বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৬ই মে, সোমবার, ২২শে বৈশাখ, ১৩৮১
কয়লা নেই, তাই–
রেল পরিবহন প্রায় অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, রেলওয়ে গুদামে কয়লা ও অন্যান্য জ্বালানির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এমতাবস্থায় জরুরি তাগাদার ভিত্তিতে জ্বালানি সংগ্রহের ব্যবস্থা না করলে যে কোন দিন থেকে দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সংবাদসূত্রটি আরো জানাচ্ছে, সমগ্রদেশে রেলওয়ের প্রায় তিনশ’টি ইঞ্জিন আছে। এর অর্ধেকেই প্রায় বিকল। বাকিগুলোর অধিকাংশই লোকোমোটিভ ইঞ্জিন। কিছুসংখ্যক ইঞ্জিন মাত্র ফার্নেস তেল ও ডিজেল তেলে চলে। গুদামে এই জ্বালানি তেলের মজুদ ও প্রায় শেষ। যা আছে, তাতে বড়জোর ৫-৬ দিন চলবে। অর্থাৎ তেল চালিত ইঞ্জিন গুলোও অচল হয়ে পড়বে। আমরা জানি স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে দেশের সর্ব প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থাই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই দেশ স্বাধীন হবার পর সরকারকে সম্ভাব্য সকল চেষ্টা বিনিয়োগ করে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করার পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। তখন একই সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ, আকাশপথে যোগাযোগ এবং রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা মোটামুটি সহনীয় অবস্থা আনার জন্য সরকারকে বহুমুখী কার্যসূচি হাতে নিতে হয়েছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবে বহু বাস, যাত্রীবাহী বিমান ও রেল ইঞ্জিনও আমদানি করা হয়েছে। বাকি দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলির উপর। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশে এখনো রেল ইঞ্জিনের জ্বালানি হিসাবে কয়লাই ব্যবহৃত হয়। কল-কারখানা সহ অন্যান্য খাতেও দেশে কয়লার বেশ চাহিদা আছে। সেদিকে দৃষ্টি দেখেই কয়লা আমদানির জন্য সরকার বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পৃথক পৃথক দুটি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র রেল যোগাযোগের জন্য ভালো থেকে চলতি বছরে ১ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা আমদানি করার কথা। এছাড়া অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য উক্ত সময়ের মধ্যে আরও ৫ লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের মাধ্যমে আমদানি করার কথা।
প্রথমোক্ত চুক্তি অনুযায়ী মাসে গড়ে ১০ হাজার টন কয়লা ভারতে থেকে আসার কথা। অর্থাৎ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০ হাজার টন কয়লা বাংলাদেশে এসে পৌছালো উচিত ছিল। কিন্তু তার বদলে ওই চার মাসে রেল গুদামে কয়লা এসেছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার টন।
আরও জানা গেছে রেলওয়ে ন্যূনপক্ষে প্রতিমাসে গড়ে ৮ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন। তাই আমদানীকৃত কয়লার প্রয়োজন। তাই আমদানীকৃত কয়লায় তার চাহিদা মেটার প্রশ্নই আসে না। ফলে রেল কর্তৃপক্ষ কয়লা নিয়ন্ত্রকের কাজ থেকে ঘরে গত চার মাসে প্রায় সাড়ে নয় হাজার টন কয়লা সংগ্রহ করে। হিসেব মতে রেলওয়ে ঘাটতি ছিল প্রায় ৩১ হাজার টন, সেখানে সংগৃহীত হয়েছে মাত্র ১৭ হাজার টন। অর্থাৎ মোট হিসেবে দেখা গেছে যাচ্ছে–রেলওয়ের চার মাসের চাহিদা হল ৪০ হাজার টন কয়লা, সেখানে টানাহ্যাঁচড়া করে সর্বসাকুল্যে সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ১৭ হাজার টনের মতো।
অন্য চুক্তি অনুযায়ী কয়লা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ হাজার টন কয়লা আমদানির কথা। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে গত চার মাসে তারা আমদানি করতে পেরেছে মাত্র ৫০ হাজার টন। অর্থাৎ ঘাটতি থাকছে ১৩০ হাজার টন। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিপুল পরিমান কয়লা ঘাটতি থাকার জন্য তাদের কাছ থেকে কয়লা সংগ্রহ করা রেলওয়ের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না।
উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বোধ হচ্ছে, রেল পরিবহনের এই নাভিশ্বাসের মুহূর্তে যোগাযোগমন্ত্রী বেশ বিচলিত হয়েছেন। গত শুক্রবার দেশের মেয়ে চট্টগ্রামে রেলওয়ের বিভাগের কয়লা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ ব্যাপারে তিনি আলাপ-আলোচনা ও চালান। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত এখনও আমরা জানতে পাইনি।
এরই প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হলো জাতি আজ নানা সমস্যায় জালে জড়িত। সেই কুচক্র জাল ছিন্ন করার সর্বাত্মক তৎপরতাও এখন দেশে চলছে। দূনীতি সহ সকল প্রকার অশুভ প্রচেষ্টাকে দমন করার এই তৎপরতার দিকে জনগণ অনেক আশা নিয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট মহল গুলি যদি নিজের নিজের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, নিপুণতা পরিকল্পনাসহ কাজে লাগাতে পারেন তাহলে বড়ই লজ্জার কথা। তাছাড়া রেল যোগাযোগ শুধুই যে যাতায়াত সমস্যার প্রধান সহায় তা নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য এ পরিবহনের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সর্বোপরি খাদ্য পরিবহন এর অধিকাংশ কাজ রেলওয়ের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আমাদের আবেদন আশু তৎপরতার ভিত্তিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে চালু রাখার প্রচেষ্টা নিয়ে যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও খাদ্য পরিবহন এর কাজকে অব্যাহত রাখা হোক। নইলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।
নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন
দেশের হাজারো সমস্যার মধ্যে কোনটির সমধান ‘আশু’ বলে সরকার মনে করেন আর কোনটি সমাধানে সময় নিয়ে অগ্ৰসর হবার কথা তারা ভাবছেন তা তারাই জানেন। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে যা জনসাধারণের চোখে ধরা পড়ছে তাহলো কোন সমস্যারই আজ পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধানের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে না। বরং দিনের পর দিন তা বাড়ছেই; বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। গত পরশু ঢাকা কলেজে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতা করতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেছেন, ‘দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করাই সরকারের লক্ষ্য।’ এর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যে দেশের শতকরা ৯০ জন অধিবাসী নিরক্ষর সে দেশ অগ্ৰগতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার আশা করতে পারে না।’
স্বাধীনতা লাভের ২৭ মাস পর এবং দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন এর প্রায় ১৪ মাস পর যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যাপারটা সরকারের আশু লক্ষ্য বলে আজও বিবেচিত হচ্ছে তাতে আমরা উৎসাহিত বোধ করছি। রাতারাতি তা সম্ভব নয় এটা ধরে নিয়েও এমন করে মহৎ কাজ শুরুর কোন আলামত যদি আমরা দেখতে পেতাম তবে আরো বেশি উৎসাহিত হতাম; বিশ্বাসটা তাহলে আরো দৃঢ় হতো যে সরকার আসলে নিরক্ষরতা দূরীকরণকে ‘আশু’ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন।
শুধু একটা উপনিবেশিক শাসনের নয় বরং পুরনো সমাজ ব্যবস্থার শোষণ শৃংখল থেকে মুক্তি লাভের লক্ষ্যকে সামনে রেখে যে বিপ্লবের সূচনা হয় তার প্রাথমিক বিজয় ভিত্তিকে মজবুত করা তথা তার চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার প্রাথমিক শর্তই হলো তাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। ইতিহাসে তাই সাফল্যজনকভাবে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য জনগণের মধ্যে থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ আশু লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশেও শুধু ভাষণে নয় কার্যক্ষেত্রে তেমন কোনো কর্মসূচি গৃহীত হবে আমার আশা আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী কাল থেকেই আমরা করে এসেছি। সভ্যতার আলো থেকে বিচ্ছিন্ন কোটি কোটি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসায় নেতৃবৃন্দ ব্রতী হবেন –এটা আমরা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু হয়নি। যেমন নেয়া হয়নি নিরক্ষরতা দূরীকরণের কোনো কর্মসূচি তেমনি হয়নি যে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় জীবনের প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম বলে শিক্ষা মন্ত্রলয় করেছেন সে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো পদক্ষেপ। আমরা তবু আশা ছাড়িনি। নেতা-মন্ত্রীরা আজ যা বলছেন তা সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়নের তাগাদা একদিন তারা অনুভব করবেন। শিক্ষা মন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দেশের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং জনসাধারণের মধ্যে থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ। সেই প্রয়োজনকে সামনে রেখে মন্ত্রীমহোদয় তার নিজের বলা কাজগুলো সম্পাদনের দায়িত্ব তিনি নিজেই নেবেন-এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক