বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২২শে ডিসেম্বর, রোববার, ৬ই পৌষ, ১৩৮১
বঙ্গবন্ধুর সফল সফর
তিন দিনের সরকারি সফর শেষে গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবুধাবি থেকে ঢাকা ফিরে এসেছেন। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেছেন, আমাদের সফর সফল হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আরবদের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা আমাদের মুগ্ধ করেছে। তারা বাংলাদেশের জনগণকে ভালবাসেন ও সম্মান করেন।
আবুধাবি তথা সমগ্র আরব বিশ্বের জনগণ যে বাংলাদেশের জনগণকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন তার প্রমাণ আমরা ইতিপূর্বে ও পেয়েছি। আরব বিশ্বের উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ সবসময় একাত্মতা প্রকাশ করেছে। মনেপ্রাণে কামনা করেছে তাদের চূড়ান্ত সাফল্য। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জনগণ আরব বিশ্বের জনগণের পাশে অতীতে যেমন থেকেছে তেমনি আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তেমনি আরব জনগণ ও আমাদের পাশে থাকবেন।
স্বাধীনতার পর আরব বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ক্রমশই ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। আরব বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের নেপথ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে ইরাক, মিসর ও কুয়েত সফর করেছেন। সর্বশেষে সফর করলেন আবুধাবি। আবুধাবিতে বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা।
বঙ্গবন্ধুর আবুধাবি সফর শেষে বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমির শাহির মধ্যে সাত কোটি ডলারের একটি দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। এই সাত কোটি ডলারের (৫৬ কোটি টাকা) দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার মধ্যে ৫ কোটি ডলার দায় পরিশোধের সাহায্যের জন্য এবং বাকি দুই কোটি ডলার দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী আমদানি করবে সংযুক্ত আরব আমির শাহী বাংলাদেশের একটি সার কারখানা ও বগুড়ার জয়পুরহাটে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি প্রকল্পের বাস্তবায়নেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দান করবেন। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী বাংলাদেশকে আগামী পাঁচ বছরে ৪৫ লাখ টন অশোধিত তেল সরবরাহ করবে। এতে বাংলাদেশের মোট চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ পূরণ হবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আবুধাবি এ ঋণ ৪০ বছর দীর্ঘমেয়াদী, সুদের হার শতকরা ২ ভাগ মাত্র। এবং এ ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে দশ বছর অতিরিক্ত মেয়াদ ধার্য করা হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ২৫ বছরের শাসন, শোষণ, একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত। এমনই একটি অবস্থার মধ্যে যদি কোন বন্ধুত্বের সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন তখন তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, আমাদের এ বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা ও সংকট সাময়িক। এই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠব। বাংলাদেশের মানুষ ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা যে একদিন না একদিন সুদিন আসবেই। আজকের দুর্দিনে যারা আমাদের সাহায্য- সহযোগিতা করেছেন তাদের নামের তালিকা সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও একটি নাম। সফল সফরান্তে বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে এসেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান আগামী মার্চ মাসে বাংলাদেশে সফরে আসছেন। যাওয়া-আসা, দেওয়া-নেওয়া ও ভাবের আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে তা আরো সুদৃঢ় হোক এই কামনা করছি।
নিশাতের পর আদমজীতে আগুন
গত শুক্রবার টঙ্গীর নিশাত জুট মিলে আগুন লেগেছিল। কচু পাতার হিসাব অনুযায়ী গুদামে ৪০ হাজার মণ পাট ছিল। তারমধ্যে আনুমানিক ২০ ভাগ পাট পুড়ে গেছে। তবে সঠিক কোন হিসাব আজ অবধি কোন পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি। দমকল বাহিনীর ৫ ঘন্টা ব্যাপী আপ্রাণ চেষ্টায় মোট পাটের প্রায় ৮০ ভাগ রক্ষা পেয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত পানি ঢেলে পাটের আগুন নেভানোর কাজ অব্যাহত ছিল। দমকল সূত্রে জানা গেছে, নিশাত জুটমিলের পাশের জিনাত জুটমিলের চিমনি থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ এসে আগুন লেগেছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটার আসল কারণ সম্পর্কে জনসাধারণের মনে সংশয় রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় বলা হয়েছে। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ নাকি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেশ করে সংশয়টা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার পাট ভষ্মীভূত হয়েছে। নিশাত জুটমিলের আগুন নেভানোর কাজ শেষ হতে না হতেই গতকালের আর এক সংবাদে জানা গেছে যে, দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী একই দিনে পাঁচবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি না হলেও পাঁচ-পাঁচবার আগুন লাগাতে এলাকার জনসাধারণ হতবাক হয়ে গেছে এবং তারা আরও বড় কোনো ঘটনা ঘটবার আশঙ্কা করছে। খবরে বলা হয়েছে, আদমজী এক নম্বর মিলের বেচিং বিভাগের সকাল সাড়ে আটটায় আগুন লাগে এরপর দ্বিতীয় বার আগুন লাগে দুই নম্বর মিলে রিপিয়ারিং বিভাগে সকাল সাড়ে এগারটার দিকে। এরপর এক নম্বর মিলের কট উইনভিং বিভাগে আগুন লাগে বারোটা পাঁচ মিনিটের সময়। তিন নম্বর মিলের পশ্চিম পাড়ের শিমুল পাড়ার শ্রমিক বস্তিতে আগুন লাগে বিকেল ৩:৩০ মিনিটে এবং শেষ আগুন বিকাল ৪:৪৫ মিনিটের সময় তিন নম্বর মিলের গর্দা ঘরে লাগে। আদমজী মিলের নিজস্ব দমকল বাহিনীর জওয়ানরা সঙ্গে প্রতিটি স্থানের আগুন নিভিয়ে ফেলে। ফলে ব্যাপক কোন ক্ষতি হতে পারেনি। তবে আশঙ্কা ছিল লক্ষ লক্ষ টাকার জমাকৃত ভস্মীভূত পাট হয়ে যাওয়ার। পাটকল এ আগুন লাগার ঘটনা গত বছর এবং তার আগের বছরও বহু ঘটেছে। কয় কোটি টাকার পাহাড় শুধু আগুন লেগেই গতবছর পুড়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু ছিল মিলের পাট আর কিছু ছিল গুদামের পাট। এবছর মিলের পাঠ পড়তে শুরু করেছে-হয়তো এরপর গুদামের পাট ও পুড়বে। পাটে আগুন লাগার ঘটনার মধ্যে সবই দুর্ঘটনা এমন কথা আমরা বিশ্বাস করি না। এর অধিকাংশরই থাকে ষড়যন্ত্রমূলক। বিশেষ করে কোন কোম্পানির বা ব্যক্তির পাট যখন গুদাম থেকে পুড়ে যায় তার অধিকাংশই ষড়যন্ত্রমূলক। মিলের পাট পোড়ার মধ্যেও ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা থাকে। নিশাত জুট মিলের পাটে আগুন লাগার ঘটনার মধ্যে কোন ষড়যন্ত্রমূলক অভিসন্ধি আছে কিনা তা আজও জানা যায়নি। তবে এটা দুর্ঘটনাও হতে পারে। কতৃপক্ষ যদি যথার্থই অনুসন্ধান চালান তাহলে আমাদের বিশ্বাস-আসল কারণ উদ্ঘাটন করতে পারবেন অন্যদিকে আদমজী জুট মিলের বিভিন্ন বিভাগে মোট পাঁচবার আগুন লাগার সংবাদ আমরা লক্ষ্য করেছি তা উদ্বেগের বিষয়। এ আগুন লাগার কোন কারণ এ পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি। কর্তৃপক্ষ ও তেমন কোন কারণ জানাননি। আদমজী জুট মিলে আগুন লাগল স্বভাবতঃই বড় আকারের ক্ষতি সাধিত হতে যেতে পারে। শুধু দেশেই নয় এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ পাটকল আদমজী। তাই আদমজীতে আগুন লাগলে গোটা জাতির জন্য তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ লক্ষ টাকার পাট ছাড়া অন্যান্য অনেক মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে আদমজীতে আগুন লাগলে। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দেশের পঙ্গু অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে উল্লেখিত আগুন লাগার ঘটনা তদন্ত করা এবং এই আগুনলাগা শুধু কি দুর্ঘটনা ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা তার অনুসন্ধান করা। বস্তুতঃ গত বছরের কোটি কোটি টাকার পাট পুড়ে যাওয়ার ঘটনার কথা স্মরণ করেই কর্তৃপক্ষের এবছর কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক