যথার্থ গণমুখী সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলুন: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী জনাব মুনসুর আলী বলেছেন, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী আজ আর কোনাে নিছক শ্লোগান নয়। সরকার এটাকে জাতির ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি হতাশার শেষ চিহ্ন মুছে ফেলে সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচীতে আত্মনিয়ােগ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের যে ডাক দিয়েছেন, তার প্রধান বক্তব্যই হলাে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এবং এর মাধ্যমে নিজেদের একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে রূপান্তরিত করা।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী কর্তৃক আয়ােজিত ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবে আই, আর ডি, পি’র ভূমিকা’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী এক সেমিনারে উদ্বোধনী ভাষণ দিচ্ছিলেন। সমবায় স্থানীয় প্রশাসন ও পল্লী উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী শ্রী ফনী মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জনাব আবদুল মােমিন তালুকদারও ভাষণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি। কিন্তু এখনও গ্রাম-বাংলার সাধারণ দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি হয়নি। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই অর্থনৈতিক মুক্তিসাধন সময়সাপেক্ষ এবং দুরূহ। তবুও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সরকার একটির পর একটি বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করে এই লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাস্তব কর্মপন্থা …গ্রহণ করবেন।
তিনি বলেন, দেশের শতকরা প্রায় ১০ জন মানুষই গ্রামে বাস করে। আর কৃষিনির্ভর এসব লােকই আমাদের অর্থনীতিরে মেরুদণ্ড। পল্লীর অর্থনৈতিক কাঠামাের বুনিয়াধকে দৃঢ়ভিত্তিক করে গড়ে তুলতে হবে। তা করা না হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি কোন মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এ শুধু আমাদের দেশের বেলাতেই নয় সারা বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলাের জন্যও প্রযােজ্য। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এই সর্বসাধারণ ও দুঃখী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানাের জন্য সরকার এবং দেশের সকল সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে হবে। সে জন্যই সরকার দেশের গ্রামে বসবাসকারী ৯০ শতাংশ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সাধনে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর উপর সব চাইতে গুরুত্ব আরােপ করেছেন। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কঠোর পরিশ্রম করে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রাম বাংলায় সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়ন করতে হবে।
পল্লী উন্নয়নের প্রধান মাধ্যমেই হলাে সমবায়। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশে গড়ে ওঠা সমবায় সমিতিগুলাের অধিকাংশগুলিতে সাধারণ লােভের কোনাে মান না থাকায় ঐগুলাে ইঙ্গিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে নাই। …বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বান সমবায়ের উপরই গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। তাঁর এই আহ্বান বঞ্চিত, অসহায় মানুষের জন্য এক নতুন আলােকদিশারী। তিনি বলেছেন, ‘অতীতের ঘুনেধরা সমবায় ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে একটি সত্যিকার গণমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নতুন সমবায় ব্যবস্থায় ভূমিহীন ও অল্প জমির মালিকদের সমিতিভুক্ত করে এতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের সুযােগ দিতে হবে। এভাবে তাদের মধ্যে এক নতুন চেতনা গড়ে তুলতে হবে। এমনি করে তাদের মন থেকে হতাশা ও বিভ্রান্তি শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে সকলকে সামাজিক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও কর্মসূচীতে নিয়ােজিত। করতে হবে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
ইতােমধ্যে সমবায় সমিতি গঠিত হয়েছে প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকার। এর মধ্যে সঞ্চয় আমানত রয়েছে প্রায় সােয়া কোটি টাকা। এ সময়ে সমবায়ী কৃষকদের মধ্যে ঋণ দান করা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি ৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা এবং কর্জ আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। খেলাপী কর্জের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, পল্লীর সাধারণ মানুষের জন্য উন্নয়নই যেখানে সরকারের কাম্য, সেখানে এক শ্রেণীর লােভী ও কায়েমী স্বার্থবাদী লােক সরকারের সেই গুদামকে বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। সমবায় সমিতিগুলিতে প্রদত্ত বিভিন্ন সুযােগ-সুবিধা অবস্থাপন্ন প্রভাবশালী সদস্যরাই ঠিকভাবেই সময়মতাে ঋণের অর্থ পরিশােধ করেছেন এবং বিত্তবানরা খেলাপী বলে চিহ্নিত হচ্ছেন।
তিনি বর্তমান ঘুণেধরা সমবায় আইনে প্রগতিশীল সমবায় কাঠামাে গঠন সম্ভব নয় বলে সমবায়কে আরও গতিশীল করার জন্যে সরকার নতুন সমবায় আইন প্রণয়নের কথা চিন্তা করছেন। এবং সমবায় সমিতিগুলাে থেকে লােভী ও সমাজ বিরােধীদেরও উৎখাত করা হবে বলে জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দুটি বাণী গড়ে শােনান আই, আর, ডি, পির মহা পরিচালক জনাব আবদুর রহমান।
আবদুল মােমেন তালুকদার: অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির ভাষণদানকালে সমবায় প্রতিমন্ত্রী জনাব আব্দুল হােসেন তালুকদার বলেন, সরকার সমবায় পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে দেশে প্রতিটি গ্রামকে উন্নয়নশীল ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলবেন। তিনি বলেন, সমবায় পদ্ধতিতে জমির মালিকানা খারিজ হবে না। বিদেশী সাহায্য প্রদানকারী সংস্থানসমূহ বাংলাদেশের এই গ্রামভিত্তিক সমবায় পদ্ধতির প্রশংসা করেছেন। কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যে তারা সকল প্রকার সহযােগিতা প্রদান করার আশ্বাসও দিয়েছেন।[১৪৩]
প্রথম অধিবেশন: বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শুরু মূল সেমিনারে প্রথম অধিবেশন এতে ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর বাস্তবায়নে সােনালী ব্যাংকের ভূমিকা এই পর্যায়ে আলােচনা করেন সােনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জনাব কে, এম, রশিদ। তাছাড়া বহুমুখী গ্রামভিত্তিক সমবায় কর্মসূচীর রূপায়ন’ এ পর্যায়ে আলােচনা করেন জনাব এম নুরুল হক।
জনাব কে, এম রশীদ বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য কৃষি প্রধান দেশ যেমন ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশসমূহে কৃষিঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যােগান দেওয়া হয়। অতএব বাংলাদেশেও উপরােক্ত দেশেগুলাের মতাে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলাে নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে না পারার সংগত কোনাে কারণ থাকতে পারে না। তিনি আরাে বলেছেন, সােনালী ব্যাংক ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫১টি থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির অধীন প্রাথমিক সমিতিগুলােকে রােপা আমন ফসল উৎপাদনের জন্যে ৫৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ঋণ মঞ্জুর করে এবং একই সালের নভেম্বর মাসে শীতকালীন ফসল কেনার জন্যে ৮৩টি খাদ্য কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিকে সর্বমােট ১ কোটি ২২ লক্ষ টাকা সেচ কার্যক্রমের অধীনে বােরাে ফসলের জন্যে মখুর করে। তাছাড়া ব্যাংক ১৯৭৪ সালে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিগুলােকে প্রথমে ২৭ লক্ষ টাকা এবং পরে ১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ঋণ দান করে। এছাড়া গত বছর আলু চাষের জন্যেও ব্যাংক মুন্সীগঞ্জ থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিকে ৪ লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে।
সূত্র: বাংলার বাণী, ৩০ মে ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত