You dont have javascript enabled! Please enable it!

দেশে এ বছরও ২৪ লাখ লােক বাড়ছে

বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার সাথে চলতি বছর প্রায় ২৩ লাখ ৭০ হাজার বাড়তি লােক যুক্ত হবে। এই বাড়তি জনসংখ্যার জন্যে বাংলাদেশকে ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য, ৩ লাখ। বাসগৃহ, নতুন ৭ লাখ ৫০ হাজার চাকুরী, ১ লাখ ২০ হাজার বিদ্যালয় এবং ৭০ হাজার শিক্ষক যােগান দিতে হবে। এ তথ্য জানা গেছে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা বাের্ড থেকে।
প্রতি মিনিটে আমাদের দেশে ৭টি শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে। এই হিসেবে বছরে জন্মগ্রহণ করে ৩৭ লাখ শিশু। মােটামুটিভাবে বাংলাদেশের বার্ষিক জন্মসংখ্যা ৩৭ লাখ, মৃত্যুর সংখ্যা ১৩ লাখ ৩ হাজার। অর্থাৎ সাম্প্রতিককালে প্রতি বছরই ২৩ লাখ ৭০ হাজার লােক বর্তমান জনসংখ্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হচ্ছে শতকরা ৩জন।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখেছেন-১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র এক কোটি। এই সংখ্যায় উন্নীত হতে সময় লেগেছিল কোটি কোটি বছর। তারপর ২১০ বছর পরে-১৮৬০ খৃস্টাব্দে দেখা গেল বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটিতে। তার পরবর্তী ৮০ বছরে অর্থাৎ ১৯৪০ খৃস্টাব্দে সে সংখ্যা পুনরায় দ্বিগুণ হয়ে দাড়ালাে ৪ কোটিতে। পুনরায় ১৯৪০ থেকে ১০৭৪ খৃস্টাব্দের ভেতরে, অর্থাৎ ৪০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে লােকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে বর্তমানে ৭ কোটি ৮০ লাখে উন্নীত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এইরকম স্বাভাবিক নিয়মে বর্তমান হারে লােকসংখ্যা যদি বাড়তেই থাকে তবে মাত্র আগামী ২৩ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ কোটি ৬ লাখে।
আয়তনের দিক থেকে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের মােট ভূখন্ডের ৩০ হাজার ভাগের মাত্র ১ ভাগ। অথচ জনসংখ্যার এদেশ বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম দেশ। জ্যামিতিক হারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির স্থবির হয়ে যাবে। জনগণের জীবনযাত্রার মান হবে মানবেতর পর্যায়ের। জাতির সুস্থ ও সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সম্পদ সীমিত। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য জীবনের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণ করা দুরূহ হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিকল্পিত জনসংখ্যা যে কোন দেশ ও সমাজের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ। আবার জনসংখ্যা পরিকল্পিত ও সীমিত না হলে সেই জনসংখ্যাই দেশের অগ্রগতি ও প্রগতির পথে অন্তরায়।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের জনসংখ্যাও সম্ভাবনাপূর্ণ সম্পদে পরিণত হতে পারে, যদি এই সম্পদ সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ও পরিকল্পনার আওতায় আনা যায়। এজন্যে দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, সচেতন করে তুলতে হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের সীমিত সম্পদ, ভূমি, চিকিৎসা, শিক্ষা, চিত্তবিনােদন, খাদ্য উৎপাদন প্রত্যেকটি মৌলিক চাহিদা ও প্রয়ােজনীয়তার ওপরই চাপ পড়ছে। দেখা গেছে। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭৪ সালে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ যথাক্রমে ৯৪ লাখ টন থেকে বেড়ে ১ কোটি ২৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু মাথাপিছু খাদ্যপ্রাপ্তির পরিমাণ দৈনিক সাড়ে ৭ ছটাক থেকে নেমে ৭ ছটাকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ খাদ্যের উৎপাদন এই কয়েক বছরে যে হারে বেড়েছে তার তুলনায় জনসংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উৎপাদন বৃদ্ধির সমতা নেই বলেই সরকারকে প্রতি বছর ২৩ লাখ ৭০ হাজার বাড়তি লােকের হিসেবে আনুমানিক ৬৪ কোটি টাকা মূল্যের খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়।
সাম্প্রতিক এক হিসেবে জানা গেছে: বর্তমানে প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নযােগ্য বয়ঃসীমার অন্তর্বুক্ত। এই সব ছেলেমেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হলে বর্তমানের দ্বিগুণসংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। উল্লেখ্য দেশে বর্তমানে ৩৬ হাজার ৫শ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৭ হাজার ৭শ লাখ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৮ লাখ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলােতে পড়াশুনা করছে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৭৫ লাখেরও বেশি লােক হয় বেকার নতুবা আধা বেকার। আবার প্রতি বছর ৭ লাখ লােক শ্রম বিনিয়ােগের বয়সপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই বিপুল জনশক্তির কর্মসংস্থানের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশের বিপুলসংখ্যক বেকার মানুষকে বিনিয়ােগ করতে হলে দেশে শিল্প, কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়িয়ে শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হতে হবে।
বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে যেভাবে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে তার মােকাবিলার জন্য প্রত্যেকটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে। প্রত্যেকটি নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নত, স্বচ্ছল, সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে না তােলা পর্যন্ত সবাইকে একযােগে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তার জন্যে প্রয়ােজন জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তােলা। শুধুমাত্র জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপকরণ সরবরাহ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না সাথে সাথে প্রত্যেকটি মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। নইলে এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাই হবে দেশের অগ্রগতি ও প্রগতির পথে অন্তরায়। জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও কল্যাণমুখী করে তােলার জন্যে জীবনের মৌলিক প্রয়ােজনগুলি সবাইর কাছে পৌছিয়ে দিতে হবে। আমাদের সম্পদ সীমিত তাই জনসংখ্যাও সীমিত হওয়া একান্ত প্রয়ােজন।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ৩ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!