বাংলার বাণী
ঢাকা : ২১শে নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৩, ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রসঙ্গে
যে কোনো দেশের ব্যাপক শিল্পায়নে বা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ঐদেশের ব্যাংক বা ব্যাংকসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই।
বর্তমানে আমাদের দেশের তফসিলকৃত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোটামুটি তিনটি কাজ সমাধা করে থাকে :
(১) জনসাধারণের অর্থ ও মালামালের জিম্মা নেওয়া
(২) নির্দিষ্ট শর্তে বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ ব্যবসায় ও বাণিজ্যে বা শিল্পায়নে জনসাধারণকে অর্থ ঋণ প্রদান করা এবং
(৩) বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীর মাঝখানে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ ও লেনদেনে সাহায্য করা এবং পরোক্ষভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশী ব্যবসায়ীকে স্থানীয় ব্যবসায়ীর সম্পর্কে গ্যারান্টি দেওয়া।
ব্যাংকের এই বিভাগকেই এল-সি বা লেটার অফ ক্রেডিট বিভাগ বলা হয়। এছাড়া, ক্যাশ, ডিপোজিট, ফরেন এক্সচেঞ্জ, এডভান্স ইত্যাদি বিভিন্ন নামেও কয়েকটি বিভাগ আছে যাদের নামেই কাজের কথা বোঝা যায়।
দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার পূর্ব পরিকল্পনা ও ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশের সমস্ত ব্যাংক, বীমা ও পাট শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন।
ফলে, রাষ্ট্রায়ত্তের পর সমস্ত ব্যাংকগুলোর পূর্বতন নাম পরিবর্তন করা ছাড়া আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও সাধন করা হয়।
সত্যি কথা বলতে কি, দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের বিভিন্ন ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়া ছাড়া বা তাদের নাম পরিবর্তন হওয়া ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতিই সাধিত হয়নি। বরঞ্চ, দিন দিনই নানান বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, উদ্ভূট ব্যবস্থাপনা, অক্ষিপ্র কার্য সম্পাদন, অবহেলা, গুরুত্ব-অজ্ঞানতা ইত্যাদি নানান দুর্বলতার দৌরাত্ম্যে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এক চরম সংকটময় মুহূর্তে উপনীত।
প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরত কর্মচারীরা জনসাধারণের সঙ্গে সুব্যবহার করেনা বা জনসাধারণের সমস্যা দূর করতে সহযোগিতামূলক হাত বাড়ায়না। অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয়না এমনও অনেকের অভিযোগ আছে।
পোস্টিং, ট্রান্সফার বা ক্লিয়ার্যান্সে অহেতুক সময় গ্রহণ করে তারা ব্যস্ত মানুষের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে দারুণ ব্যাঘাত ঘটায়। সবক্ষেত্রেই যেন একভাবে সপ্তমী : ‘কিছু ঝাড়ো, কাজ লহ।’
আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ক্ষেত্রেও প্রত্যেক ব্যাংকে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। একে অপরের দুর্বলতা খুঁজে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার তালে ব্যস্ত, কিন্তু নিজস্ব কর্ম দক্ষতার উন্নতি বিধান যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সে কথা কেউ আর গরজ দিয়ে ভাবছে না।
তবে সবচেয়ে বেশী গলদ ও ঘাপলা বোধ হয় ফরেন এক্সচেঞ্জ ও এল সি বিভাগে।
আগে ব্যাংক নিজের আগ্রহেই ক্রেতার পিছু ধাওয়া করে দিনের পর দিন লেগে থেকে এবং নানান সুযোগ-সুবিধা দান করে ক্রেতাকে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্যে এল-সি খুলতে উৎসাহিত করতো। কিন্তু এখন ঠিক তার উল্টো। এখন ক্রেতা স্বেচ্ছায় ব্যাংকে এসে এল সি খুলতে চাইলেও ব্যাংকের নানান ঘাপলায় তা’ সময় মতো সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে সময় মতো শিপিংও ধরা যায়না। এভাবে নিতান্ত অকারণেই বা কতকগুলো দুষ্কৃতিকারীর ইচ্ছাকৃত ঘাপলাতেই সমগ্র শিপিং পিরিয়ডে কোনো আমদানী বা রপ্তানী সম্ভব হয়না। আমাদের অর্থ অস্বচ্ছল রাষ্ট্রীয় কোষাগার এক বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আবার অন্যদিকে সময়মতো কন্ট্রাক্ট পালন করতে না পারার জন্যে বিদেশীদের কাছে আমাদের যথেষ্ট মানহানিও হয় এবং তারা বাধ্য হয়ে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য হয়।
সুতরাং, শুনতে যতোই খারাপ লাগুক না কেন, কিম্বা, আমাদের এ মন্তব্যে যার প্রাণেই আঘাত লাগুক না কেন, এ কথা বলতে কোনো আতিশয্য নেই যে, আমাদের দেশের ব্যাংকিং প্রথা সম্পূর্ণ ব্যর্থতার কাঠামোতে পরিচালিত হচ্ছে। কতকগুলো মান্ধাতার আমলের নিয়মকানুন ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে আমাদের দ্রুত শিল্পোন্নয়নের কাজ ব্যাহত হওয়া সহ দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মচাঞ্চল্যও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং ব্যাংকে যথার্থ যোগ্যতা বা কার্যকারিতা সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষ ক্রমেই সন্দিহান হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থার প্রতি সরকারের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো বিহিত না করলে আমাদের সবার জীবনেই অর্থনৈতিক দুর্যোগের কালো ছায়া নেমে আসবে।
এখনো সময় আছে
খুলনা গোয়ালপাড়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবগুলো চালু ইউনিট যে কোনো সময়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গত পরশু ‘বাংলার বাণী’তে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা বিদ্যুৎ বন্ধ হওয়ার সংবাদটি এমন কিছু নতুন নয়। হরহামেশাই হচ্ছে। হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়তো বিদ্যুতের অভাবে কল-কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ থাকছে। কিছুদিন আগেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো যে, বিদ্যুতের অভাবে খুলনার ১৪টি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটলেও বিদ্যুতের অবস্থা কিন্তু যা ছিলো তাই আছে। বরং বলা চলে দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কখন যে বিদ্যুৎ নামক বস্তুটির মেজাজ বিগড়ে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দেশের সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে এ কথা সত্য। কিন্তু তেমনি সত্য হলো সেই ধ্বংস স্তূপের মধ্যেও প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। যে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে হানাদার বাহিনী পঙ্গু করে দিয়েছিলো সেই যোগাযোগ ব্যবস্থাতে প্রাণের সঞ্চার হলো সর্বশেষ ভৈরব সেতু মেরামতের মাধ্যমে। কমবেশী এগিয়ে যাচ্ছেন সকলেই। কিন্তু বিদ্যুৎ দপ্তরের অবস্থা একেবারে নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। এ কথা কে না জানে যে, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে উৎপাদন ব্যাহত এবং কল-কারখানার কাজের গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এতে কর্মদক্ষতা বাড়া দূরে থাকুক দিনকে দিন কমবে। তাছাড়া বিদ্যুতের অভাব হলেই কেরোসিন, কয়লা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যায়।
এদেশের জনসাধারণ বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্যে যে মূল্য দিয়ে থাকেন তা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। এমনি অবস্থায় যদি গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অভাব থাকে তাহলে অবস্থাটি যা দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বিদ্যুৎ নিয়ে লেখালেখি অনেক হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার কিছুই হয়নি। আমরা আশা করবো, দেশের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বিদ্যুৎ দপ্তর এ ব্যাপারে সচেতন হবেন। সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করবেন। আর তা যদি না করেন তাহলে তার পরিণতি খুব একটা শুভ হবে বলে মনে হয় না। পরিবেশে, আমরা আবার বলবো এখনো, সময় আছে বর্তমান অচলাবস্থাকে দূর করে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার।
ভুয়া সমিতির উৎপাত
পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়বে প্রতিদিনই একটা না একটা সমিতির জন্ম হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে কত যে সমিতির জন্ম হয়েছে এবং অকাল মৃত্যু হয়েছে তার কোনো হিসাব নিকাশ নেই। তিনজন কি চারজন মিলিত হলেই সমিতি গড়ার প্রবণতায় পেয়ে বসে।
সমিতি গড়ার হিড়িক এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, জেলা, মহকুমা থেকে শুরু করে গ্রামভিত্তিক বা বিশেষ এলাকা ভিত্তিক সমিতিও গড়ে উঠছে। এমনকি অফিস আদালতেও সমিতি গড়ার হিড়িক পড়েছে। বর্তমানে অবস্থাটা যা দাঁড়িয়েছে তাতে কোনটা আসল বা কোনটা নকল সমিতি তা বুঝে ওঠা দায়।
সম্প্রতি কোনো এক অনুষ্ঠানে জনৈক মন্ত্রী ভুয়া সমবায় সমিতির উৎপাতে সামগ্রিকভাবে সমবায় ব্যবস্থাই লাটে উঠতে বসেছে বলে অভিযোগ করেছেন।
ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিদিন যে সমিতিগুলো গজিয়ে উঠছে তার নেপথ্য কাহিনী অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই নব নব সমিতির জন্ম হচ্ছে বলে আমাদের ধারণা।
বাংলাদেশে সমিতি বা সংগঠন থাকবে না এমনটি আমরা বলছি না। তবে তার একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে বৈকি! কল-কারখানার শ্রমিক, ক্ষেতে-খামারের কৃষক অথবা সংস্কৃতি সেবীদের সমিতি বা সংগঠন থাকতেই হবে। এসব সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে উৎপাদন বৃদ্ধি ও সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করার। কিন্তু তা যদি না হয় তবে ব্যাঙের ছাতা জাতীয় সমিতি বা সংগঠনের সৃষ্টি হবেই। আমরা সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলবো, ভুয়া সমিতি বা সংগঠনের জন্ম হবার আগেই তার প্রতিরোধ করা উচিত। সরকার এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করতে পারেন অথবা রেজিস্ট্রেশন দানের ব্যাপারে কড়াকাড়ি আরোপ করতে পারেন।
পরিশেষে, আমরা আবার বলবো যে, ব্যাঙের ছাতা জাতীয় সমিতি যাতে গজিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক