You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.08 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার | বিদ্যুৎ সরবরাহে অচলাবস্থা | স্মরণীয় আটই মে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৮ই মে, বুধবার, ২৪শে বৈশাখ, ১৩৮১

প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার

সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষিতে যদি বিকল্প কোন ব্যবস্থার সন্ধান মেলে তবে তা স্বাভাবিক ভাবে উৎসাহের সঞ্চার করে। আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের কথা আলোচিত হয়ে আসছে বেশ কিছুদিন হয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রার্থী সম্ভাবনা ও তার ব্যবহার পরীক্ষা করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এর সন্ধান মেলে ক’বছর আগে। এছাড়া সিলেটের হরিপুর থেকে উত্তোলিত গ্যাস ফেঞ্চুগঞ্জের কারখানায় সরবরাহ শুরু হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে এ দুটি স্থান ছাড়াও সিলেট, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাসটিলা, চিটাগাং এবং উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরেও প্রাকৃতিক গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিদ্যমান।
দুনিয়ার তাবৎ দেশ যখন তোলো সংকট মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে, অনেকে যখন নিজ নিজ দেশে এর বিকল্প সন্ধানে ব্যস্ত তখন প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদ বাংলাদেশের মানুষের মনে আশার সঞ্চার করবে–এটাই স্বাভাবিক। বছরে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আমাদের মোটা একটা টাকা বেরিয়ে যায়। সে টাকার সবটাই যায় বৈদেশিক মুদ্রায়। এখন যদি প্রাকৃতিক এই সম্পদ আহরণে আমরা সচেষ্ট হই এবং জ্বালানি তেলের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করতে পারি তবে সেই বৈদেশিক মুদ্রায শুধু বেঁচে যাবে না, ওয়াকিবহাল মহলের মতে বরং এ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে। জানা গেছে, মাটির নিচে লুক্কায়িত গ্যাস নাকি চারশ বছর উত্তোলন করা যেতে পারে। এজেপি অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ তার সদ্ব্যবহার একই কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে আমাদের জানা নেই। জানা নেই, গ্যাসের মতো আরো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে কতটুকু উদ্যোগ এবং নিষ্ঠা নিয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারি। সম্পাদক স্বল্পতা প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের প্রতিবন্ধকতা বলে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা বলে আমরা মনে করি না। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে আগ্রহ বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহযোগিতা আমরা গ্রহণ করতে পারি।
একটা অভিযোগ উঠেছে এই গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে। হরিপুর থেকে উত্তোলিত গ্যাস ফেঞ্চুগঞ্জের কলকারখানায় ব্যবহৃত হলেও তিতাস গ্যাস প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে ঘরোয়া কাজে। শিল্প কারখানা এর ব্যবহার এখনও শুরু হয়নি। পরিবহন খাতে গ্যাসের ব্যবহার অবশ্য সময় সাপেক্ষ। আমরা আশা করব বিশ্ব ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সম্ভাব্য সকল স্থানে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান কাজ ত্বরান্বিত করা হবে। এর ব্যবহারেও সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত। আমার একটা মূল্যবান সম্পদের অপচয় রোধ করে উৎপাদন কাজে এর সর্বাধিক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের দৃষ্টি আমরা এদিকে আকর্ষণ করছি ।

বিদ্যুৎ সরবরাহে অচলাবস্থা

সংবাদে প্রকাশ, সাতদিন ধরে সিলেট জেলা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে। গত তিরিশে এপ্রিল যে সকল টাওয়ার ভেঙে গিয়েছিল তা আজও মেরামত করা হয়নি বলে এমন হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন সিলেটে ৩৬টি চা বাগানের সকল কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া শ্রীমঙ্গল পৌর এলাকার বারোটি ও মৌলভীবাজারের ৩৬টি ধান ও আটার কল বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের দরুন জনসাধারণ একদিকে যেমন অন্ধকার রাত কাটাচ্ছে অন্যদিকে ধান ভাঙাতেও সক্ষম হচ্ছে না। সবচেয়ে মারাত্মক হল বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন জেলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সকল অপারেশন ও এক্স-রেও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার পর ভেঙে যাওয়া টাওয়ারগুলো কোন মেরামত হয়নি তার কারণ হিসেবে জানা গেছে যে, বিদ্যুৎ বিভাগের দুই ও চার নম্বর ডিভিশনের আভ্যন্তরীন কোন্দলের ফলেই নাকি এতদিন টাওয়ার মেরামত করা হয়নি। ব্যাটারির সাহায্যে এতদিন শহরের টেলিফোন চালু ছিল কিন্তু দু-একদিনের মধ্যে তাও বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সিলেটের চা বাগানের কারখানা যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা আমাদের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচীর পথে এক নিদারুন বাধার সৃষ্টি করবে। ধান ও গম ভাঙ্গার কল বন্ধ হয়ে গেলে একটি মফস্বল শহরে যে কি পরিমান অসুবিধার সৃষ্টি হয় তাও অনুমান সাপেক্ষ। নাগরিক জীবনে যে কি পরিমান দুর্ভোগ নেমে আসে তাও সবার জানা। গুটিপোকা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে একটি জরুরী কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারতেন। কিন্তু তা করেনি বরং বিদ্যুৎ বিভাগের দুই ও চার নম্বর ডিভিশনের আভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণে টাওয়ার মেরামতের কাজটি পড়ে রয়েছে। কচি পক্ষে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলে কোন ডিভিশন এর আবর্তন কোন্দলের শিকার সিলেট জেলার অধিবাসীদের হতে হতো না। বেশ কয়েকমাস পূর্বে গোয়ালপাড়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রটি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখনও আমরা লক্ষ্য করেছিলাম প্রয়োজনের ফার্নেস তেলের ঘাটতি পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় মতো ব্যবস্থা নেননি। একে অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। ফলে গোটা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিই অচল হয়ে পড়েছিল। ঠিক তেমনিভাবেই আবার নিজেদের কোন্দলের জন্য সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আর সে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এলাকার লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ এবং বহু সংখ্যক কল-কারখানা। আমরা কর্তৃপক্ষের এখানে দায় এড়িয়ে যাবার কৌশল দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। অবিলম্বে একটা ব্যবস্থা নেয়া হোক এটাই সবার কাম্য। টাওয়ার গুলো যাতে দ্রুত মেরামত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তার কার্যকরী ব্যবস্থা আশু গ্রহণ করা উচিত।

স্মরণীয় আটই মে

১৯৪৫ সালের ৮ই মে শুধু জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জনসাধারণের কাছেই একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য দিন নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছেই এ দিনটি গভীর তাৎপর্য সমৃদ্ধ। এ দিনটিতে স্বৈরাচারী হিটলারের সেনাবাহিনী বার্লিনে সেনাবাহিনীর কাছে শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। জার্মানের সাম্রাজ্যবাদী হিটলার এবং তার স্বৈরতান্ত্রিক সৈন্যদল অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে এবং রাজনৈতিকভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সমগ্র ইউরোপে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অত্যাচার-নিপীড়ন অবসানের জন্য দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসে স্বৈরাচারী হিটলার এবং তার অনুগামীদের উপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং হিটলারের সমস্ত অশুভ শক্তিকে শক্ত হাতে দমন করেছিল।
জার্মান ফ্যাসিস্টরা নিষ্ঠুরতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মানবতাকে ধুলায় লাঞ্ছিত করে দিয়েছিল। হিটলারের ফ্যাসিবাদী আক্রমনাত্মক অভিযানে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষকে দিতে হয়েছিল আত্মহুতি। আত্মবিসর্জনকারি এসব মানুষের মধ্যে একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল দুই কোটির বেশি। জিডি আর-এর জনসাধারণ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে। এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন করে সমস্ত অশুভ শক্তিকে করেছে পর্যুদস্ত। জিডিআর সহ জনসাধারণ এখন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদী বিরোধী সংগ্রামে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জনসাধারণ আত্মনিবেদন করে বর্তমানে এক নতুন জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ঘটেছে বিরাট পরিবর্তন। শিক্ষার ক্ষেত্রে ও পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী এবং যোগসাজশ কারীদের কবল থেকে কল কারখানা গুলোকে মুক্ত করে জাতীয়করণ করা হয়েছে। ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম জোরদার হয়ে উঠেছে। বিশ্ব শান্তি এবং জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র জনসাধারণ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় দিক থেকে বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। বিশ্বের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী দেশের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিরাজমান। সোশালিস্ট ইউনিটি পার্টির নেতৃত্বে জিডিআর-এর সমুদয় সমস্যা ও সংকট নিরসন করা সহজতর হয়েছে এবং এতে করে দেশে উন্নয়ন কর্ম ও হচ্ছে ত্বরান্বিত। ১৯৪৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন ও উন্নয়ন সম্ভবপর হয়েছে। এই পর্যন্ত জিডিআর-এর যেসব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তার মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের চিত্র খুবই আশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জিডি আর সব সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উদার সাহায্য পেয়ে আসছে।
বর্তমান বিশ্বে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উন্নত করে দাঁড়িয়ে আছে। বৈদেশিক নীতি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতামূলক নীতির মাধ্যমে জিডি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
-সন্ধানী

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন