You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী

আজ ঐতিহাসিক সতেরই এপ্রিল। চার বছর আগে এদিনে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের তবের পাড়ার ঐতিহাসিক আম্রকাননে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘােষণা করা হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী হিসাবে এর নূতন নামকরণ হয়েছিল মুজিবনগর। স্থানটি জেলা সদর কুষ্টিয়া থেকে প্রায় ৪৫ মাইল, ভারতীয় সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের চার মাইল অভ্যন্তরে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে এই মুজিবনগরের জন্ম। ভবেরপাড়া গ্রামের আম্র কাননের ছায়াতেই মুজিব নগরের পত্তন হয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুজিবনগর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক সতেরই এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে যখন বাংলাদেশ সরকার শপথ নিতেছিলেন সেই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশ-বিদেশী অনেক সাংবাদিকসহ নব গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সেনা বাহিনীর কড়া প্রহরায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণের পর জনৈক বিদেশী সাংবাদিক স্থানটির নাম জিজ্ঞেস করলে জনাব তাজউদ্দিন উত্তর দিয়েছিলেন, “মুজিবনগর” সেই থেকেই ভবেরপাড়ার এই আম্রকাননের নাম হলাে মুজিব নগর। সম্ভবত: সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে কুষ্টিয়াই প্রথম মুক্ত এলাকা যেখানে সমস্ত ঘরে ঘরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাতাকা উড়েছিল এবং ১লা এপ্রিল থেকে ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত ষােলদিন কুষ্টিয়া জেলা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীন। এই স্বল্প সময়ে জন্য কুষ্টিয়ার অন্যতম মহকুমা শহর চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘাষণা করা হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মেহেরপুরের ভবের পাড়াতেই মুজিবনগর নাম দিয়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীরূপে ঘােষণা করা হয়েছল। ভবের পাড়ার বিশাল আম্রকাননে সেদিন পতপত করে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। ঘােষিত হয়েছিল তৎকালীন জাতীয় পরিষদের হুইপ ইউসুফ আলীর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র। জাতির জনক এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব সেদিন মুজিব নগরে উপস্থিত ছিলেন না। কারণ তিনি সেদিন দেড় হাজার মাইল দূরে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তাই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম ঘােষণা করেছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ও ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তরের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামের কর্মকেন্দ্র হইয়াছিল। এই মুজিবনগর বর্বর পাকবাহিনীর প্রবল অত্যাচারের মুখেও মাথানত করে নাই। দৃপ্ত পদক্ষেপে মাথা উঁচু করে বারবার সে প্রতিহত করেছিল পাকবাহিনীর নগ্ন হামলা। তাই মুজিনবগর আজ বাংলাদেশের এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের ১৭ই এপ্রিল প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের স্মারক হিসেবে মুজিবনগরে একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
প্রতিবছর এই দিনে মুজিবনগরে অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। বাংলাদেশের সরকারের মন্ত্রী ও রাজধানী থেকে বহু পণ্ডিত ও সাহিত্যিকরা এইদিনে এখানে আসেন। নবাব আমলের বহু কীর্তি বিজড়িত মুজিবনগর তথা মেহেরপুরের বগীর হামলা প্রতিহতের জন্য নির্মিত গড়ের ধ্বংসাবশেষ আজোও এখানে বিদ্যমান রহিয়াছে। এই গড়কে কেন্দ্র করে বহু কিংবদন্তী ও কাহিনী এখনাে বহুল প্রচলিত। শােনা যায়, বগী দমনে নবাব আলীবর্দী খান মেহেরপুরে আগমন করেছিলেন। এ ছাড়া বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতন ঘটানাের জন্য আজ থেকে প্রায় ২১৫ বৎসর আগে এই মেহেরপুরেই মীরজাফর ও লর্ড ক্লাইভ বাঙালিদের স্বাধীনতা হরণের ষড়যন্ত্র করেছিলবলে জানা যায়। তাই ইতিহাসের পাতায় মুজিবনগর একটি জ্বলন্ত নাম-একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় এই মুজিব নগরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে বহু ঘাত প্রতিঘাত আর ঘটনা প্রবাহ। কে জানিত মেহেরপুরের এই খণ্ড গ্রামটি ইতিহাসের পাতায় পলাশীর ন্যায় আর একটি নামের সংযােজন করিবে। কে জানিতাে এই মুজিবনগর স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদা পাবে? পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজদ্দৌলা জীবন দিয়েও যা রক্ষা করতে পারেন নাই। সেই পরাধীন বাঙ্গালীর লুপ্ত স্বাধীনতা মুজিবনগরের আম্রকাননে পুরুজ্জীবিত হয়েছিল বাংলার সিংহপুরুষ শেখ মুজিবের মরণপণ সংগ্রামী নেতৃত্বে।

সূত্র: দৈনিক আজাদ, ১৭ এপ্রিল ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!