You dont have javascript enabled! Please enable it!

মঙ্গলবার সংসদে বাজেট আলােচনার পূর্ণ বিবরণ

গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলােচনার কিছু অংশ গতকালের দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। বাকি অংশ নীচে দেওয়া হলাে:
বাজেটের ওপর আলােচনা করতে গিয়ে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা প্রধানত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি খাতে ব্যয় বরাদ্দের ওপর আলােকপাত করেন। তাঁরা এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন যে বাজেটে শােষণমুক্ত নয়া সমাজ গড়ে তুলে জাতিকে সুখী ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের সুদৃঢ় সংকল্পই প্রতিফলিত হয়েছে।
তারা বলেন, বিদায়ী বছরের তুলনায় উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ দ্বিগুণ এবং কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নয়া বাজেটকে অতীতের বাজেট থেকে পৃথক বলে অভিহিত করে তারা বলেন, এতে নয়া কোন কর আরােপ করা হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রে কর হ্রাস করা হয়েছে। এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে কর তুলে দেওয়া হয়েছে।
সংসদ সদস্যরা বলেন, উন্নয়নমুখী বাজেটে সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সরকারের সংকল্পের কথাই ব্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে সূচিত হলাে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় বিপ্লব। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পীকার আবদুল মালেক উকিল। আছর ও মাগরেব নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে সভাপতিত্ব করেন ডেপুটি স্পীকার জনাব মােহাম্মদ বায়তুল্লাহ।
বাজেটের ওপর সাধারণ আলােচনায় অংশ নিয়ে ডা: মেসবাহুল হক (রাজশাহী) বলেন, এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সােনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রযাত্রা শুরু হলাে। ২৫০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের জন্য তিনি অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান।
ডা: মেসবাহুল হক বলেন, নয়া আমদানী ও রফতানী নীতিতে ৫২০ কোটি টাকা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। এ অর্থ আমাদের জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। রাজশাহীর জনাব আশরাফুল ইসলাম বাজেটকে অভিনন্দিত করে বলেন, এতে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কৃষকদের মধ্যে কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহের কান্ডে সমন্বয় সাধনের আহ্বান জানান। তিনি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও শিক্ষা বিষয়েও বক্তব্য রাখেন।
রাজশাহীর জনাব আবদুল জলিল উন্নয়নমুখী বাজেটের জন্য অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। তিনি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবকে সফল করে তুলতে জনগণের কঠোর পরিশ্রমের প্রয়ােজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি দেশের উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন কাজ সম্পর্কে বলেন, সেখানে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সেচের সুযােগ সুবিধা সম্প্রসারণের প্রয়ােজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি জনাব আশরাফুল ইসলামের উত্থাপিত চরণবিল প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবী সমর্থন করেন।
মিসেস ফরিদা রহমান বিপুল অংকের উন্নয়ন কর্মসূচিসহ উন্নয়নমুখী বাজেট পেশ করায় অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দিত করেন। এতে করে মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। মিসেস রহমান বলেন, নতুন বাজেটে কোন করের প্রস্তাব নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে কর মওকুব করা হচ্ছে। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের পটভূমিতেই এবং নয়া বাজেট প্রণীত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ওষুধপত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করাই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, একশাে টাকার নােট অচল ঘােষণা দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আনয়নে সাহায্য করেছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম স্থিতিশীল করতে সক্রিয় পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত সদস্য বায়ু সন্তোষ কুমার বিশ্বাস বাজেট প্রসঙ্গ আলােচনায় বলেন, উন্নয়নের প্রয়ােজনীয়তা ও জনগণের কল্যাণের দিকটি সামনে রেখেই বাজেট তৈরি করা হয়েছে। তিনি সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের প্রয়ােজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন।
তিনি দৃঢ়তার সাথেই বলেন বাজেটে উল্লিখিত সাতশাে কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্য অবশ্যই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছে এটা তারই ফলশ্রুতি। জনাব মােহাম্মদ হানিফ হুইপ (ঢাকা) বাজেটকে অভিনন্দিত করে বলেন, বাজেটের প্রধান বেশিষ্ট্য হচ্ছে এতে কোন নতুন কর আরােপ করা হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে কর হ্রাস করা হয়েছে, এরা ক্ষেত্রবিশেষে তুলে নেওয়া হয়েছে।
মাননীয় সদ্য রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও নাগরিক সুযােগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ঢাকা পৌরসভার জন্য অধিকতর অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানান। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর অবিলম্বে সেতু নির্মাণের দাবী করেন। জনাব মােহাম্মদ হানিফ আরও বলেন, কৃষি খাতে বেশি করে অর্থ বরাদ্দ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর ঈপ্সিত লক্ষ্য পূরণ হবে।
ডা: আসাবুল হক (কুষ্টিয়া) বাজেটকে অভিনন্দিত করে এটাকে বাস্তবধর্মী বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতেই পল্লী অঞ্চলের বিদ্যমান অবস্থার দিকটি সামনে রেখে বাস্তবভিত্তিক পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও জীবন বিমা কর্পোরেশন আরও দক্ষতার সাথে কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। এর আগে আইনমন্ত্রী শ্ৰীম মনােরঞ্জন ধর সংসদে ১২টি বিল পেশ করেন। বিলগুলাে হচ্ছে: রাষ্ট্রপতির বেতন ও সুযােগ সুবিধা বিল, উপরাষ্ট্রপতির বেতন ও সুযােগ সুবিধা বিল, প্রধানমন্ত্রীর বেতন ও সুযােগ সুবিধা বিল, স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের বেতন ও ভাতা (সংশােধনী) বিল, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও ডেপুটি মন্ত্রীর বেতন ও সুযােগ সুবিধা (সংশােধনী) বিল, বাংলাদেশ আইনজীবী ও বার কাউন্সিল (সংশােধনী) বিল বাংলাদেশ আইন (সংশােধনী) বিল কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল (এডিশনাল) কর্তব্যরত (সংশােধনী) বিল, এসাে প্রতিষ্ঠন হুকুম দখল বিল ও ইসলামি ফাউন্ডেশন বিল। ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী তার ক্ষীতিশ চন্দ্র বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ইকট প্রপারটি বিলও সংসদে পেশ করেন।”
মিলে এবার রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন: স্বাধীনতার পর এবার খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে সর্বাধিক উৎপাদন হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে এই মিল ৩২ হাজার ৭শ টন। নিউজপ্রিন্ট উৎপাদন করেছে। অপরদিকে ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরে এতে উৎপাদন হয়েছে ২৮ হাজার টন ও ১৯৭১-৭২ এ আরাে কম। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪-৭৫ এর উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ।
মিলের শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্তৃপক্ষের উদ্দীপনাপূর্ণ প্রচেষ্টার ফলেই এই উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। তারা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে টিম স্পিরিট নিয়ে কাজ করেন। মিল আরাে বেশি উৎপাদনে সক্ষম হত কিন্তু গােয়ালপাড়া বিদ্যুৎ স্টেশনের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
যান্ত্রিক গােলযােগের জন্য খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ৩নং মিলে বিদ্যুৎ সরবরাহের একমাত্র উৎস গােয়ালপাড়ার ৬০ মেগাওয়াট হিসেবে স্টেশন ২ শে মে থেকে বন্ধ থাকায় ৩নং মিলটিও ঐ তারিখ থেকে অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মিলে ১৯ হাজার টন নিউজপ্রিন্ট মওজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার টন মওজুদ রয়েছে মিলের খুলনা গুদামে ও ৫ হাজার টন ঢাকা গুদামে।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ৩ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!