গুপ্তঘাতকদের জীবিত বা মৃত পাকড়াও করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে
সংসদের নেতা প্রধানমন্ত্রী জনাব এম. মনসুর আলী গুপ্তহত্যায় নিয়ােজিত ব্যক্তিদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া জানান যে, যাহারা আত্মসমর্পণ করিবে না সেই সব গুপ্তঘাতকদের আটক করার জন্য তিনি ইতিমধ্যেই নির্দেশ জারি করিয়াছেন।
‘এনা’ ও ‘বাসস জানান, গতকাল (সােমবার) জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের উদ্বোধনী দিবসে শােক প্রস্তাবের উপর বক্তৃতাদানকালে তিনি বলেন যে, যাহারা আত্মসমর্পণ করিবে না, তাহাদের জীবিত বা মৃত ধরার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী আততায়ীর গুলীতে নিহত নেত্রকোনা হইতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জনাব আবদুল খালেক সম্পর্কে জনাব মনসুর আলী বলেন যে, জনাব খালেক ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী কর্মী ও সক্রিয় মুক্তিযােদ্ধা এবং তাহার এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে তিনি মর্মাহত হইয়াছেন। তিনি বলেন যে, মরহুম খালেকের হত্যাকাণ্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। এই সংসদের পাঁচজন সদস্যসহ অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাইয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত গুপ্তঘাতকরা মূলত: ভীত প্রকৃতির। তাহাদিগকে দেশের শত্রু হিসাবে আখ্যায়িত করিয়া তিনি বলেন যে, গুপ্তঘাতকদের উদ্দেশ্য হইল জাতীয় সম্পদের ধ্বংস সাধন ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি করিয়া জনগণের মনােবলকে ভাঙ্গিয়া দেওয়া। তাহারা সরকার গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচীর পথে বাধা সৃষ্টি করিতেছে।
জনাব মনসুর আলী বলেন যে, এই ধরনের লােক বর্তমানে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছে যে, হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের ন্যায় ঘৃণা কার্যকলাপে তাহাদের উদ্দেশ্য সফল হইবে না। ফলে অনেকের মনেই শুভবুদ্ধির উদয় হইয়াছে এবং তাহারা শুধু অস্ত্র সমর্পণই করে নাই বরং বঙ্গবন্ধুর নিকট করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছে। তিনি বলেন যে, বঙ্গবন্ধুও তাহাদের ক্ষমা করিয়াছেন।
যাহারা এখনও গুপ্তহত্যায় জড়িত সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় দলের নেতা জনাব মনসুর আলী দৃঢ়আশা প্রকাশ করেন যে, তাহাদের শুভবুদ্ধির উদয় হইবে। অন্যথায় তাহাদিগকে মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হইতে হইবে বলিয়া তিনি সতর্ক করিয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এই ধরনের লােকদিগকে তাহাদের গােপন আস্তানা হইতে জীবিত বা মৃত ধরার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়াছেন।
জনাব মনসুর আলী মরহুম খালেকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া বলেন যে, ১৯৫২ সাল হইতে তিনি জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সহিত জড়িত ছিলেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ডাকে অংশগ্রহণ করেন। মরহুম শিক্ষাবিদ ছিলেন এবং দেশে শিক্ষা বিস্তারের কাজে নিজেকে নিয়ােজিত করিয়াছিলেন।
মরহুম খালেকের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাঁহার পরিবারবর্গের আর্থিক দুর্দশার কথা উল্লেখ করিয়া জনাব মনসুর আলী বলেন যে, মরহুম তাহার পরিবারবর্গের ভরণ-পােষণের জন্য প্রকৃতপক্ষে কিছুই রাখিয়া যান নাই। তিনি বলেন যে, পরিবারের আর্থিক অবস্থা এত শােচনীয় ছিল যে, জনাব খালেকের মৃত্যুর পর পরই বঙ্গবন্ধুকে কিন্তু আর্থিক সহায়তা দান করিতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, চট্টগ্রামের মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর পরিবারও অনুরূপ আর্থিক অবস্থার সম্মুখীন হন এবং ইহাই জাতীয় দলের সদস্যদের আর্থিক অবস্থার কিন্তু নিদর্শন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দুঃখের সহিত লক্ষ্য করিয়াছেন যে, দলীয় নেতা ও কর্মীদের শােচনীয় আর্থিক অবস্থা সত্ত্বেও একশ্রেণীর লােক তাহাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাইয়াছে। তিনি বলেন, উহারা সমাজের কোন উপকার করিতেছে না এবং একদিন নিজেরাই ধ্বংস হইয়া যাইবে।
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের উপর আনীত শােক প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, মরহুম অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সাহস ও দেশপ্রেমের অধিকারী ছিলেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক নির্যাতনের সময় বঙ্গবন্ধুর পিতা বহু সংঙ্কটের মধ্য দিয়া দিন অতিবাহিত করেন, কিন্তু অনন্য সাহস ও দৃঢ়চিন্তার জন্য মরহুম শেখ লুৎফুর রহমান কোনদিন বিশ্বাস হারান নাই।
জনাব মনসুর আলী যশােরের সাবেক এম.সি এ. জনাব ইকবাল আনােয়ারুল ইসলামের মৃত্যুতে শােক প্রকাশ করেন। জনাব ইসলাম দীর্ঘ রােগভােগের পর গত ৪ঠা মার্চ ৫৩ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
প্রধানমন্ত্রী জনাব খালেক, শেখ লুৎফর রহমান ও জনাব আনােয়ারুল ইসলামের শােকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
সংসদের নেতা স্বীকার কর্তৃক আনীত সৌদী আরবের পরলােকগত বাদশাহ ফয়সল, ভারতের ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ও জাপানের মি: ইসাকু সাতাের উপর শােক প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং তাঁহাদের আত্মার শান্তি কামনা ও শােকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ জুন ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত