You dont have javascript enabled! Please enable it!

এ বছর জাতীয় আয় ১০ ভাগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা

১৯৭৫-৭৬ সালে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর মােট জাতীয় আয় শতকরা ১০ ভাগ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় মােট ৯৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রাকৃতিক সম্পদ, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি গবেষণা খাতে ১৫১ কোটি টাকা, শিল্পে ১৩৯ কোটি টাকা, বন্যানিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ ১৩৬ কোটি, ১১৫ কোটি টাকা, পরিবহন ১২৩ কোটি টাকা, যােগাযােগ ৩৪ কোটি টাকা পূর্ত গৃহনির্মাণ এবং পর্যটন ৬৬ কোটি টাকা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ৪৫ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ৩৩ কোটি জনসংখ্যা পরিকল্পনা ২৫ কোটি টাকা, ঘূর্ণিঝড় পুনর্গঠন সাড়ে ২৮ কোটি টাকা সমাজকল্যাণ ৪ কোটি, জনশক্তি ও শ্রম বিনিয়ােগ ৩ কোটি টাকা ইত্যাদি প্রধান।
মঙ্গলবার পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃপক্ষ ১৯৭৫-৭৬ সালের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার উপর প্রকাশিত এক পুস্তিকায় এ তথ্য পরিবেশন করা হয়। পরিকল্পনা যথাশীঘ্র যাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং ক্রমবর্ধমান খাদ্য আমদানী হ্রাস করার প্রচেষ্টাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বছর খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২৮ দশমিক ৬০ লাখ টন। এটা হচ্ছে ১৯৭৪-৭৫ সালের উৎপাদিত খাদ্যশস্য অপেক্ষা ১৩ দশমিক ২৮ লাখ টন বা শতকরা ১১ ভাগ বেশি। এছাড়া অতিরিক্ত খাদ্যশস্যর মধ্যে আছে ১২ দশমিক ৮২ লাখ টন চাল ও ১ লাখ টন গম।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭৫-৭৬ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন শতকরা ১১ ভাগ, সামগ্রিক কৃষিখাতে শতকরা ৮ ভাগ, শিল্পখাতে শতকরা ১২-১৫ ভাগ, যানবাহন এবং ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে শতকরা ১২-১৫ ভাগ হারে উৎপাদন বৃদ্ধির হিসেবে মােট জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার শতকরা ১০ ভাগ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
তৃতীয় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বরাদ্দকৃত ৯৫০ কোটি টাকা পূর্বমূল্যে ৭৫০ কোটি টাকার সমান। এই পরিমাণ হচ্ছে আগের বছরের চাইতে শতকরা ৪৩ ভাগ বেশি। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ হতে ২৫০ কোটি এবং বৈদেশিক সূত্রে ৭০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
পরিকল্পনা কমিশনের মতে তৃতীয় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্য হবে: বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অনুকূলে সাড়া জাগানাে এবং উন্নয়ন উদ্দেশ্যকে অর্থনৈতিক স্থিতিকরণ কর্মসূচির উদ্দেশ্যাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তােলা। তারা বলেন: বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রয়ােজন অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুসংহত এবং মুদ্রাস্ফীতি প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ব্যাপক নীতিমালা নির্ধারণ করা দরকার।
পরিকল্পনায় খাদ্যজাত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচ কর্মসূচি, সার বীজ কীটনাশক দ্রব্য ইত্যাদি উপকরণ সরবরাহ শুধু নয় সেই সাথে এ জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়ােজিত সংস্থাসমূহেরও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
১৯৭৫-৭৬ সালে যে মােট খাদ্য শস্য উৎপাদন ১২৮ লাখ ৬৫ হাজার টন ধার্য করা হয়েছে এ বছর আরাে অতিরিক্ত ৩ লাখের উপর একর জমি বন্যামুক্ত হবে বলে আশা করা হয়। একই সময় ৪০ হাজার লাে লিফট পাম্প পানি সেচের জন্য ও ২ হাজার গভীর নলকূপও এ বছর কার্যকরী হবে। এছাড়া বিভিন্ন সেচ প্রকল্পের সাহায্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার একর নতুন জমি পানি সেচ ব্যবস্থার অধীনে আনা হবে। এ জমিগুলি অধিক উৎপাদনশীল ধান চাষের জন্য ব্যবহার হবে।
কৃষি উপকরণের মধ্যে সার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কৃষি উৎপাদনের দিক লক্ষ্য রেখে এ বছর ৬ লাখ টন রাসায়নিক সার কৃষকদের মধ্যে বিতরণের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে ২ লাখ টন সার আমদানী করা হবে। এছাড়া চলতি বছর ৮০ হাজার মন অধিক ফলনশীল আমন ধানের বীজ ৫০ হাজার মন অধিক ফলনশীল বােরাে ধানের বীজ ও ৫০ হাজার মন অধিক ফলনশীল আউশ ধানের বীজ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
বহুমুখী কৃষক সমবায়
১৯৭৫-৭৬ সালে উন্নয়ন কর্মসূচির একটি উল্লেখযােগ্য দিক হচ্ছে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কৃষক সমবায় গড়ে তােলা। এ বছর সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে মােট ২৫০টি থানা অন্তর্ভুক্ত হবে। এছাড়াও কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে সমন্বিত উন্নয়নের কাজ চলবে।
বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষিসহ পল্লী উন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করায় এখানে মােট বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে সামগ্রিক বরাদ্দের মােট ৩১ ভাগ বা ২৯৯ কোটি টাকা। এ বছর শিল্প উন্নয়নের দুটি দিক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার এবং একটি সুস্থ ও সুষম শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তােলা।
১৯৭৫-৭৬ সালে বিদেশী সাহায্যের ও আন্তর্জাতিক খাদ্য বাজারে যে উন্নতি লক্ষ্য করা যায় তা থেকে আশা করা যায় যে এ বছর শিল্প ব্যবহৃত কাচামালের যােগান অধিক পরিমাণে সম্ভব হবে। ফলে, শিল্পের স্বাভাবিক উৎপাদন ও বাড়বে। বাংলাদেশ অতীতে যেসব শিল্প গড়ে উঠেছিলাে, তা অনেক ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীন।
এটা যে শুধু মূল ও ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য তা নয়, হাল্কা শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। এদিকে লক্ষ্য রেখেই ৭৫-৭৬ সালের শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর আশুগঞ্জে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সার কারখানাটি স্থাপনের কাজ ত্বরান্বিত করা হবে।
এ সার কারখানা তৈরি হলে উৎপাদন আরও চার লাখ আশি হাজার টন ইউরিয়া সার বেড়ে দাড়াবে মােট নয় লাখ ত্রিশ হাজার টনে। দেশে গ্যাস সম্পদসহ শিল্পায়নের বুনিয়াদকে দৃঢ়তর করার লক্ষ্য সামনে রেখে ভারী শিল্পক্ষেত্রে চলতি প্রকল্পগুলাে বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে। এর মধ্যে ভারী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরির জন্যে জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্রকল্প, চট্টগ্রামে ড্রাইডক, ভারী ইস্পাত প্রকল্প ও জয়দেবপুর মেশিন টুলস প্রকল্প প্রধান। কর্মসূচিতে আটটি সুতাকল ছাড়া ভােজ্য তেল, চিনি, রুটি, পানীয়, বিস্কুট ইত্যাদির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ান হবে।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লােকই নিরক্ষর। তাই দেশ হতে নিরক্ষরতা দূর করার উদ্দেশ্যে দেড় হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ সমাপ্ত ও আরও দেড় হাজার নতুন বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। একই সাথে ছয়শ ষােলটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, পঁচিশটি বেসরকারী বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও কৃষিবিদ্যা শেখানাের ব্যবস্থা করা হবে।
চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে তিনশ প্যারা মেডিক্যাল কর্মী তৈরি ও ৮০টি পল্লী ভিত্তিক সমন্বিত থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজ শেষ করা হবে। উপরন্তু ২০টি থানায় ৬০টি স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র খােলার ও ব্যবস্থা করা হবে। এ কার্যক্রমের সমর্থনে সেবিকাদের ৭টি নতুন ট্রেনিং স্কুল, প্যারামেডিক্যাল কর্মীর জন্যে ২টি ও মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্টদের জন্যে ৪টি নতুন স্কুল স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হবে। চলতি অর্থ বছরে পরিবার পরিকল্পনার সে কর্মসূচি নেয়া হয়েছে তার ফলে তিন লাখ শিশুর জন্মনিরােধ ও ক্রমহার কিছু হ্রাস করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৬ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!