You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.05.10 | রবীন্দ্র স্বর্ণপদক প্রবর্তনের আহ্বান | বাংলার বাণী - সংগ্রামের নোটবুক

রবীন্দ্র স্বর্ণপদক প্রবর্তনের আহ্বান

অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র স্বর্ণপদক প্রবর্তন এবং বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্র স্মৃতি সংরক্ষণাগার স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন।
গতকাল বাংলা একাডেমি আয়ােজিত রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণ দান প্রসঙ্গে তিনি উপরােক্ত প্রস্তাব রাখেন। তিনি সরকারি ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে কবিগুরুর সংকলন প্রকাশ ও গবেষণার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে আলােচনায় অংশ নেন ড. মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও বেগম সুফিয়া কামাল।
অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন বলেন: কবিগুরুর জ্ঞানের আলাে ও মমতায় হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সেতুবন্ধন তৈরী করে গেছেন আজ তা আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাধারণ মানুষকে তিনি যে মমতা দিয়ে অনুভব করেছেন তা মনে রেখে তার মানবপ্রীতির আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, কবিগুরু শিলাইদহে জনসাধারণকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন বলেই নােবেল বিজয়ী হতে পেরেছিলেন। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকার মাটির কবি। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শের বিভিন্ন কাহিনী উল্লেখ করে তিনি কবিগুরুর চরিতের ও কবি মানসের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেন।
সুফিয়া কামালঃ বেগম সুফিয়া কামাল কবি গুরুর আদর্শ প্রচার ও অনুশীলন করার জন্য তরুণ, কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কবিগুরু সাহিত্য ও সাহিত্যিক দুটোই সৃষ্টি করেছেন। পাঠক সৃষ্টি করে তিনি সাহিত্যের বিকাশ সাধন করেছেন। আমাদের দেশের তরুণদেরকে রবীন্দ্র চরিত্রের এই দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ যা দিয়ে গেছেন তার সদ্ব্যবহার হলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব।
মনিরুজ্জামান: ড. মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান বাংলাদেশে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তা ও পল্লী সমবায় নীতি বাস্তবায়নের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পাশ্চাত্য চিন্তার শ্রেষ্ঠত্বকে গ্রহণ করে এবং সমবায়ের মাধ্যমে পল্লী শক্তিকে সংগঠিত করার যে শিক্ষা কবিগুরু দিয়ে গেছেন সমস্যাসঙ্কুল বাংলাদেশের দৈন্য দূর করার এটিই অন্যতম পথ। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ক্ষোভের সাথে বলেন, রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষা চালুর নির্দেশ থাকলেও শ্রদ্ধার সাথে তা গৃহীত হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। এবং এজন্যই বাংলা ভাষা প্রচলনে অসঙ্গতি থেকে যাবে। এ ব্যাপারে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন হবার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ পরিষদ কবি জসীম উদদীন বলেছেন, রবীন্দ্র রচনা ও রবীন্দ্র দর্শন থেকে শিক্ষালাভ করে আমাদের জীবনের নানাবিধ সমস্যাকে মােকাবেলা করতে হবে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ পরিষদ মিলনায়তনে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আলােচনা সভায় কবি সভাপতির ভাষণ দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট প্রতিভা। তাঁর রচনা যতই পাঠ করা যায় ততই নতুন লাগে। নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথকে কোন কালের গণ্ডীর মধ্যে বেধে রাখা যায় না। তিনি সর্বকালের। সব মানুষের। তার রচনা সামগ্রী, তার মননশীলতা যুগযুগ ধরে সবাইকে প্রেরণা যােগাবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী শ্রী মনােরঞ্জনধর। আলােচনায় অংশ গ্রহণ করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ডক্টর মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
প্রধান অতিথির ভাষণে শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এ শতাব্দীর সূর্য তেজদীপ্ত জ্যোতিষ্ক।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ কালজয়ী প্রতিভার অধিকারী। কোন কালের গণ্ডীর মধ্যে বেধে রাখলে তার প্রতিভার প্রতি অবিচার করা হবে। রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ এটা তার মূল্যায়নের মাপকাঠি।
তিনি বলেন, কবি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথ বড়। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্যের কোনাে অহমিকা ছিল না। তিনি ছিলেন সকলের সহযাত্রী। তার প্রায় প্রতিটি লেখাই ঐতিহাসিক চেতনায় দীক্ষিত।
রবীন্দ্রনাথ জাতির গ্লানি মুক্তির অভিযানে নেমেছিলেন। অভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাের শিক্ষা তিনি শৈশব থেকেই পেয়েছেন।
তিনি বলেন, রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চা যতই বেশী হবে ততই সমাজ দেহ থেকে গ্লানি মুছে যাবে।
তিনি বলেন, বরীন্দ্রনাথের বাণী চিরঞ্জীব হয়ে উঠুক। দুঃখজয়ী মনােভাব নিয়ে রবীন্দ্র দর্শন গ্রহণ করতে হবে।
মুস্তাফা নুরুল ইসলাম: শিশুকলা একাডেমির মহাপরিচালক ডক্টর মুস্তাফা নুরুল ইসলাম বলেছেন, ১৯৭৫ সালে এসে রবীন্দ্র ভক্তদের কাছে যে একটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে সেটা হচ্ছে— রবীন্দ্র-প্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে না হ্রাস পাচ্ছে।
তিনি বলেন, জোর করে রবীন্দ্র-প্রিয়তা বাড়ানাে সম্ভব নয়। জাতীয় জীবনে, সবার জীবনে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়ােজনকে উপলব্ধি করতে পারলেই রবীন্দ্র-প্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ করলে চলবে না— তাঁকে আবিষ্কার করতে হবে। যিনি কালের গণ্ডীতে যত বেশী আবিস্কৃত হন তিনি তত মহৎ শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও তাই হয়েছে।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় আবিষ্কার করার প্রয়ােজন আছে।
ডক্টর মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, রবীন্দ্রনাথ সব সময় মানুষের কল্যাণ চিন্তা করেছেন। শান্তি ও শুভ বুদ্ধিতে মানুষের কল্যাণ হােক এটাই ছিল তার কাম্য।
তিনি বলেন শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে নয় তাঁকে জেনে তাঁর সাহিত্য চিন্তার আহ্বানে নতুন করে তাঁকে উপলব্ধি করে মনের মনিকোঠায় স্থান দিতে হবে।
শাপলা কুঁড়ি: গতকাল বিকেলে শাপলা কুঁড়ির আসর রবীন্দ্রনাথের জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে এক আলােচনা সভা ও কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিল। কবিতা আবৃত্তি করেন উজ্জল বিকাশ রায়, আবদুল মাজেদ বেপারী, শেখ রনি ইসলাম, শ্রী বিমান ভট্টাচার্য ও নজরুল হক সেলিম। আলােচনায় অংশ নেন সালেহ আহমেদ, ওবায়দুল হক আনন্দ, কাজী মােহাম্মদ হান্নান ও শ্রী বিমান ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন শ্রী বিমান ভট্টাচার্য গল্পবুড়াে।
শাওন সংসদঃ শাওন সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে এক আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হলাে। এতে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব আসাফদৌলা রেজা। প্রধান অতিথি ছিলেন ড. কাজী মােতাহার হােসেন। আলােচনায় অংশ গ্রহণ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী রণেশ দাশগুপ্ত।
প্রধান অতিথির ভাষণে ড. কাজী মােহাতার হােসেন বলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন এক বিশাল কালজয়ী প্রতিভা। তিনি সময়ের সদ্ব্যবহার ও সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে যখন বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজ। কবিগুরুর জীবনী অনুশীলন করে এ অপচয় রােধ করতে পারে।
রণেশ দাশগুপ্ত: শ্ৰী রণেশ দাশগুপ্ত বলেন, রবীন্দ্রনাথ অমর হয়ে থাকবেন সর্বকালে সর্বযুগে। তাঁর লেখা চিন্তাধারা কোন বিশেষ সমাজ বা বিশেষ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। তার লেখার বিশেষ দিক তাঁকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে।
সভাপতির ভাষণে জনাব আসাফদৌলা রেজা বলেন, রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী। তাঁর প্রতিভা দেশ কাল ও পাত্র ছাপিয়ে তিনি সর্বজনীন কবি হতে পেরেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, তিনি মানবতার কবি প্রকৃতির কবি। প্রকৃতির রূপ রস গন্ধে তিনি বিভাের হয়ে তাকে সার্থকভাবে তুলে ধরেন।
আলােচনা সভা শেষে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
শিল্পকলা একাডেমী: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে আগামীকাল সােমবার সন্ধ্যা ছ’টার সময় একাডেমী ভবনে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে আলােচনা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সােভিয়েত মৈত্রী সমিতি: আজ শনিবার সন্ধে ৬টায় বাংলাদেশ সােভিয়েত মৈত্রী সমিতির উদ্যোগে সমিতির কার্যালয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৯১তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক স্কুল: বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এক মনােজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালন করে।
দুটি পর্বে বিভক্ত এ অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল আলােচনা সভা। এতে স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগম সভানেত্রীত্ব করেন। বিভিন্ন বক্তাগণ কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার বিভিন্ন দিক আলােচনা করেন। সভানেত্রী তাঁর ভাষণে বলেন যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে বিশ্বসভার পরিচিত করেছেন। তিনি বাঙ্গালীর গর্ব।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল বিচিত্রানুষ্ঠান। এতে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানটির সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সহ শিক্ষয়িত্রী মিসেস নারিস আহমদ।

সূত্র: বাংলার বাণী, ১০ মে ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত