ করতে পারে। খাদ্য শস্য পরিবহণ এই ধরনের বিলম্বিত নীতি কখনো গ্রহণ হতে পারে না। বর্তমানে যে পরিমাণ খাদ্য মওজুত রয়েছে, তাতে খাদ্য পরিস্থিতি দারূণভাবে কাহিল হওয়ার মতো নয়। খাদ্য শুধু মওজুত থাকলে কিংবা বন্দরে পাড়ি গেলেইতো আর মানুষের পেটের নিবৃত্তি হবে না। খাদ্যশস্য যথাসময়ে দেশের বিভিন্নাঞ্চলে সরবরাহ হতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে । কিন্তু সমন্বয়কারীরা এ ব্যাপারে যে হারে শৈথিল্য এবং গাফিলতির চরম কাষ্ঠ প্রদর্শন করেছেন, তাতে খাদ্য পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর রূপ গ্রহণ করছে বাধ্য হয়েই। ঢাকার কেন্দ্রীয় পরিবহণ সমন্বয় কমিটি খাদ্য পরিবহণের জন্যে সাধারণত কোষ্টারের ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রামে তাদের কোন অফিস নেই, সেহেতু বন্দরে খাদ্য পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা কোষ্টারের ব্যবস্থা করতে পারেন না। এই সমন্বয় কমিটির শাখা কমিটি চট্টগ্রামে বর্তমান। তারা সপ্তাহান্তে বৈঠকে বসেন। আলাপ-আলোচনা করেন। কিন্তু তাতে খাদ্য পরিবহণ সমস্যার কোন সুষ্ঠু সুরাহা সম্পাদিত হয় না। রেলওয়ে, বন্দর ও খাদ্য বিভাগের প্রতিনিধিদের প্রতিদিন বৈঠকে বসে খাদ্য সরবরাহ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার নিয়ম থাকলেও, আজ পর্যন্ত এদের কোন বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায়নি। ফলে কোন সমন্বয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন আগে সাইলোগুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে। খাদ্যমন্ত্রী তা সরেজমিনে তদন্তও করে এসেছেন। তখন তিনিও সমন্বয়ের বিষয়টা চিন্তা করে দেখেন এবং খাদ্য সরবরাহেতে কোন রকম বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সে জন্যে একটি কমিটিও গঠন করে দিয়ে আসেন। বৈঠকে মিলিত হয়ে খাদ্য সরবরাহ সুগম করাই ছিল এ কমিটির মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু অত্যন্ত মর্মপীড়ার বিষয় এই যে, হয় অন্য বিভাগীয় প্রতিনিধি, নয়তো বা রেলওয়ে প্রতিনিধি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকছেন। ফলে, খাদ্য সরবরাহ সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমরেই রয়ে গেছে। এদিকে যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে খাদ্য সমস্যা ততই সংকটময় পারিস্থিতির উদ্রেক করে চলেছে। এ অবস্থায় অফিসারদের অবহেলার জন্য সাধারণকে অনাহারে প্রাণাহুতি দিতে হচ্ছে। খাদ্যশসা সরবরাহ নিয়ে যে সীমাহীন শৈথিল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, বন্দরের চাল-গম বন্দর থেকে নট-নড়নচড়ন হয়ে রয়েছে, তাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মনে খাদ্য সম্পর্কে আতংক ও আশংকার সঞ্চার হচ্ছে। জনসাধারণের মন থেকে এই শংকট দূর করতে হলে অবিলম্বে বন্দর থেকে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্তা চুড়ান্ত করতে হবে এবং যাদের অবহেলা ও গাফিলতিতে খাদ্যশস্য পরিবহণে দেখা দিয়েছে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা, তাদের বিরুদ্ধে ও আইনানুগ ব্যবস্থাবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমরা মনে করছি।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী প্রসঙ্গে
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার দু’জন এম, এ, এম, কম ও এম, এস, সি পরীক্ষা ভাগ্য সম্পূর্ণ অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলে এক সংবাদে প্রকাশ। উল্লেখিত সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষার তারিখ সময় পরিবর্তনের কারণেই এই অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে ১৯৭০-৭১ সালের শিক্ষা বর্ষের পরীক্ষার্থী হওয়া ও এরা যথাসময়ে তাদের পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। কারণ তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ ছিল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণের জন্যে তিনবার চেষ্টা করেছেন। শেষ তারিখ ছিল সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাকান্ডের কিছুদিন পূর্বে। হত্যাকাণ্ডের দরুন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে । উল্লেখিত ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদের পরীক্ষা পুনরায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্নাকোত্তর শ্রেণীতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দুহাজার আটশত জন। এর মধ্যে হাজার দু’শো জনের পরীক্ষা সমাপ্ত না হতেই হত্যাকাণ্ডের দরুণ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ গেছে। যে সকল পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা অনেক ক্ষেত্রে বাকী রয়ে গেছে। সংবাদে আরো প্রকাশ, যে সংখ্যক ছাত্র পরীক্ষা দিতে পারেনি তার আটশত জনই বাইরের বা হলের সঙ্গে সংশিষ্ট নয়—বাকী চারশত জন মাত্র হলের ছাত্র। ভিন্ন মহলের অভিমতের সূত্র ধরে সংবাদে প্রকাশ হয়েছে যে, যাদের পরীক্ষা শেষ হয়নি তাদের সবারই একটিমাত্র বিষয়ের পরীক্ষা পড়েছে। বর্তমানে যে দুটি চলছে তার মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে একটি হল যদি খোলা যায় তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে বাকী পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যেতে পারে।
এম, কম ও এম, এস, সি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ভুক্তভোগী ছাত্ররা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তেমনি নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তাদের পড়াশুনার খরচ গার্জিয়ানরা বহু কষ্টে জোগাড় করে থাকে। যে সকল ছাত্র হলে থাকে তাদের গার্জিয়ানদের অবস্থা আরো সঙ্গীন। কেননা হলের খরচ পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক দুরবস্থা নেমে আসায় গোটা শিক্ষাব্যবস্থার উপর তার আঘাত এসেছে। এই আঘাতের দরুন শিক্ষা বিশেষতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অঙ্গনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ গুলোর সংসারে যে দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাতে করে তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রগণ আরো অসম্ভব ব্যাপার। একারণে বার বার যদি একটি পরীক্ষা পিছিয়ে যায় তাহলে ছাত্রদের এবং গার্জিয়ানদের অর্থনৈতিক জীবনে নিদারুণ অবস্থা নেমে আসতে বাধ্য। বিশেষ করে উল্লেখিত বন্ধ হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটি বহুদিন ধরে অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অবিলম্বে বিশেষ কোন ব্যবস্থাধীনে এ পরীক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কতৃপক্ষ ছাত্রদের ও অভিভাবকদের আর্থিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করে পরীক্ষাটি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা আশা করি। সাতটি তরুণ হত্যাকাণ্ডের দরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ দিনের জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে হয়তো বন্ধ করে দেওয়া পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তাতে করে ভূক্তভোগী ছাত্রদের তেমন কোন উপশম হবে না। বরং পরীক্ষার্থী যারা হলের ছাত্র নয় তাদের ঐ সময় আরো অসুবিধা হবে। ছুটির মধ্যে পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা করলে কিয়দংশে তাদের অসুবিধা লাঘব হতে পারতো। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করে একটি সঠিক ও ভুক্তভোগী ছাত্রদের সমব্যথী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাবো।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক